আবু নাঈম :
কক্সবাজারের ঈর্ষণীয় জনপ্রিয় এক বিষ্ময়কর নেতার নাম এড মোহাম্মদ খালেকুজ্জামন। ছাত্র জীবন, পেশাগত জীবন এবং রাজনৈতিক জীবনে তাঁর সাফল্য ছিল আকাশচুম্বি। তাঁর বিনয়ী ব্যবহারে অতি অল্প সময়ে যেমনি জয় করে নিয়েছিলেন কক্সবাজার-রামুর সর্বস্তরের মানুষের হৃদয়। তেমনি প্রভাব বিস্তার করেছিলেন রাজনৈতিক মাঠেও। এতে করে তিনি হয়ে উঠেছিলেন এক অপ্রতিদ্বন্দ্বী ঈর্ষণীয় জনপ্রিয় ব্যক্তিত্বে। তাঁর ইন্তেকালের ১৭ তম বর্ষেও রামু-কক্সবাজারের মানুষ তাঁকে যেভাবে স্মরণ করছেন এতে করে মনে হচ্ছে জনগণের ভালবাসা সিক্ত এড খালেকুজ্জামান আজো বেচেঁ আছেন তাদের মাঝে।
একজন খ্যাতিমান আইনজীবী, একজন কম্পিউ টার বিজ্ঞানী ঢাকার আরাম আয়েশের জীবন ছেড়ে কক্সবাজারে এসে রাজনীতির বন্দুর-পিচ্ছিল পথে যেভাবে জনগণের ভালবাসা অর্জন করেছিলেন সমকালীন রাজনীতিতে তা ছিল বিরল। অহিংস রাজনীতি আর নির্মোহ ভালবাসা দিয়ে যে মানুষের ভালবাসা পাওয়া যায়, জনগণের মন জয় করাযায় কক্সবাজার সদর-রামু আসন থেকে পরপর দু’বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে খালেকুজ্জামান তা প্রমাণ করেছিলেন।
অবশ্য এড খালেকুজ্জামানের এই জনপ্রিয়তা কারো কারো ঈর্ষার কারণ হয়েও দাড়িঁয়েছিল। এতে তাঁর চলার পথে বেগ পেতে হয়েছিল বারবার। কিন্তু রামু-কক্সবাজারবাসীর ভালবাসায় বিনে সুতার বন্ধনে আবদ্ধ খালেকুজ্জামান আমৃত্যু
থেকেছেনে তাদের সাথে।
২০০১ সালের ১ অক্টোবরের নির্বাচন পর্যন্ত বেঁচে থাকলে হয়ত ৩য় বারের মত কক্সবাজার সদর-রামুর এমপি হতেন খালেকুজ্জামান। সেই নির্বাচনের প্রচারণাকালে উর্মী কমিউনিটি সেন্টারে তাঁর উপর হামলা হয়েছিল প্রতিনিধি সভায়। পন্ড করে দেয়া হয়েছিল প্রতিনিধি সভা। রক্তাক্ত হয়েছিলেন খালেকুজ্জামান এবং তার অনেক নেতা-কর্মী-সমর্থক। কিন্তু বিচলিত হননি খালেকুজ্জামান। সেদিন উপস্থিত কেউ গুলির মুখে পালিয়ে যায়নি তাদের ভালবাসার মানুষটিকে ফেলে। হামলাকারীরা চলেগেলে খালেকুজ্জামান সমাবেশে বলেছিলেন, ‘সম্মানিত রামু-কক্সবাজারের মুরব্বিগণ, আপনারা আমার পিতৃতুল্য। আমার বাবা আজীবন দেশ ও জাতির জন্য কাজ করে ছিলেন। তিনি নির্মম ভাবে শহীদ হয়েছেন। আপনাদের সামনেই আমার উপর সন্ত্রাসী হামলা হল। তারা আমার বাবার মত আমাকেও দুনিয়া থেকে বিদায় দিতে চেয়েছিল। আল্লাহর মেহেরবানিতে আমি বেঁচে গেছি। শারীরিক ভাবে আহত এবং মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হলেও আমি সাহস হারাইনি। আমার অনেক সহকর্মী ভায়েরা আহত হয়েছেন, রক্তাক্ত হয়েছেন।’
তিনি আরও বলেছিলেন, ‘ঢাকার অনেক আরাম আয়েশের জীবন ছেড়ে আপনাদের ভালবাসায় আমি এই কঠিন জীবন বেছে নিয়েছি। রামু কক্সবাজারের মাঠে-ঘাটে, পথে-প্রান্তরে, পাড়ায়-মহল্লায় আমি আপনাদের পরীক্ষিত বন্ধু। যারা আজকে আমার উপর হামলা করেছে তারা চায় আমি যেন কক্সবাজারের রাজপথ ছেড়ে, আপনাদের ছেড়ে চলে যাই। আমি আপনাদের কাছে জানতে চাই হামলাকারীরা যা চায় আমি তা করব কিনা ? আপনারা যদি বলেন আমি ঢাকায় ফিরে গিয়ে সেই আরাম আয়েশের জীবন যাপন করব। আর যদি বলেন আপনারা আমার পাশে থাকবেন, আমিও আপনাদের পাশে থেকে জীবন উৎসর্গ করে আপনাদের ভালবাসার মূল্য দিতে চেষ্টা করব।’ তখন সমস্বরে উপস্থিত সবাই বলেছিলেন ‘না। আমরা আপনাকে ছেড়ে যাবনা, আপনিও আমাদের ছেড়ে চলে যাবেন না।’
সেদিন তিনি রক্তাক্ত য়েছিলেন, তাঁর সহকর্মীরা আহত হয়েছিলেন। কিন্তু মামলা হামলার মত কোন ঘটনা করে তিনি তার প্রতিশোধ নেননি। তিনি দেখিয়েছিলেন অহিংসা, সৃষ্টি করেছিলেন ভালবাসা ও মমতার সেতু বন্ধন।
দেখা গেছে, জীবন দিয়ে খালেকুজ্জামান তাঁর সেই কথা রেখেগেছেন। তৎকালীন ৪ দলীয় জোটের মনোনীত প্রার্থী কক্সবাজার-রামুর জনগণের ভালবাসায় সিক্ত খালেকুুজ্জামান জনতার মাঝে তাঁর জীবন উৎসর্গ করেছেন। হ্যাঁ, ৩য় বারের মত এমপি হওয়ার (১ অক্টোবর ২০০১, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের) মাত্র তিনদিন আগে ২০০১ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর রামু-কক্সবাজারবাসীর ভালবাসার মানুষটি তাদের ছেড়ে চলেযান না ফেরার পথে।
আমাদের সমাজে এখনো একজন মানুষের শেষ বিদায় বা জানাযায় জনসমাগমকে ওই মানুষটির প্রতি জনগণের ভালবাসা ও জনগণের প্রতি ওই মানুষটির কতটুকু সম্পৃক্ততা ছিল তা প্রমাণ করে বলে মনে করা হয়। বিমান বন্দরের পাশে ঐতিহাসিক জেলেপার্ক ময়দানে অনুষ্ঠিত হয়েছিল এড খালেকুজ্জামানের নামাজে জানাযা। স্মরণকালের নামাজে জানাযার মধ্যে এই জানাযা ছিল অন্যতম। জীবত খালেকুজ্জামানের প্রতি রামু-কক্সবাজারের মানুষ যেভাবে ভালবাসা দেখিয়েছিলো মৃত খালেকুজ্জামানের প্রতিও তাদের ভালবাসা চুল পরিমানও কম ছিলনা। সেই বিশাল নামাজে জানাযা তারই প্রমাণ।
রামু-কক্সবাজারের জনগন সেদিন তাদের ভালবাসার মানুষটির এভাবে চলে যাওয়া মেনে নিতে পারেনি। তারা ভুলতে পারেনি খালেকুজ্জামানের নিরহংকার অমলিন চেহারা। রামু-কক্সবাজারের মানুষের মনে অমর হয়ে আছেন তাদের প্রিয় নেতা এড খালেকুজ্জামান।
পরবর্তীতে তারা খালেকুজ্জামানের ভালবাসার মূল্যায়ন করেছিলেন তাঁর ছোট ভাই ইঞ্জিনিয়ার মুহাম্মদ সহিদুজ্জামানকে বিপুল ভাবে ভোট দিয়ে এমপি বানিয়ে। মরহুম এড, খালেকুজ্জামান অহিংস রাজনীতি ও সবাইকে ভালাবাসার যে রাজনীতি দিয়ে কক্সবাজার-রামুবাসীর মন জয় করেছিলেন আজ তার বড়ই অভাব অনুভূত হচ্ছে আমাদের সমাজে ।
জনতার দাবী এবং বাস্তব সম্মত কারণেই খালেকুজ্জামানের স্মরণে তাঁর শেষ নি:শ্বাস ত্যাগের স্থানের নামকরণ করা হয়েছিল ‘খালেকুজ্জামান চত্বর’। ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ সহিদুজ্জামান এমপি থাকাকালীন সময়ে জনতার দাবীর মুখে এড খালেকুজ্জামানের শেষ নি: শ্বাস ত্যাগের (রামু বাইপাসের সংযোগ) স্থানটিকে ‘খালেকুজ্জামান চত্বর’ নাম করণ করা হয়। ওখানে নাম ফলকও স্থাপন করা হয়েছিল তখন। এখনো সেই নাম ফলক অবশ্য বিদ্ধমান রয়েছে।
কিন্তু পরবর্তীতে দেখাগেছে, দুইবারের জপ্রিয় একজন সংসদ সদস্যের নামে স্থাপিত সেই চত্তরে স্থাপন করা হয়েছে ফুটবল ভাস্কর্য। আর প্রতিদিন সেই নাম ফলকটি রাজনৈতিক কারণে ঢেকে দিয়ে মনিল করে দেয়া হচ্ছে এককালের সেই জনপ্রিয় এমপি এড খালেকুজ্জামানের স্মৃতিকে। এটি রামু-কক্সবাজারের সাধারণ মানুষ কিন্তু মেনে নিতে নারাজ। একজন জনপ্রিয় সংসদ সদস্য ও জননেতার প্রতি সম্মান দেখিয়ে তাঁর স্মৃতি ফলক ও স্মৃতিময় স্থানটি সংরক্ষিত থাকুক এটি সর্বমহলের দাবী।
ইন্তেকালের ১৭ বছর পরে আজো রামু-কক্সবাজারের জনগণ শ্রদ্ধা ও ভালবাসায় স্মরণ করছেন মরহুম এড খালেকুজ্জামানকে। সপ্তাহজুড়ে নানা আয়োজনের মাধ্যমে স্মরণ করা হচ্ছে তাঁকে। প্রতিদিন রামু-কক্সবাজারের মসজিদে মসজিদে হচ্ছে দোয়া মাহফিল। স্থানীয় সংবাদ পত্রগুলো প্রকাশ করছে তাঁর জীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে বিদগ্ধ লেখকদের তথ্যসমৃদ্ধ লেখা। এতেই বলা যায় ’এড খালেকুজ্জামান বেঁচে আছেন জনতার মাঝে’।
আমরা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।