-তপন কুমার নাথ
১০ অক্টোবর, মঙ্গলবার, ২০১৭ ইং, বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস । এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় “কর্মক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্য”। মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি সচেতনতা বৃদ্ধি এবং উন্নত মানসিক স্বাস্থ্য গঠনের প্র্রচেষ্টার সার্বিক উদ্দেশ্য নিয়ে প্রতি বছর এ দিনটি পালন করা হয়। মনোচিকিৎসক, মনোবৈজ্ঞানিক, নার্স, অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী, সমাজকর্মী, স্বেচ্ছাসেবক, জনস্বাস্থ্য নীতিমালা ও স্বাস্থ্য আইন প্রণেতারা, সেবা ব্যবহারকারী এবং সেবা প্রদানকারী জনগোষ্ঠী, কমিউনিটি নেতা, সরকারি প্রতিনিধি, বেসরকারি সংস্থা এতে অংশ নিয়ে থাকেন।
বাংলাদেশে মানসিক রোগে আক্রান্ত প্রায় দুই কোটি মানুষের চিকিৎসার জন্য সরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন হাসপাতালে মাত্র ৮১৩টি শয্যা রয়েছে। বিভাগ, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে পৃথক কোনো সেবাকেন্দ্র নেই। হাতেগোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের ওপর এ রোগের চিকিৎসা নির্ভরশীল। এ ছাড়া এ রোগের চিকিৎসার জন্য দেশে মাত্র ১৯৫ জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক রয়েছেন। দেশে প্রায় দুই কোটি মানুষ মানসিক রোগে আক্রান্ত, এতে করে মানসিক রোগে আক্রান্তরা চিকিৎসা সেবা থেকে সম্পূর্ণরূপে বঞ্চিত হচ্ছে।
তাদের মধ্যে প্রায় একশ’ চিকিৎসক রাজধানীতে অবস্থান করছেন। জেলা ও উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে কোনো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নেই। সরকারি পর্যায়ে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, পাবনা মানসিক হাসপাতাল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে মানসিক রোগীদের চিকিৎসাসেবা দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া দেশের কয়েকটি সরকারি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে সীমিত পরিসরে মানসিক রোগে আক্রান্তদের চিকিৎসা দেওয়া হয়। এসব প্রতিষ্ঠানে রোগী ভর্তির জন্য শুধুমাত্র ৮১৩টি শয্যা আছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে প্রাপ্তবয়স্ক জনগোষ্ঠীর মধ্যে ১৬ শতাংশ এবং শিশু-কিশোরদের মধ্যে ১৮ শতাংশ মানসিক সমস্যায় ভুগছে। এ ছাড়া শিশু-কিশোরদের মধ্যে প্রতি হাজারে আটজন অটিজমে আক্রান্ত। এর মধ্যে সিজোফ্রেনিয়া রোগীর সংখ্যা দুই কোটি ৬০ লাখ।
এ বিষয়ে মনোবিদ মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞদের অভিমত মানসিক রোগ সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা, কুসংস্কার এবং সামাজিক কারণে অসুস্থতার চেয়ে সমাজই আক্রান্তদের বেশি নিগৃহীত করে। ভ্রান্ত ধারণা বর্জন করে সঠিক জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে এ অবস্থার উন্নতি করা সম্ভব।
মানসিক রোগীর চিন্তা, প্রত্যক্ষণ ও আচরণের অস্বাভাবিকতা দেখা যায়। অলীক প্রত্যক্ষণ (হ্যালুসিনেশন) :যেমন কানে অদৃশ্য কারও কথাবার্তা শোনা, বদ্ধমূল ভ্রান্তবিশ্বাস (ডিল্যুশন), অহেতুক সন্দেহ, অস্বাভাবিক আচরণ, নিজের চিন্তা ছড়িয়ে যাচ্ছে বা চুরি হয়ে যাচ্ছে বা অন্যের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে এমন বিশ্বাস, ঘুমের সমস্যা, একা একা কথা বলা, নিজের মধ্যে গুটিয়ে থাকা, কর্মক্ষমতা নষ্ট হওয়া ইত্যাদি লক্ষণ থাকতে পারে। সাধারণত ১৫ থেকে ৪৫ বছর বয়সের মধ্যে এ রোগের লক্ষণ দেখা দেয়। পঞ্চাশের দশকের পর থেকে মানসিক রোগের ওষুধের আবিষ্কার ও ব্যবহার বাড়তে থাকায় বিশ্বব্যাপী এ রোগের লক্ষণগুলো নিয়ন্ত্রণ করা বহুলাংশে সম্ভব হয়েছে। হতাশ না হয়ে যে কোনো মানসিক রোগকে চিকিৎসার আওতায় আনতে হবে। সবার আগে প্রয়োজন সিজোফ্রেনিয়া রোগটি সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা ও বিজ্ঞানভিত্তিক চিকিৎসা। অনেক সময় নানা কুসংস্কারের কারণে বিজ্ঞানভিত্তিক চিকিৎসার বিপরীতে অপচিকিৎসা গ্রহণের কারণে মানসিক রোগ আরও জটিল হয়ে ওঠে। মনে রাখতে হবে যে, মানসিক রোগ একটি দীর্ঘমেয়াদি রোগ, তাই দীর্ঘসময় এমনকি কখনও কখনও সারাজীবন ওষুধ খাওয়াতে হবে। রোগী ওষুধ না খেলে তাকে দোষারোপ করা যাবে না; বরং স্বজনদেরই দায়িত্ব নিতে হবে।
কর্মক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্য:
জীবনের প্রয়োজনে হোক বা জীবিকার প্রয়োজনেই হোক প্রতিটি মানুষকে কিছু না কিছু কাজ করতেই হয়। প্রাপ্তবয়স্কদের দিনের অধিকাংশ সময়ই কর্মক্ষেত্রে ব্যয় হয়। তাই মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর কর্মক্ষেত্রের তাৎপর্যপূর্ণ প্রভাব প্রতীয়মান, যা কোনো প্রতিষ্ঠানের বা দেশের অর্থনৈতিক স্বাস্থ্যেও চূড়ান্ত অবদান রাখে। এছাড়া কর্মক্ষেত্রের অভিজ্ঞতা আমাদের সামগ্রিক সুশৃঙ্খলতার অন্যতম নির্ধারক।
কোনো প্রতিষ্ঠানের নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ বা পরিচালকবৃন্দ যারা কর্মক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্য উন্নীত করার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করেন তারা শুধু মানসিক রোগের কর্মীদের স্বাস্থ্য রক্ষার্থে সহায়তা করেন না বরং কর্মক্ষেত্রে তাদের উৎপাদনশীলতার দিকেও মনোযোগী হন। অপরদিকে, নেতিবাচক কাজের পরিবেশ কর্মীদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা, মাদকদ্রব্য ও অ্যালকোহলের অপব্যবহার, কর্মস্থলে অনুপস্থিতি, উৎপাদনশীলতা হ্রাস ইত্যাদির দিকে ঠেলে দেয়। কর্মক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্যর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ উপাদানগুলোর মাঝে রয়েছে অপর্যাপ্ত স্বাস্থ্যনীতি এবং নিরাপত্তাব্যবস্থা, দুর্বল যোগাযোগ এবং ব্যবস্থাপনার চর্চা, সিদ্ধান্ত গ্রহণে সীমিত অংশগ্রহণের সুযোগ, অপর্যাপ্ত বেতন কাঠামো অনমনীয় কাজের সময়, পদোন্নতি না হওয়া, কর্মীদের প্রতি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের আচরণ ও মনোভাব, সহকর্মীদের সহমর্মিতার অভাব, কর্ম সম্পাদনে অস্পষ্ট সাংগঠনিক উদ্দেশ্য, রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি ও দলীয়করণ, স্ব-স্ব কর্মক্ষেত্রে কম নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি। ঝুঁকিগুলো কাজের সামগ্রী সম্পর্কিতও হতে পারে। যেমন- ব্যক্তির দক্ষতার চেয়ে কাজের মান উচ্চ হলে বা অত্যধিক কাজের চাপ থাকলে তা মানসিক চাপ তৈরি করতে পারে। কিছু কাজ কর্মীর জীবনের জন্য হুমকিস্বরূপ যেমন- অগ্নিনির্বাপক কর্মী, ডুবুরি এদের কাজ। যেসব কাজের ক্ষেত্রে দলীয় সংহতি এবং সামাজিক সমর্থনের অভাব থাকে সেগুলোও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। কর্মক্ষেত্রে মনস্তাত্ত্বিক হয়রানি, ঝুঁকিগুলোর মাঝে অন্যতম।
মানসিক রোগের মাঝে সচরাচর বেশি পরিলক্ষিত হয় বিষন্নতা এবং উদ্বেগজনিত রোগ; যা কর্মস্থলের বিভিন্ন সমস্যা থেকে উদ্ভূত এবং কর্মক্ষমতা ও উৎপাদনশীলতার ওপর গুরুতর প্রভাব ফেলে। বিশ্বব্যাপী ৩০০ মিলিয়নের বেশি মানুষ বিষন্নতায় ভোগে, যা কর্মপ্রতিবন্ধকতার প্রধান কারণ।
২৬০ মিলিয়নেরও বেশি মানুষ উদ্বেগজনিত রোগে ভুগছেন। অনেকেই আবার বিষন্নতা এবং উদ্বেগ দুটির সঙ্গেই বসবাস করছেন।
ডব্লিউএইচও-এর নেতৃত্বাধীন একটি সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে প্রতি বছর বিষন্নতা এবং উদ্বেগরোগ বিশ্ব অর্থনীতিতে ১ ট্রিলিয়ন ইউএস ডলারের মতো উৎপাদন হ্রাস করছে। যার প্রভাব আনুপাতিক হারে বাংলাদেশেও যথেষ্ট পড়ছে।
তাছাড়া কোনো ব্যক্তি যদি মানসিক চাপে থাকে তা হলে তার মানসিক রোগের প্রকোপ বেড়ে যেতে পারে অথবা নতুন করে মানসিক রোগ দেখা দিতে পারে যা বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত। ভারচুয়াল জগতে অধিক পরিমানের বিচরণকারী তরুন-তরুনীরা আজ মানসিক বিষন্নতায় আক্রান্ত হচ্ছে। যার নেতিবাচক প্রভাব সারা বিশ্বের ন্যায় বাংলাদেশেও পড়েছে, সারা বিশ্বে তথাকথিত ব্লুহুয়েল (নীল তিমি) গেমস্ এর অপব্যবহারের কারণে বিষন্নতায় আক্রান্ত হয়ে এ পর্যন্ত প্রায় ৫০০ তরুন-তরুনী আত্ম হত্যা করেছে। বাংলাদেশেও গত ৭ অক্টোবর অষ্টম শ্রেণীর মেধাবী ছাত্রী ভারচুয়াল জগতের বিষন্নতার কুপ্রভাবে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়।
দীর্ঘমেয়াদি মানসিক চাপ মনোযোগে সমস্যা, ঘুমের সমস্যা, স্মরণশক্তি হ্রাস, ইত্যাদি মানসিক সমস্যার পাশাপাশি কিছু গুরুতর শারীরিক রোগ যেমন ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ ইত্যাদির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
একটি সুস্থ, স্বাস্থ্যকর, কর্মীবান্ধব কর্মস্থল নির্মাণ এখন সময়ের দাবি। সরকারি এবং বেসরকারি পর্যায়ে আইন প্রণয়ন, নীতিনির্ধারণ ও বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন জরুরি। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের একটি সাম্প্রতিক নির্দেশিকা অনুযায়ী তিনটি ধাপে এ কাজগুলো করতে হবে। ১. কাজের সঙ্গে সম্পর্কিত মানসিক রোগের ঝুঁকির কারণগুলো শনাক্তকরণ। ২. কর্মীদের শক্তি বৃদ্ধিকরণ। ৩. কাজের ইতিবাচক দিকের উন্নয়ন সাধন।
স্বাস্থ্য সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা রাখা কর্মস্থলের সবার জন্য জরুরি। আর সেটা হলো- শারীরিক, মানসিক ও সামাজিকভাবে ভালো থাকাকেই স্বাস্থ্য বা সুস্থতা বলে। কেবল রোগের অনুপস্থিতিই স্বাস্থ্য নয়। আমাদের সমাজে মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টিকে অনেক কর্মক্ষেত্রেই দূরে সরিয়ে রাখা হয়, যতক্ষণ পর্যন্ত না কোন দুর্ঘটনা ঘটে। একটু ভেবে দেখি তো, যখন আমরা হঠাৎ গুরুতর শারীরিক রোগে আক্রান্ত হই, তখন কি আমরা স্বাভাবিকভাবে কাজকর্ম করতে পারি? গুরুতর মানসিক রোগের ক্ষেত্রেও তাই। এ ব্যাপারে যারা সচেতন, সমস্যায় পড়লে দেরি না করে তারা বিশেষজ্ঞের কাছে যান। এক্ষেত্রে অনেকেরই ভুল ধারণা, যারা মানসিক স্বাস্থ্য সেবা নিচ্ছেন, তাদের কাছ থেকে ভালো কাজ আশা করা যায় না। অথচ একজন ডায়াবেটিক রোগী যেমন চিকিৎসার মধ্যে থেকে কাজ করতে পারেন, তেমনি একজন মানসিক সমস্যাগ্রস্থ ব্যক্তিও মনোবৈজ্ঞানিক চিকিৎসার মধ্যে থেকে অন্য সবার মতোই কাজ করে যেতে সক্ষম। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে তিনি একজন সুস্থ ব্যক্তির চাইতেও বেশি দক্ষতা দেখাতে পারেন। অনেকে মানসিক স্বাস্থ্য সেবা নিয়ে পুরোপুরি সুস্থও হয়ে ওঠেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ব্যক্তির মানসিক অসুস্থতার দায়ভার কার? ব্যক্তির নিজের, না প্রতিষ্ঠানের? উন্নত বিশ্বের শ্রম ব্যবস্থাপনায় মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়।
একজন ব্যক্তি যদি তার পেশাকে সঠিক সিদ্ধােেন্তর মাধ্যমে বাছাই করেন, তবে মানসিক চাপ মোকাবেলা করা তার জন্য সহজ হয়। সেক্ষেত্রেও কর্মক্ষেত্রের পরিবেশ গুরুত্বপূর্ণ। কাজে মানসিক প্রশান্তি অনেকটা নির্ভর করে সহকর্মীদের সাথে ইতিবাচক সম্পর্ক, তত্ত্বাবধায়ক বা নিকট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সাথে সুসম্পর্ক, প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা, সুযোগের ইতিবাচক ব্যবহারের মাধ্যমে নিজের দক্ষতার বিকাশ এবং সর্বোপরি কর্মস্থলে নিজের প্রয়োজনীয়তার ব্যাপারে সচেতন থাকার ওপর।
কর্মক্ষেত্রে বেশ কিছু কারণে ব্যক্তির মধ্যে নিরানন্দ দেখা দিতে পারে, সরাসরি যার প্রভাব পড়ে ওই প্রতিষ্ঠানের উৎপাদনশীলতায়। যেমন- অদক্ষ বা নিষ্ক্রিয় ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, অতিরিক্ত রাগী বস, প্রতিষ্ঠানের বেতন অনিয়মিত হওয়া, অতিরিক্ত কর্মঘণ্টা অথবা কাজের চাপ, দক্ষতা প্রকাশের সুযোগ না পাওয়া, টিমের মাঝে সুসম্পর্ক বা তালমিল বজায় না থাকা।
একটি ভাল কর্মক্ষেত্রে একজন ব্যক্তি নিজেকে ইতিবাচক মূল্যায়ন করতে পারবে, সহযোগিতামূলক পরিবেশ পাবে, একে অন্যকে সম্মান দেখাবে, তবেই কর্মক্ষেত্র পূর্ণতা পাবে। এর সুফল পাবে পুরো প্রতিষ্ঠান। হতে পারে একজন কর্মী কারণে-অকারণে অফিসে না আসার বাহানা করছেন বা প্রায়ই দেরি করে আসছেন। সেক্ষেত্রে সহসাই কর্মীকে দোষারোপ না করে বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে, কী কী কারণে এমনটি ঘটতে পারে। সবাই কি অফিস এটিকেট বা আচরণবিধি মানছেন! না-কি শ্রেণি বৈষম্য প্রকট আকার নিয়েছে! কর্মীরা যখন স্বতঃস্ফূর্তভাবে অফিস করবেন, তখনই প্রতিষ্ঠানের উত্তোরোত্তর উন্নতি হতে থাকবে। বোঝা যাবে, প্রতিষ্ঠানের প্রত্যেক বিভাগ সচল আছে। একজন কর্মী কীভাবে ভাবছেন, কী আচরণ করছেন, তার সবটুকুই প্রতিষ্ঠানের উন্নতিতে প্রভাব ফেলে। কর্মীর মানসিক স্বাস্থ্যের উপর গুরুত্বারোপ করা তাই প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব।
কর্মক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্য ইস্যুতে সবার আগে আসে কর্মক্ষেত্রে বুলিংয়ের বিষয়টি। বুলিং বলতে বোঝায় কাউকে কথা দিয়ে, শারীরিক নির্যাতন বা অন্য কোন কাজের মাধ্যমে মানসিকভাবে অথবা সামাজিকভাবে হেয় করা; তার কাছ থেকে অন্যায় সুবিধা আদায় বা অবমূল্যায়ন করা। হতে পারে এটা মালিক পক্ষ করছেন বা ঊর্ধ্বতন কেউ অথবা কয়েকজন মিলে। বুলিংকারী যেভাবে বুলিং করে-আমরা দেখতে পাবো বুলিংকারী একাধিকবার বাজে মন্তব্য করছে বা মজা করছে, হতে পারে কারো কাজ, পরিবার, আর্থ-সামাজিক অবস্থা, সংস্কৃতি, এমনকি ধর্মীয় ভাবধারা নিয়েও; অথবা কারো ক্ষতি করছে বা করার চেষ্টায় রত; খারাপ মন্তব্য বা প্রস্তাব, যা যৌন নির্যাতনের ইঙ্গিত দেয় অথবা ব্যক্তিকে অপ্রস্তুত পরিস্থিতির মধ্যে ফেলে; মনস্তাত্ত্বিক খেলায় মাতা বা দল পাকানো কোন ব্যক্তিকে ক্ষতি করা বা লজ্জা দেয়ার উদ্দেশ্যে; এমন কথা বলা বা হুমকি ও ভয়ভীতি দেখানো যাতে নির্যাতিত ব্যক্তি কর্মস্থলে নিজেকে তুচ্ছ বা অপ্রয়োজনীয় মনে করে; জেনে বুঝে এমন সব কাজ দেওয়া, যা সম্পন্ন করতে পারবেন না বা সম্পন্ন করার ব্যবস্থা নেই; বারবার কাজের রুটিন ও পরিকল্পনা ইচ্ছাকৃতভাবে পরিবর্তন করা; জেনেশুনে কাজের তথ্য নিজের কাছে রাখা, যাতে তিনি ঠিকমত কাজটি শেষ করতে না পারেন; সবসময় তাড়া দেয়া এবং অন্যের কাজ ও পদোন্নতির বিষয়ে অযাচিত হস্তক্ষেপ করা; অপমানজনক দীক্ষা দেওয়া ইত্যাদি।
বুলিংয়ের শিকার ব্যক্তির মধ্যে যে সব সমস্যা দেখা দেয়, তা হলো- কাজের গতি কমে যাওয়া, ব্যর্থতার পরিমাণ বেড়ে যাওয়া, অতিরিক্ত ভয় পাওয়া, বারবার ভুল করা, বিষণ্ন থাকা, কাজে অনীহা, সম্পর্কে টানাপোড়েন তৈরি হওয়া, নিজের যোগ্যতা নিয়ে অবিশ্বাস তৈরি হওয়া, প্রতিষ্ঠানের বা মালিক পক্ষের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলা, মাথা ব্যথা, পিঠ ব্যথা, ঘুমের সমস্যা হওয়া ইত্যাদি।
এসব বিষয়ে তাই প্রয়োজন সচেতনতা বৃদ্ধি। তাহলে প্রতিষ্ঠান ও কর্মী উভয়েই লাভবান হবে। কর্মীরা যথাযথভাবে মানসিক চাপ মোকাবেলা করে নিজের ও অন্যের মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি খেয়াল রাখতে পারবেন। উন্নত বিশ্বের শ্রম ব্যবস্থাপনায় মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়। এক্ষেত্রে আমরা যে কয়টি বিষয় বিবেচনায় নিতে পারি, তা হলো-
১.কর্মস্থলে সুস্থ, স্বাভাবিক পরিবেশ বজায় রাখা। প্রকৃতিগতভাবেই সবার বিশ্রামের প্রয়োজন। কর্মীর বিশ্রাম থেকে শুরুত্ব করে তার জীবনযাপনের মানের প্রতিও লক্ষ্য রাখতে হবে।
২. ব্যক্তিগত গোপনীয়তার প্রতি লক্ষ্য রাখা এবং নিয়মিত ভালো কাজের পুরস্কার দেওয়া। একজন তত্ত্বাবধায়ক তার অধীনস্থের অনেক ব্যক্তিগত গোপন তথ্য জানতে পারেন। পেশাগত নীতি মেনে সেসব তাকে গোপন রাখতে হবে। তাহলে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ বাড়বে। একজনের কাজের পুরস্কার যেন অন্যজন না নিয়ে যান, সে বিষয়েও খেয়াল রাখতে হবে। সুষ্ঠু বিবেচনার মাধ্যমে কাজের পুরস্কার দিতে হবে। কাজের ফলাফল খারাপ হলে কর্মীকে সরাসরি দোষারোপ না করে সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে উপযুক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে।
৩. মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা দেয়া। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দেয়া স্বাস্থ্যের সংজ্ঞা সংবলিত পোস্টার অফিসের ভেতরে দেয়ালে টানিয়ে রাখা যেতে পারে, যাতে করে অফিসের সবাই প্রতিনিয়ত এ ব্যাপারে সজাগ থাকতে পারেন। কারণ মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে অজ্ঞতা যে কোন দুর্যোগের চেয়ে কম ভয়াবহ না।
৪. মনোবিজ্ঞানীদের মাধ্যমে নিয়মিত কর্মশালার আয়োজন করা। একজন ব্যক্তি বিভিন্ন কর্মশালার মাধ্যমে মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ, রাগ নিয়ন্ত্রণ, আত্মবিশ্বাস অর্জন, বুলিং প্রতিরোধ ছাড়াও মানসিক সমস্যার প্রাথমিক লক্ষণ সম্পর্কে পরিস্কার ধারণা পাবেন এবং সমস্যায় পড়লে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে পারবেন। সর্বোপরি, কাজের প্রতি কর্মীদের মনোযোগ বৃদ্ধি পাবে ও মনোবল বাড়বে। কাজের পরিবেশ সুন্দর হবে, সহিংসতা, বৈষম্য ইত্যাদি কমে আসবে এবং প্রতিষ্ঠান সমৃদ্ধশালী হবে।
সুতরাং রূপকল্প ২০২১, ২০৩১ সালের মধ্যে মধ্য আয়ের দেশ, ২০৪১ সালের মধ্যে উচ্চ আয়ের দেশে পরিণত হওয়া এবং এসডিজি অর্জনে সফল হতে হলে আমাদের শ্রম ও মেধার উৎপাদনশীলতা সর্বোচ্চ প্রর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে। সেক্ষেত্রে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য নীতিমালা প্রণয়ন করা বিশেষ প্রয়োজন। এতদসঙ্গে মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ সংখ্যা বৃদ্ধিসহ সকল উপজেলা, জেলা এবং চিকিৎসা মহাবিদ্যালয় হাসপাতালে মানসিক রোগীদের শয্যা যুক্তসহ মোট শয্যা সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে।
বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবসের পটভূমিতে আমরা সুপারিশ করছি যে, নানাবিধ নির্যাতনের শিকার রোহিঙ্গা শরনার্থীদেরকে মানসিক সহায়তা দেয়া প্রয়োজন বলে আমরা প্রয়োজন মনে করি।
-তপন কুমার নাথ, রাষ্ট্র মনোবিজ্ঞানী
আমরা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।