ডেস্ক নিউজ:
মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টা অং সান সু চিকে মিয়ানমারের ক্ষমতাধর ব্যক্তি বলে মনে করা হলেও তিনি আসলে সেখানকার সামরিক বাহিনীর কাছে ‘অসহায়’। ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্স তাদের এক প্রতিবেদনে ৬ জন কূটনীতিকের বরাত দিয়ে এ কথা জানিয়েছে। ওই কূটনীতিকরা দাবি করেছেন, সু চি রোহিঙ্গাদের প্রতি সহানুভূতিশীল, আর রাখাইন হত্যাকাণ্ডের মূল ক্রীড়ানক সেনাপ্রধান মিন অং। রোহিঙ্গা সংকটে সু চির হৃদয় ভেঙে পড়েছে বলে তার একজন উপদেষ্টাও রয়টার্সের কাছে দাবি করেছেন। তবে মার্কিন সংবাদমাধ্যম ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, রোহিঙ্গাদের প্রশ্নে তার ভীতি রয়েছে। তাদের অনুসন্ধান বলছে, সু চি সরকারে এসে আরও বেশি করে সেনাক্ষমতার হাতে বন্দি হয়ে পড়েছেন। তবে ‘এশিয়ার ম্যান্ডেলা’ খ্যাত এই নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ীর ক্ষমতাহীনতাকে সেনাবাহিনী ও তার মধ্যকার স্বার্থগত বন্ধন বলে উল্লেখ করা হয়েছে ওই প্রতিবেদনে।
নিউ ইয়র্ক টাইমস নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ৬ জন রাষ্ট্রদূত ও ত্রাণ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে। ওই কূটনীতিকদের উদ্ধৃত করে প্রতিবেদনে বলা হয়, জাতিগত দ্বন্দ্ব ও অর্থনৈতিক টানাপোড়েন থাকলেও মিয়ানমারকে সফল রাষ্ট্র হিসেবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করা হয়। ২০১৫ সালে শান্তিতে নোবেল জয়ী অং সান সু চি দায়িত্ব নেওয়ার পর ভাবা হয়েছিলো দেশটিতে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হতে যাচ্ছে। কিন্তু রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টা হিসেবে সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর ব্যক্তিত্ব মনে হলেও সামরিক বাহিনীর ক্ষমতার কাছে তিনি দুর্বলই থাকেন। প্রায় ৫০ বছর ধরে শাসন করা সামরিক বাহিনী ঠিকই তাদের ক্ষমতা ধরে রেখেছে।
বৃহস্পতিবার রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে দেওয়া এক ভাষণে সু চি বলেছেন, তিনি শান্তি ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টা ব্যক্তিগতভাবে দেখবেন। তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, বাংলাদেশে পালিয়ে যাওয়াদের ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করবেন তিনি। গত মাসে কূটনীতিকদের সামনে দেওয়া ভাষনের মতো এবারও তিনি সামরিক বাহিনীর নিধনযজ্ঞ নিয়ে কিছু বলেননি। হত্যা ও ধর্ষণের অভিযোগ এড়িয়ে গেছেন। কূটনীতিকদের উদ্ধৃত করে নিউ ইয়র্ক টাইমস জানায়, অং সান সু চি গ্রামবাসীদের হত্যা করার নির্দেশ দেননি। এমন সিদ্ধান্ত এসেছে দেশটির সেনাপ্রধান সিনিয়র জেনারেল মি অং হ্লায়াংয়ের কাছ থেকে।
কূটনীতিকরা দাবি করেন, অং সান সু চি ব্যক্তিগতভাবে রোহিঙ্গাদের জন্য সহানুভূতি প্রকাশ করলেও জনসমক্ষে বলতে পারেন না। কারণ বৌদ্ধদের মধ্যে রোহিঙ্গাদের জন্য বিদ্বেষ রয়েছে। তবে বিগত বছরগুলোতে তিনি তাদের রোহিঙ্গা হিসেবে স্বীকার করে নেননি। তাদের বাংলাদেশের অবৈধ অভিবাসী বলে মন্তব্য করেছেন। সু চি’র একজন উপদেষ্টাকে উদ্ধৃত করে রয়টার্স জানিয়েছে, রোহিঙ্গাদের বিপন্নতায় মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টা অং সান সু চি ‘ভেঙে পড়েছেন’। তবে সেই উপদেষ্টা নিজের নাম প্রকাশে অনিচ্ছা জানিয়েছেন। সু চির ওই উপদেষ্টা জানিয়েছেন, এই সংকট উত্তোরণে রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টা যথেষ্ট রকমের প্রত্যয়ী। তবে তিনি চান না পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হোক। সতর্কতার সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে চান। তিনি বলেছেন, ‘পরিস্থিতি যা দাঁড়িয়েছে, তা দেখে তিনি ভেঙে পড়েছেন। তিনি এ নিয়ে ভীষণ উদ্বিগ্ন। আমি জানি, তার এই উদ্বেগের কথা প্রকাশ্যে আসেনি। তবে আমি জানি, তিনি নিশ্চয় পরিস্থিতির উত্তোরণ ঘটাবেন।’ তবে ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদন বলছে ভিন্ন কথা।
সূত্রকে উদ্ধৃত করে সংবাদমাধ্যমটি জানায় শান্তিতে নোবেলজয়ী, গণতন্ত্রের পক্ষের অ্যাক্টিভিস্ট এবং মিয়ানমারের প্রধান বেসামরিক নেতা সু চি গত বছর একজন জ্যেষ্ঠ কূটনীতিকের সঙ্গে দেখা করেন। ওই কূটনীতিককে তিনি এক সতর্কীকরণমূলক আখ্যান শোনান। মুসলিমরা ইন্দোনেশিয়ায় কয়েক শতক ধরে সংখ্যালঘু হিসেবে থাকার পর কিভাবে সেদেশে আধিপত্য বিস্তার করেছে তা মনে করিয়ে দেন তিনি। সু চি বলেন, তার দেশ এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হোক তা তিনি চান না। তিনি আরও বলেন, মিয়ানমারে মুসলিমরা মোট জনসংখ্যার ৪ শতাংশ হলেও অনেক এলাকায় তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে।
সু চি’র সাবেক মিত্র যাদের বেশিরভাগই ১৯৮০ এর দশকের গণতন্ত্রের আন্দোলনে ছিলেন তাদের কেউ কেউ এখন সু চিকে নিয়ে ভাবতে গিয়ে অবাক হচ্ছেন। তাদের মনে সংশয় তৈরি হয়েছে। তারা ভাবছেন, সেনাবাহিনীর সঙ্গে ক্ষমতা ভাগাভাগির চুক্তি করে সু চি বন্দির মতো হয়ে পড়েছেন কিনা যেমনটা তিনি তার দীর্ঘদিনের গৃহবন্দিত্বের সময় ছিলেন।
ডি ফ্যাক্টো সরকারে অং সান সু চি আসলে ক্ষমতাই বা কতটুকু? অং সান সু চি’র সরকারি পদবী হচ্ছে ‘রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টা’। মন্ত্রিসভা এবং তার দলের অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেন তিনি। পররাষ্ট্র মন্ত্রীর দায়িত্বেও আছেন সু চি। দেশটির প্রেসিডেন্টকে সু চি’র কাছে জবাবদিহি করতে হয়। কিন্তু তারপরও সাংবিধানিকভাবে সেনাক্ষমতার কাছে তিনি বন্দি।
মিয়ানমারের সংবিধান অনুযায়ী দেশটির পার্লামেন্টের এক চতুর্থাংশ আসন সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়। স্বরাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা এবং সীমান্তসহ গুরুত্বপূর্ণ তিনটি মন্ত্রণালয়ে নিয়ন্ত্রণ অব্যাহত রেখেছে সেনাবাহিনী। এর অর্থ হচ্ছে দেশটির পুলিশের ওপরও নিয়ন্ত্রণ রয়েছে সেনাবাহিনীর। শক্তিশালী জাতীয় প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা পরিষদের ১১টি আসনের মধ্যে ছয়টি আসনেও রয়েছেন সেনাবাহিনী মনোনীত ব্যক্তিরা। গণতান্ত্রিক সরকার বাতিলের ক্ষমতা রয়েছে এই পরিষদের। এছাড়া অনেক শীর্ষস্থানীয় পদ দখল করে আছেন সাবেক সামরিক কর্মকর্তারা।
বিশ্ববাসী সু চি কে মিয়ানমার সরকারের অন্তর্গত একজন মানুষ হিসেবেই দেখে না, দেখে শান্তির পক্ষের একজন অ্যাকটিভিস্টি আকারে। তাই রোহিঙ্গা প্রশ্নে তার নীরবতা নিয়ে বার বারই প্রশ্ন উঠেছে, আহ্বান এসেছে সরব হওয়ার। দক্ষিণ আফ্রিকার বিবেকের বাতিঘর হিসেবে স্বীকৃত ধর্মযাজক ও মানবাধিকার আন্দোলনের কর্মী ডেসমন্ড টুটু সম্প্রতি রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে সরব হতে অং সান সু চি’র প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।গত সেপ্টেম্বরে অং সান সু চিকে উদ্দেশ্য করে সামাজিক মাধ্যমে পোস্টকৃত এক খোলা চিঠিতে টুটু প্রশ্ন করেন,নীরবতার মধ্য দিয়ে সু চি তার দেশের উচ্চ পদে আসীন হওয়ার রাজনৈতিক মূল্য চুকাচ্ছেন কিনা। যদি তাই হয়,তবে সে মূল্য খুব চড়া বলে সু চিকে সতর্ক করেন তিনি। তবে বিপুল পরিমাণ আন্তর্জাতিক সমালোচনা এবং উদ্বেগ প্রকাশের পরও সু চি তার অবস্থান থেকে সরে আসেননি।
ইয়ানগুনভিত্তিক একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের পরিচালক এবং সাবেক রাজনৈতিক বন্দি খিন জ উয়িন মনে করেন, অদূর ভবিষ্যতে দেশটি (মিয়ানমার) পূর্ণ গণতান্ত্রিক দেশে পরিণত হতে পারবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। তিনি বলেন, ‘তিনি নিজেকে সেনাবাহিনীর বন্ধনে বন্দি করে ফেলছেন কারণ দুই পক্ষই বোঝে তাদেরকে একসঙ্গে চলতে হবে। তার (সু চির) অতীত ও বর্তমান সবক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর ওপর তার প্রভাবের মাত্রা শূন্য।’
আমরা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।