আলমগীর মাহমুদ :
উখিয়া কলেজ থেকে ফিরতি যাত্রা।গন্তব্য কক্সবাজার। সাথে গণিতের পণ্ডিত সহকর্মী মৃদুল শর্মা।
কক্সবাজারগামী ষ্পেশাল সার্ভিসে আরোহন করতেই, তরকাটা জোয়ান পাশের সীটে ব্যাগ রেখে তর্জনীতে ফেইসবুকের রশি টানা টানা কর্মে ব্যস্ত।মৃদুল মৃদু হেসে.. বসা যাবে ভাই? জোয়ান ইংরেজী শব্দ কইল “অব কোর্স” হোয়াইই নট?
বেশ উচ্ছল ভাষাতেই মৃদুল বসেই জোয়ানের সাথে সহজাত ভঙ্গিমায় আলাপী বনে।আমি নিকটতম দুরত্বে পাশের সীটে।
আলাপনে জোয়ানকে বলতে শুনলাম কক্সবাজারের মানুষ রোয়াইঙ্গাদের ধর্ষন করছে।সর্বহারা রোয়াইঙ্গাদের গরু,ছাগল কেড়ে নিয়ে যাচ্ছে, তেরপল দিয়ে ছোট বাবুই পাখির বাসার মত পি,এফ পাহাড়ের জমি এক, দুইহাজার করে মাস্তান ট্যাক্স দিলেই বাঁধতে দিচ্ছে—‘ভাই মগের মুল্লুকে গুলির ভয়,এপারে মুসলমান মগদের হাইওয়ানী আচরন।কি দেখে গেলাম!
মৃদুল ঝাঁজালো মেজাজে কইতেই রইল, ‘হোটেলে একবেলা ভাত খাওয়াইলেই কি মেহমানের মেহমানদারী হয়ে যায়? আপনি একবেলা ত্রান নিয়ে চট্টগ্রাম শহর থেকে এসে এক দুইটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা দেখে কক্সবাজারবাসীকে এমন মন্তব্য কি শোভা পায়!
জোয়ান লিংরোড নেমে পড়লে মৃদুল আক্ষেপে কয়,’মুখে কতক্ষনই জিতা যায়,এইসব ঘটনাতো বর্ডার ক্রস করতেই অহরহ।সুন্দরী মহিলাটারে ছেকে ধরেছে দালাল,লম্পটের দল।পত্রিকায় সে করুন কাহিনী। রোয়াইঙ্গা মায়ের সুন্দরী মেয়েকে নিয়ে বিপাকে পড়ার করুন উপখ্যান।
স্বাধীন সার্বভৌম,সমৃদ্ধশালী রাষ্ট্র ছিল আরাকান।বার্মার রাজা ভোদপায়া আরাকান আক্রমন করে আরাকানকে বার্মার অধিকারভুক্ত করে।আরাকানের বিরাট জনগোষ্ঠী ইসলামের অনুসারী।এদের মধ্যে কামানচি,থাম্বইক্য,জেরবাদী,রোয়াইঙ্গা প্রভৃতি নামে ছিল পরিচয়।তাদের মধ্যে রোয়াইঙ্গা ছিল বৃহত্তম জনগোষ্ঠী।
স্বাধীন আরাকানের বৃহত্তম এবং সমৃদ্ধ শালী জাত এই রোয়াইঙ্গা। আজকের ইউরোপীয় নাগরিকদের মতো ছিল তাঁদের সম্মানবোধ।ইউরোপের ন্যায় সেকালের কামাইয়ের আকাঙ্কিত এলাকা ছিল এই ‘রোসাঙ্গ’।যাদের পূর্বপূরুষের বাড়ি ঘরে আমাদের জনপদের পৃর্বপুরুষেরা কামাই করতে, সওদায় যেত। তাদের, সে ভুমিপুত্ররাই আজ শাহপরীর দ্বীপ থেকে কুতুপালং তুমব্রুর খোলা আকাশের নিচে ‘রিফুইজি’। সবাইর কাছে দুর..দুর।ছেই..ছেই।বার্মাইয়া..!
এই রোসাঙ্গ রাজ্য এতই সমৃদ্ধ ছিল যার প্রভাব চট্টগ্রামের গ্রাম্য ছড়া, প্রবাদ প্রবচনে..
“ভোয়াং ভোয়াং ভোয়াং
তর বাপ গিয়ে রোয়াং।
রোয়াং অর টিঁয়া বরুনা পান
তর মা’রে কইছদে ন কাঁন্দে পাঁন।
ছেলে ছড়ার মাধ্যমে তার সাথী বন্ধুকে বলছে,তোমার পিতা রোসাঙ্গ গিয়েছে অর্থ উপার্জনের জন্য।ছেলেটা আরো জানাচ্ছে রোসাঙ্গ এর টাকা বরুনার সমান।বরুনা হচ্ছে রান্নার ডেকচির উপরব্যবহ্রত মাটির তৈরি ঢাকনা।এই কথায় রোসাঙ্গ এর টাকার মান খুবিই বড়।অতএব ছেলেটির মায়ের কান্নাকাটি করার কোন প্রয়োজন নেই,কারন এক্টি রোসাঙ্গ থেকে কামাই করে আসলেই সমৃদ্ধিতে কাটবে আগামীদিন।
এই ছড়ায় ঐতিহাসিক তথ্য আছে।এককালে চট্টগ্রাম স্বাধীন আরাকান রাজ্যেরই অংশ ছিল।আরাকানে মগ এবং মুসলমানদের মধ্যে অতীত ইতিহাসে সম্প্রতির কোন অভাব ছিল না।ম্রোহং ছিল রাজধানী শহর। চট্টগ্রামের ভাষায় এই ম্রোহং বিকৃত হয়ে উচ্চারিত হয়েছে ‘রোয়াং’।
রোসাঙ্গকে নিয়ে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানে প্রেম,বিরহ, রোমান্টিকতা, সমৃদ্ধির বর্ণনায় আছে অগুনতি গানের সমাহার।যাতে আঁকা আছে আরাকানের সমাজচিত্রের জলছাপ।
“অ সাম(স্বাম) দিন রেঙ্গুন ন যাই অ
কঁনে হাইব রেঙ্গুনের কামাই।”
কোন স্বামীর বউ চায় না তার স্বামী ইনকাম না করুক,ঘরে বসে থাকুক।প্রাচীন সময়ে যে স্বামী রোসাঙ্গ কামাই করতে যেত, সে আর ফিরে আসত না আপণজনের দ্বারে।রোয়াইঙ্গা ললনার ভুবনমোহিনী দরদে মজে সংসারী বনত,ভুলত অতীত।ফিরত না দেশে। আপন হারানোর ভয়ে এই গানে রোসাঙ্গ কামাই করতে যাবার বাধার কৌশল গুলো গানে গানে প্রিয়জনকে কইত–
স্বামীকে উদ্দেশ্য করে বউয়ের প্রাণ মাতানো নিবেদন।অ..স্বামী!অ..আমার প্রাণধন!
“অসময়ে রেঙ্গুন যেও না
রেঙ্গুনের কামাই কে খাবে?খাবার মানুষ নাই! যাদের এমন মোহনী শক্তি তারাই আজ পথে ঘাটে।
আরাকান রাজসভায় বাংলা সাহিত্যের কাছে পৃথিবী যুগ যুগ ঋনী রইবে।মহাকবি আলাওল ছিল আরাকান রাজসভার প্রধানের আসনে।পদ্মাবতী কাব্য,সয়ফুলমুলক,বদিউজ্জমান,সেকান্দর নামা।দৌলতকাজীর ‘সতীময়না ‘কোরেশী মাগন্ঠাকুরের ‘চন্দ্রাবতী কাব্য’।নশরুল্লাহ খন্দকারের ‘জঙ্গনামা ”মুছার সওয়াল’শরীয়তনামা’।ইসমাইল সাকেরের”বিলকিসনামা” এই আরাকান রাজসভায় রচিত ফসল।
পৃথিবীর ভয়াবহ জিনিস অভিশাপ। শাহসুজা উওরাধিকার যোদ্ধে ভাই আওরঙ্গজেবের সাথে দ্বন্দ্বে শেষজীবন মক্কায় কাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে আরাকানে আরাকান রাজ সান্দা থু ধর্ম্মার আচরনে যে ট্রেজেডিময় উপখ্যানে শাহসুজার পরিবারকে হত্যা করা হয়েছিল যদি বলি শাহসুজার পরিবারের অভিশাপেই বিলীন আরাকান।খন্ডবিখন্ড রোহিঙ্গা।মনে হয় ভুল বলা হবে না।কারন,
“রাজার দোষে রাজ্য নষ্ট
প্রজা কষ্ট পায়।
সান্দু থু ধর্ম্মার দোষে আরাকান নষ্ট
রোয়াইঙ্গাদের সুখ চলে যায়”।
পলাশী যুদ্ধ। সিরাজদৌল্লার মসনদ হারানোর পর মিরজাফরের পুত্র মিরনের হাতে সিরাজের স্ত্রী লুৎফা,মা,খালা ঘষেটি বেগম বন্দী হয়।মিরন সিরাজের মা’ এবং খালাকে পানিতে চুবিয়ে হত্যার কালে খালা ঘষেটি বেগম আল্লাহর কাছে ডাক দিয়ে অভিশাপ দেয় অ..আল্লাহ এই জালিমকে বজ্রঘাতে মৃত্যু দিও’ ঠিক ঠিকই মিরনের মৃত্যু হয়েছিল বজ্রাঘাতে।
যারা কক্সবাজারবাসীকে কলংকিত করেছো,ইতিহাস থেকে শিক্ষা নাও, বাবার জমি যেমন উত্তরাধিকারী সূত্রে বর্তায়,বাবার অর্জিত অভিশাপ ও বংশপরম্পরায় প্রবাহমান রয়।বংশ নির্মূল হবে,রোয়াইঙ্গা বনবে একই ঘটনায় তারাও হবে আবর্তিত।তারপরও যদি বিশ্বাসে চিড় ধরে রবিঠাকুরের সেই সংগীতটি বাজিয়েই রেখো. ..
নিরজনে বসি
প্রভু তুমি খেলিছ বিশ্বলয়ে..
আপণ-অ-মনে।
লেখক: উখিয়া কলেজের সমাজবিজ্ঞানের শিক্ষক।
alamgir83cox
আমরা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।