গিয়াস উদ্দিন
বর্তমান যুগকে বলা হচ্ছে Digital যুগ। আর পুরো দুনিয়াটাকে বলা হচ্ছে Global Village বা বৈশ্বিক গ্রাম। বিশ্বায়নের এই যুগে প্রযুক্তি মানুষের জীবন যাত্রা ও যোগাযোগ ব্যবস্থাকে যেমন সহজ ও বিলাসী করে তুলেছে ঠিক তেমনি কিছু যন্ত্রনার কারণও সৃষ্টি করেছে। প্রযুক্তির এই সুবিধাকে কাযে লাগিয়ে ইন্টারনেট ও তা ব্যবহারের উপকরণের সহজলভ্যতায় কিশোর কিশোরীরা তাদের কৌতূহলী মনোভাব নিয়ে জড়িয়ে পড়ছে নানারকম অনৈতিক ও লজ্জাহীন কাজে। তাদের কাছে এখন লজ্জা শব্দটা শুধুমাত্র একটা কাগজের শব্দতে পরিণত হওয়ার উপক্রম হয়েছে। তারা তা বুঝতেও চায় না। বাংলাদেশ তথা সারা বিশ্বের সকল জাতি, সমাজ ও দেশের শিশু-কিশোর এবং যুবকদের মাঝে দেখা যাচ্ছে এই চারিত্রিক অবক্ষয়। মুসলিম জাতি আজ গতানুগতিকতা, আদর্শহীনতা, পাশ্চাত্যের অন্ধঅনুকরণ, অশ্লীলতা, বেহায়াপনা ও অপসংস্কৃতির সয়লাবে ভেসে যাচ্ছে। অথচ এই কিশোর-কিশোরী, যুবক-যুবতীরাই হবে অনাগত দিনে দেশের প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, সচিব, ডিসি, ভিসি, ইমাম, মুফতী, আলেম, গৃহকর্ত্রী, সুশিক্ষিত মা, হাফেয, ক্বারী ইত্যাদি দেশ পরিচালনায় সকল দিক ও বিভাগের কর্ণধার। তাদের চারিত্রিক অবক্ষয় হলে দেশ ও জাতি ডুবে যাবে অধঃপতনের অতল তলে। সমাজে নেমে আসবে চরম অশান্তি ও অনাচার। দাউ দাউ করে জ্বলে উঠবে দুর্নীতির বহ্নিশিখা। আদর্শ ও চরিত্রহীন কিশোর-কিশোরী হালবিহীন নৌকার মত। যেমন বর্তমান প্রযুক্তিগত সহজলভ্যতার সুযোগে তারা মাদক গ্রহণ, ব্লু হোয়েল নামক গেম খেলে আত্মহত্যা পর্যন্ত করতে পিছপা হচ্ছে না। তাই তাদেরকে তা থেকে ফেরৎ আনতে অভিভাবক ও সর্বস্তরের সকল শিক্ষিত ও সচেতন মানুষকে দ্রুত এগিয়ে আসতে হবে। অন্যতায় এ জাতির ভবিষ্যৎ কি হবে তা অনুমান করা কঠিন। কিন্তু কেন? তার কিছু কারণ নিম্নরূপ হতে পারে বলে আমার ধারণা।
তাদের নৈতিক অবক্ষয়ের অনেকগুলো কারণের মধ্যে নিম্নবর্ণিত কারণগুলো বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ বলে আমার মনে হয়েছে। যেমন- ১. পারিবারিক এবং প্রাতিষ্ঠানিভাবে সুশিক্ষার অভাব। ২. পিতা-মাতা সচেতনতার সাথে যথাযথভাবে তাদের দায়িত্ব পালন না করা। ৩. শিক্ষক-শিক্ষিকাগণের সুশিক্ষাদানে উদাসীন মনোভাব। ৪. পাশ্চাত্য, অশ্লীল, অনৈসলামিক বা নোংরা সংস্কৃতির ব্যাপকতা ও সহজলভ্যতা। ৬. সমাজ-সেবামূলক কাজে কিশোর-কিশোরীদের উদ্বুদ্ধ না করা। ৭. বালক-বালিকাদের সহ-শিক্ষার কুফল। ৮. আলেম-ওলামাদের দায়িত্ব বা কর্মবিমুখতা। ৯. পারিবারিকভাবে ধর্মীয় আলোচনার ব্যবস্থা না করা এবং বেয়াদবিমূলক আচরণ করলে তা শুধরে না দেওয়া, ১০. নেশাজাতীয় দ্রব্যের সহজপ্রাপ্যতা। ১১. অসৎ ও চরিত্রহীন বন্ধু বান্ধবীদের সাহচর্য। ১২. ১৩. অশ্লীলতার অবলম্বন ও প্রসারে দায়িত্বশীলদের মূর্খতা বা জেনেও না জানার ভাব ধরে চলা, ১৪. ওলামা-মাশায়েখ ও ধর্মীয় শিক্ষকগণের আধুনিক বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, সুস্থ সংস্কৃতি ও সঠিক ইসলামী আক্বীদা বিমুখতা। প্রভৃতি কারণগুলোর জন্য আজ আমাদের সমাজের এই করুণ অবস্থা। অবস্থা এমন হয়েছে যেন এসব অপরাধীদের বারণ করাই আর একটা অপরাধ! অথচ, আল্লাহ মানুষকে জ্ঞান চর্চার মাধ্যমে নৈতিকতার সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছার পথও বাতলে দিয়েছেন।
তিনি চান তাঁর সুন্দরতম সৃষ্টি সুন্দরভাবে জীবনযাপন করুক। এ লক্ষ্যে পবিত্র কুরআন ও হাদীছের আলোকে সুন্দর জীবন যাপনের সার্বিক দিক-নির্দেশনা পাওয়া যায়। মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, “মহান আল্লাহ সৃষ্টিজগতের সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানুষকে আপন হাতে নিপুণভাবে সৃষ্টি করেছেন”। (ছোয়াদ ৭৫)।
বিশ্বের সমস্ত জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রকৃত ও একমাত্র উৎস স্বয়ং মহান রাববুল আলামীন। যেমন তিনি বলেন, ‘সকল জ্ঞানের উৎস একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা’ (আহক্বাফ ২৩)। তিনি বলেন, ‘আর আল্লাহর জ্ঞান সবকিছুকে পরিবেষ্টন করে আছে’ (তালাক্ব ১২)। কিন্তু আমাদের দেশে রাষ্ট্রীয় বা সামাজিকভাবে সাধারণ শিক্ষার সাথে সাথে ইসলামী শিক্ষার তেমন কোন সমন্বয় নেই। তাই এ ব্যাপারে প্রকৃত দায়িত্ব পালন করতে হবে ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে। ইসলামে জ্ঞানচর্চার গুরুত্ব অপরিসীম।’ রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘জ্ঞানার্জন করা প্রত্যেক মুসলমানের উপর ফরয’ (ইবনু মাজাহ হা/২২৪; মিশকাত হা/২১৮)।তিনি অন্যত্রে বলেন, ‘যে ব্যক্তি জ্ঞানার্জনের জন্য কোন পথ অবলম্বন করে, আল্লাহ তাঁর জন্য জান্নাতের পথ সহজ করে দেন (মুসলিম, মিশকাত হা/২১২)। জ্ঞানার্জন সম্পর্কে রাসূল (ছাঃ) আরও বলেন, ‘আল্লাহ যার কল্যাণ চান, তিনি তাকে দ্বীনের জ্ঞান দান করেন’ ( বুখারী হা/১৭; মুসলিম হা/২৪৩৬; মিশকাত হা/২০০)।
তার পাশাপাশি পিতা-মাতার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হচ্ছে সন্তান-সন্ততিকে বৈষয়িক শিক্ষার সাথে সাথে ইসলামী শিক্ষায় শিক্ষিত করে প্রকৃত আদর্শবান হিসাবে গড়ে তোলা। এ জন্য ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহর নিকট তাদেরকে জবাবদিহি করতে হবে। মহান আল্লাহর বাণী, ‘হে মুমিনগণ ! তোমরা নিজেদেরকে ও স্বীয় পরিবারবর্গকে জাহান্নামের আগুন হতে বাঁচাও’ (সূরা আত্-তাহরীমঃ ৬)। নিজ পরিবার ও সন্তান-সন্ততিকে সঠিক পদ্ধতিতে সালাতের প্রশিক্ষণ দেওয়া পিতা-মাতার অন্যতম দায়িত্ব। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, ‘তোমাদের সন্তানরা যখন সাত বছর বয়সে উপনীত হবে তখন তাদেরকে সালাতের আদেশ দাও এবং যখন তারা ১০ বছর বয়সে পৌঁছবে তখন সালাতের জন্য প্রহার কর এবং তাদের শয্যা পৃথক করে দাও (আবুদাঊদ হা/৪৯৫; মিশকাত হা/৫৭২।)। রাসূল (সাঃ) অন্যত্র আরও বলেন, ‘তুমি তোমার পরিবারের জন্য উপার্জিত সম্পদ হ’তে সামর্থানুসারে ব্যয় কর। পরিবার-পরিজনকে শিষ্টাচার শিক্ষাদানের ব্যাপারে শাসন থেকে বিরত থেকো না। আর মহান আল্লাহর ব্যাপারে পরিবারের সদস্যদেরকে ভীতি প্রদর্শন কর’ (আহমাদ হা/২২১২৮; আদাবুল মুফরাদ হা/১৮; মিশকাত হা/৬,)।
সালাতের প্রশিক্ষণ যদি ছোটকাল থেকেই পায় তাহলে ঐ সন্তানদের অনৈতিক পথে হাঁটার সম্ভাবনা কম থাকে। অতএব, পিতা-মাতার দায়িত্ব হল তাদের আদরের সন্তানদেরকে কিছুদিন পর পর বা হঠাৎ রেগে গিয়ে শুধু মারপিট আর ধমক না দিয়ে আদর করে ভালো ব্যবহার ও সুন্দর আচরণ শিক্ষা দেওয়া। প্রতিটি কাজে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর আদর্শ যেমন সালাত, সিয়াম, খাওয়া, পানাহার, পোশাক পরা, চলাফেরা, ঘুমানো ইত্যাদিতে যথাযথ উত্তম শিষ্টাচার শিক্ষা দেওয়া এবং তাদের জন্য মহান আল্লাহর নিকট প্রাণখোলা দো‘আ করা। এক্ষেত্রে মহান আল্লাহর কাছে হযরত ইব্রাহিম (আঃ) এর করা দো’আ টি নিয়মিত বেশি বেশি করা যেতে পারে। “হে আমার পালনকর্তা, আমাকে সালাত কায়েমকারী করুন এবং আমার সন্তানদের মধ্যে থেকেও। হে আমাদের পালনকর্তা, এবং আমাদের দো’আ কবুল করুন” (সূরা ইব্রাহিমঃ ৪০)।তখনি আমরা আমাদের কিশোর কিশোরী তথা তরুণ প্রজন্মকে এই মরণছোবল থেকে বাঁচাতে পারব। ইন শা আল্লাহ।
[সহকারী শিক্ষক (ইংরেজী), আয়েশা ছিদ্দিকা (রাঃ) বালিকা মাদ্রাসা, বাংলাবাজার, কক্সবাজার সদর।]
আমরা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।