পীর হাবিবুর রহমান

বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান লন্ডন-নির্বাসিত তারেক রহমান তার দলের বোঝা নাকি আওয়ামী লীগের শত্রু? তারেক রহমানের লন্ডনে দেওয়া বক্তব্য এ দেশের গণমাধ্যমে প্রচার করতে উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। নিষেধাজ্ঞা না থাকলে মানুষ জানতে পারত, কতটা মানসিক বিকারগ্রস্ততা, আক্রোশ, প্রতিহিংসা থেকে তিনি প্রতিনিয়ত কথা বলছেন! তার এই ঔদ্ধত্যপূর্ণ, নিজের ওজনের বাইরে বলা কথাবার্তা ও ইতিহাস বিকৃতির নগ্ন মিথ্যাচারের কারণে উচ্চ আদালত তার বক্তব্য প্রচারে নিষেধাজ্ঞা প্রদান করেছে।

তার স্নেহময়ী জননী দেশের ব্যালট বিপ্লবে অভিষিক্ত দুবারের ও সাংবিধানিকভাবে তিনবারের প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া যে কথা বলেননি, তার পিতা ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানে নিহত প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে বীরউত্তম খেতাব নিয়ে ডেপুটি সেনাপ্রধান থেকে সেনাপ্রধান ও সামরিক শাসক হয়েও যে কথা বলেননি, তিনি সেসব কথাই বলেছেন। তিনি বলেছেন, তার পিতা দেশের প্রথম প্রেসিডেন্ট ও স্বাধীনতার ঘোষক।
জাতির মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যিনি জীবনের ১৪টি বছর কারাদণ্ড ভোগ করে দুবার ফাঁসির মঞ্চে গিয়ে দেশ ও জনগণের স্বাধীনতার প্রশ্নে আপস না করে গোটা জাতিকে এক মোহনায় মিলিত করেছিলেন গণরায় নিয়ে বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে একক নেতৃত্বে স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতার পথে মহান মুক্তিযুদ্ধের ডাক দিয়েছিলেন, সেই কথা এ দেশের মাটি ও মানুষ নয়, ইতিহাসই নয়, বিশ্ববাসীও জেনেছিল। জেনেছিল পাকিস্তানের পরাজিত শাসকগোষ্ঠীও। মুক্তিযুদ্ধে সামরিক-বেসামরিক জনযোদ্ধা থেকে দেশের সব অংশের মানুষের অংশগ্রহণ ঘটেছিল। ঘটেছিল একজনের ডাকেই, তিনি আর কেউ নন— বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ইতিহাস স্রোতস্বিনী নদীর মতো কলকল ধ্বনি তুলে সেই সত্যকেই ধারণ করে, লালন করে।

১৯৭১-এর পরাজিত বিশ্বমোড়লদের দলিল-দস্তাবেজ, নথিপত্রেও এ দেশের স্বাধীনতার মহানায়ক হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কথাই ঠাঁই পেয়েছে, আর কারও কথা আসেনি।

’৭১-এর পরাজিত পাকিস্তানি শাসকরা জাতির মহত্তম নেতা বঙ্গবন্ধুকেই নির্জন, অন্ধকার কারাগারে আটকে রেখেছিল। সামরিক আদালতে ফাঁসির রায় দিয়ে কবর খুঁড়েছিল। এই নির্মম সত্য আর কারও ভাগ্যে জোটেনি। বঙ্গবন্ধুর নামে তার ও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সুমহান মুক্তিযুদ্ধে দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী, ইপিআর, পুলিশ, রাজনৈতিক কর্মী ও সাধারণ জনগণ জীবন বাজি রেখেছিল, তাদের শক্তি ও সাহসের উৎস ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। তাদের বুকে ছিল মনোবল, হৃদয়ে ছিল বঙ্গবন্ধু ও স্বাধীনতা, আর হাতে ছিল অস্ত্র, কণ্ঠে ছিল জয় বাংলা স্লোগান, শরীরজুড়ে ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের স্বাধীনতার অদম্য শক্তি।
মুক্তিযুদ্ধে একজন সেক্টর কমান্ডার ছিলেন বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। বঙ্গবন্ধুর হয়ে তিনি কালুরঘাট থেকে ২৭ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করে দেশপ্রেমিক মুক্তিকামী মানুষকে এই মর্মে উজ্জীবিত করেছিলেন যে, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বাঙালি অফিসাররা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। সময় ও পরিস্থিতি তাকে সেই সুযোগ দিয়েছিল। তার জায়গায় প্রতিরোধযুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়া মেজর অবসরপ্রাপ্ত রফিকুল ইসলাম বীরউত্তমের নাম থাকতে পারত। ’৭১-এ সামরিক বাহিনী থেকে যুদ্ধে অংশ নেওয়া সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফ বীরউত্তম বা কর্নেল তাহেরসহ সবার অবদান জিয়াউর রহমানের চেয়ে কম নয়। বঙ্গবন্ধুর আদর্শে তৃণমূলের রাজনৈতিক কর্মী বিদেশি গণমাধ্যমে বাঘা সিদ্দিকী-খ্যাত কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম কাদেরিয়া বাহিনী গঠন করেন। ভারতের সাহায্য ছাড়াই তিনি যে ভূমিকা রেখেছেন এবং একমাত্র বেসামরিক যোদ্ধা হিসেবে বীরউত্তম খেতাব লাভ করেছেন, তা বিস্ময়কর। ১৯৯৪ সালের ১৬ ডিসেম্বরের আগে তৎকালীন বিরোধী দলের নেত্রী ও আজকের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার একটি সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছিলাম। সেদিন তার প্রেস সচিব আবু তৈয়ব এই সাক্ষাৎকার গ্রহণের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। ২৯ মিন্টো রোডের লালবাড়িতে বসে টোস্ট-বিস্কুটের সঙ্গে লাল চা পান করতে করতে আমরা তিনজন তার সেই সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছিলাম। আজকের কাগজের সৈয়দ বোরহান কবীর, ভোরের কাগজের প্রণব সাহা ও বাংলাবাজার থেকে আমি এই সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছিলাম। এখন দুটি কাগজ বিলুপ্ত, আমরা তিনজন নিজ নিজ জায়গায় আর শেখ হাসিনা দেশের তিনবারের প্রধানমন্ত্রী। আবু তৈয়ব সরকারি চাকরি থেকে অবসর নিয়ে দেশের শীর্ষ শিল্পপ্রতিষ্ঠান বসুন্ধরা গ্রুপের মিডিয়া উপদেষ্টা। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা সেদিন স্বভাবসুলভ কায়দায় এক জায়গায় বলেছেন, জিয়ার সেই স্বাধীনতা ঘোষণা পাঠ আমাদের উজ্জীবিত করেছিল। কিন্তু এ নিয়ে বাড়াবাড়ির কী আছে?

জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর আমলেই সেনাবাহিনীর উপপ্রধান ও বঙ্গবন্ধু হত্যার পর রক্তের ওপর দিয়ে অভ্যুত্থান-পাল্টা অভ্যুত্থানের ভিতর দিয়ে সেনাপ্রধান থেকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও সামরিক শাসনকবলিত বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন কিন্তু জীবিতকালে তিনি বা তার দল কখনো তাকে স্বাধীনতার ঘোষক বলে দাবি করেননি। সেনাশাসন-উত্তর বাংলাদেশে ১৯৯১ সালের গণতন্ত্রের নবযাত্রায় বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে তাদের দল ক্ষমতায় এলে দুটি বিষয় ঘটে যায়। ১. সেনাশাসক জিয়াকে তারা স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে প্রচার করতে থাকেন, ২. সেই সময়ের প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার জন্মদিন হিসেবে ১৫ আগস্ট নির্ধারণ করেন।

১৫ আগস্ট হচ্ছে মানবসভ্যতার ইতিহাসে সেই কালো দিন, যেদিন ভোরের আজানের সুরেলা ধ্বনি যখন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল, তখন পরিবার-পরিজনসহ ধানমন্ডির ঐতিহাসিক বাসভবন, যেটি স্বাধীনতা-সংগ্রামী বাঙালির ঠিকানা হয়ে দাঁড়িয়েছিল, সেখানেই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের প্রেক্ষাপটে নৃশংস হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করে রক্তগঙ্গা বইয়ে দেওয়া হয়েছিল। সেই রক্তের ওপর দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন অভ্যুত্থান-পাল্টা অভ্যুত্থানের ভিতর দিয়ে সেনাশাসক জিয়াউর রহমান। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ও ফাঁসির দণ্ডে দণ্ডিত বিপথগামী সেনা সদস্যদের বক্তব্যে দেখা যায়, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের ঘটনা সম্পর্কে সেনাশাসক জিয়াউর রহমান অবহিত ছিলেন। আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব বার বার সেনাশাসক জিয়াউর রহমানকে জাতির পিতৃ-হত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত করেছে।

আর এই অভিযোগ ইতিহাসে অমর সত্যের ওপর লিখিত হয়েছে, সেনাশাসক জিয়াউর রহমান ’৭১-এর স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে নিষিদ্ধ রাজনৈতিক শক্তিকে পুনর্বাসিতই করেননি, স্বাধীনতাবিরোধীদের প্রধানমন্ত্রী থেকে ক্ষমতার অংশীদারিত্ব দিয়েছিলেন। অন্যদিকে সেনাশাসক জিয়াউর রহমানের অনুসারীদের অভিমত হচ্ছে, তিনি জাতীয় জীবনে শৃঙ্খলাই ফিরিয়ে আনেননি, দেশকে উৎপাদনমুখী রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে গিয়ে নিজের ইমেজকে অনন্য উচ্চতায় দাঁড় করিয়েছিলেন। সেনাশাসক জিয়াউর রহমান ডান-বামের অতিমিলনে নিজের ক্ষমতা সুসংহত ও বিএনপিকে শক্তিশালী করলেও স্বাধীনতাসংগ্রামী আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের ওপর চরম দমননীতি অব্যাহত রাখেন। খুনি মোশতাকের উত্তরাধিকারিত্ব বহনে কার্পণ্য দেখাননি। ’৮০ সালের ৩ নভেম্বর হাই কোর্টের সামনে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক মরহুম আবদুর রাজ্জাককে পুলিশ হরতালের দিনে রাস্তায় ফেলে পিটিয়েছে। দলের নেতা-কর্মীরা দীর্ঘ কারাদহন ভোগ করেছেন। ’৮১ সালে আওয়ামী লীগের ইডেন কাউন্সিলে নেতৃত্বের লড়াইয়ে আওয়ামী লীগ যখন ভাঙনের মুখে, সেনাশাসক জিয়াউর রহমান তখন বঙ্গভবনে নির্ঘুম কাটিয়েছেন। তিনি চেয়েছিলেন প্রধান প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগের ভাঙন। কিন্তু রাতের অন্ধকার শেষে ভোরের আলো ফুটে ওঠে। সেই ভোরে আওয়ামী লীগের ঐক্যের প্রতীক হিসেবে দিল্লিতে নির্বাসিত বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা তুমুল করতালিতে সভানেত্রী নির্বাচিত হলে হতাশ হন সেনাশাসক জিয়াউর রহমান। বঙ্গভবন থেকে এই সংবাদ শুনে তার সামরিক সচিব মরহুম মেজর জেনারেল সাদেক চৌধুরীকে আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘দেশটা বুঝি ইন্ডিয়া হয়ে গেল। ’

আমি জানি, আমার লেখা পড়ে বিএনপির অন্ধ-সমর্থকরা চামড়া তুলে হাড্ডি-মাংস খেয়ে ফেলতে চাইবেন। আমি আরও জানি, বিএনপির দলীয় অন্ধরা যা খুশি তাই গাল দেবেন কিন্তু আমি জানি, নিজেকে কখনো কোনো দলের অন্ধ দাস মনে করি না। বঙ্গবন্ধুকেই আমার নেতা এবং মানুষকেই আমার দল মনে করি। একটি অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক শোষণমুক্ত বাংলাদেশ আমার স্বপ্ন। সমাজতন্ত্রকে কখনই নিজের দর্শন বলে চিন্তা করিনি। কখনই এ দেশের মানুষের আরাধ্য ধন গণতন্ত্রকে উপেক্ষা করতে শিখিনি। বিশ্বাস করি না সংবিধান ও আইনের ঊর্ধ্বে কেউ। একটি কার্যকর সংসদ, জবাবদিহিমূলক শাসনব্যবস্থা, স্বাধীন ও শক্তিশালী সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান আমাদের প্রত্যাশা। এ দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার ৩৬ বছরের দলীয় নেতৃত্ব যেমন উত্থান-পতনের, তেমনি সাফল্যের গৌরবগাথা।

তেমনি বিএনপি সেনাশাসনের গর্ভ থেকে জন্ম নিলেও সেনাশাসক জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ডের পর সামরিক জমানায় অকালবৈধব্য নেওয়া বেগম খালেদা জিয়া দলের হাল ধরেন। বিএনপির অসংখ্য নেতাই তখন সামরিক শাসকের সঙ্গে চলে গেছেন। তারুণ্যনির্ভর ছাত্রদলের ওপর ভর করে বেগম খালেদা জিয়া আন্দোলনের পথ ধরে সেনাশাসন-উত্তর প্রথম গ্রহণযোগ্য নির্বাচনে ক্ষমতায় আসেন। দেশের মানুষ গণতন্ত্রের স্বাদ পেলেও কারাবন্দী এরশাদ পাঁচটি আসনে জিতলেও সংসদে তৃতীয় বৃহত্তম দল হলেও নেতা-কর্মীদের ওপর দমন-নির্যাতন শুরু হয়। সে সময় পানিসম্পদমন্ত্রী জেনারেল মজিদ উল হকের বিরুদ্ধে সংসদে তোফায়েল আহমেদ দুর্নীতির অভিযোগ আনলেও তোয়াক্কা করেনি বিএনপি। যোগাযোগমন্ত্রী কর্নেল অবসরপ্রাপ্ত অলি আহমদ আমাকে বলেছিলেন, তিনি বেগম খালেদা জিয়াকে বলেছিলেন মজিদ উল হকের বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগের তদন্ত করলে দল লাভবান হবে। বেগম খালেদা জিয়া তা শোনেননি। সে সময় শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বিরোধী দলের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে আন্দোলন বেগবানই হয়নি, দাবি মেনে নিয়ে গণঅভ্যুত্থানে বিএনপির বিদায় হলেও ১১৬ আসন নিয়ে সংসদে শক্তিশালী বিরোধী দলের আসন লাভ করে।

কিন্তু মরহুম রাজনীতিবিদ কাজী জাফর আহমদের প্রেসক্রিপশনে আওয়ামী লীগ-বিরোধী সব শক্তিকে নিয়ে খালেদা জিয়া ২০০১ সালের নির্বাচনের আগে চারদলীয় জোট গঠন করেন। বেগম খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক কার্যালয় হাওয়া ভবনে পুত্র তারেক রহমান ও জাঁদরেল সিএসপি অফিসাররা বসে নির্বাচন পরিচালনা করেন। ২০০১ সালের নির্বাচনে ব্রুট মেজরিটি নিয়ে ক্ষমতায় আসে বিএনপি জোট। প্রতিহিংসার আগুন জ্বলে ওঠে সারা দেশে।

আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীই নন, সংখ্যালঘুরাও হত্যা-নির্যাতনের শিকার হন। যুদ্ধাপরাধী জামায়াত নেতাদের গাড়িতেও ওড়ে শহীদের রক্তে আঁকা পতাকা। রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড নিয়মে পরিণত হয়। বোমা-গ্রেনেডে ক্ষত-বিক্ষত বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটে। হাওয়া ভবন ঘিরে সেই সিএসপি অফিসাররা নির্বাসিত হন। দলের মুখপাত্র দিনকালের প্রেস রিলিজ সংগ্রহ করা আশিক তারেক রহমানের ডান হাত হয়ে ওঠেন। এই ভবনের কর্ণধার ও বেড়াজাল সরকারে অঘোষিত যুবরাজ। তার সহচর হয়ে যান কারাবন্দী গিয়াস উদ্দিন আল মামুন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে তাদের সুতার টানে অপ্রতিরোধ্য ক্ষমতার অংশীদার হন পরবর্তীতে নিখোঁজ হারিছ চৌধুরী। মোসাদ্দেক আলী ফালু ও জিয়ার সহচররা যতক্ষণ পাশে ছিলেন ততক্ষণ খালেদা জিয়ার রাশিতে বৃহস্পতি ছিল তুঙ্গে। হারিছ চৌধুরী যখন ঠাঁই পেলেন তারেক রহমানের ক্ষমতার বলয় প্রসারিত হলো, তখন তাকে শনির রাহু ভর করল।

১০ ট্রাক অস্ত্র আসে ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সাহায্যে। ২১-এর ভয়াবহ গ্রেনেড হামলায় আজকের প্রধানমন্ত্রী তৎকালীন বিরোধী দলের নেতা শেখ হাসিনাকে প্রকাশ্য দিবালোকে উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। ২২ জনের প্রাণহানি, শত শত মানুষের আর্তনাদে অভিশপ্ত হয়ে ওঠে বিএনপির শাসনামল। সব সন্দেহ আর অভিযোগের তীর নিক্ষিপ্ত হয় তারেক রহমান ও হাওয়া ভবনের দিকে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মহাজোট গঠনের আগেই বিএনপির রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে বঙ্গভবনই ছাড়তে হয়নি, রাজপথে হামলার শিকার হতে হয়। অথচ দুঃসময়ে সেনাশাসক জিয়াউর রহমানের হাত ধরে রাজনীতিতে আসা খালেদা জিয়ার পাশে থাকা বি. চৌধুরী, মরহুম সাইফুর রহমান ও কর্নেল অলি আহমদরা সরকার পরিচালনায় সততা-দক্ষতা দিয়ে মানুষের হৃদয় জয় করেছিলেন। হাওয়া ভবন ও তারেক রহমানের উন্নাসিকতায় সাইফুর রহমানকে সইতে হয় অপমান, কর্নেল অলি আহমদকে দল ছাড়ায় হামলার শিকার হতে হয়। তার পরের ইতিহাস থেকে জাতির জীবনে নেমে আসা ১/১১ দুর্যোগ বিএনপি ও হাওয়া ভবনের পাপের ফসল কতটা ছিল, তা সবার জানা। ১৯৯১ সালেই বিএনপির সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোরশেদ খানসহ অনেক শুভাকাঙ্ক্ষী বেগম জিয়াকে পরামর্শ দিয়েছিলেন তার দুই সন্তানকে উচ্চ শিক্ষার জন্য আমেরিকায় পাঠিয়ে দিতে। তারেক রহমান মানেননি, বলেছিলেন দেশে থাকব ঠিকাদারি করব তবু রাজনীতি থেকে দূরে নয়।

পেশিশক্তি, অর্থশক্তি ও প্রশাসনিক শক্তির ওপর নির্ভর করে যে রাজনীতিতে অগ্রসর হওয়া যায় না, তা ১/১১-এর নির্যাতন আর নির্বাসিত জীবনের মুখোমুখি হয়েও তারেক রহমান যে উপলব্ধি করেননি, তা এখন সত্য। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করা, জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ না করা এবং হঠকারী উগ্র সহিংস হরতাল-অবরোধের কর্মসূচিতে দলকে ঠেলে দিয়ে মামলার জালে ফেলার নেপথ্য দায় যে তারেক রহমানেরই সেটি বিএনপির অভ্যন্তরে যেমন আলোচিত তেমনি নাগরিক সমাজের মধ্যেও অসংখ্য প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। শেখ হাসিনার সরকার গণতন্ত্রের পথকে সীমিত করে উন্নয়নের মহাসড়কে যেখানে হাঁটছে, তারেক রহমান সেখানে ’৭১-এর পরাজিত অন্ধকার শক্তির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করছেন না। যত বিতর্ক হোক এ কথা সত্য, আওয়ামী লীগ-বিরোধী সব শক্তিকে সুসংগঠিত করে সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান রাষ্ট্র পরিচালনায় এসে নিজেকেই জনপ্রিয় করেননি, বিএনপিকেও জনসমর্থিত, জনপ্রিয় দলে পরিণত করেছিলেন। বেগম খালেদা জিয়া সেই ধারা বহাল রেখেছিলেন; কিন্তু যখনই তারেক রহমানের উত্থান ঘটল প্রতিহিংসা ও নেতিবাচক রাজনীতির আগ্রাসনে তারেক রহমান দলকে এবং বেগম খালেদা জিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করলেন। দলের অভ্যন্তরে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষ বা কট্টর অথবা উদারপন্থিদের মতবিরোধ খালেদা জিয়াকে বেকায়দায় না ফেললেও একদিকে তারেক রহমান আরেক দিকে জামায়াত নিয়ে বেগম খালেদা জিয়া রাজনৈতিক জীবনের চরম দুঃসময়ের মুখোমুখি।

প্রশ্ন উঠেছে, বিএনপিতে যত দিন তারেক রহমানের প্রভাব তত দিন দলে সরকার পরিচালনায় অভিজ্ঞ লোকেরা থাকার পরও দল কি আদৌ ক্ষমতায় আসবে? বিএনপিতে যেখানে খালেদা জিয়াই তার বিকল্প সেখানে তারেক রহমানের হাত দলের জন্য কি বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে? এখনো বিএনপি জনপ্রিয় দল। খালেদা জিয়া অনেক জনপ্রিয়; কিন্তু তারেক রহমান প্রকাশ্যে বা রাজনীতির পর্দার আড়ালে বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।

বেগম খালেদা জিয়া যতই প্রতিহিংসার রাজনীতির বাইরে এসে ভিশন ২০৩০ বা রাষ্ট্র পরিচালনার দর্শন দিন না কেন, তারেক রহমানের বুকে এবং শরিক জামায়াতের অন্তরে যে প্রতিশোধের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছে, তা থামাবেন কী করে। বিএনপিবিরোধী সব শক্তি বিশ্বাস করে, বিএনপি ক্ষমতায় মানেই তারেক রহমানের কৃতিত্ব প্রতিষ্ঠা এবং প্রতিহিংসার আগুনে জ্বালিয়ে ছারখার করে দেওয়া। ’৯০-উত্তর গণতন্ত্রের যাত্রাপথে এ দেশের রাজনীতিতে গণতান্ত্রিকভাবে ব্যালটের শক্তিতে সরকার পরিবর্তনের যে সমঝোতা গড়ে উঠেছিল ২১-এর গ্রেনেড হামলায় বিরোধী দলের নেত্রীকে উড়িয়ে দিতে গিয়ে তা শেষ হয়ে যায়।

লন্ডনে দেওয়া শেষ ভাষণে তারেক রহমান সাংবাদিকদের অন্ধ ও নিম্ন শ্রেণির প্রাণী বলে যে অন্তরজ্বালার প্রকাশ ঘটিয়েছেন, তাতে অনেকেই মনে করেন, তার দক্ষিণ হস্ত আশিক ইসলাম এবং তার অনুসারীরাই প্রকৃত সাংবাদিক। বাকিদের ওপর আঘাত কেবল সময়ের ব্যাপার। সব মিলিয়ে প্রশ্ন উঠেছে— তারেক রহমান কি বিএনপির বোঝা; নাকি দেশের রাজনীতির বোঝা? দেশের প্রতিষ্ঠাতা থেকে সবার প্রতি তাচ্ছিল্য, অমর্যাদাকর মন্তব্য ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণে তারেক রহমান বুঝিয়ে দিচ্ছেন, খালেদা জিয়ার ঘোষিত শান্তির বিপরীতে প্রতিহিংসার হিংস্র আক্রোশের পথেই হাঁটছেন।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে তারেক রহমান ক্ষমতাসীন বিএনপির প্রতাপশালী হওয়ার মধ্য দিয়ে যে অভিশাপ কুড়িয়েছিলেন, অনেকের মতে তা দেখেই বিচার-বিশ্লেষণের পথ ধরে শেখ হাসিনা হার্ভার্ড পাস আইটি বিশেষজ্ঞ পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়কে দলে জড়াননি। কায়দা করে ক্ষমতা থেকেও দূরে রেখেছেন; কিন্তু তার মেধা, সৃজনশীলতা এবং আইডিয়াকে কাজে লাগিয়ে দেশে তথ্যপ্রযুক্তির বিপ্লব ঘটিয়েছেন। জনগণের আকুতি যেমন, সব দলের অংশগ্রহণে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন, তেমনি ভয় আর উদ্বেগের জায়গায়ও তারেক রহমান রয়েছেন। বিএনপি কি পারবে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে এই বোঝা সরিয়ে আগামী নির্বাচনে গণরায় পক্ষে নিয়ে ক্ষমতায় ফিরতে? মিলিয়ন ডলারের এই প্রশ্ন পর্যবেক্ষক মহলের মধ্যেই নয়, বিএনপির অভ্যন্তরেও রয়েছে। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণকে ইউনেস্কো বিশ্বসম্পদে পরিণত করায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এটি আনন্দের বলে দলকে যেখানে এগিয়েছেন, সেখানে নির্বাসিত তারেক রহমান কী বলবেন?

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।