আশেকুল্লাহ ফারুকী
বৌদ্ধ ধর্মের মূল বাণী অহিংসা পরম ধমর্, জীব হত্যা মহাপাপ ও সংসার ত্যাগ করা। “বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি” আমি বুদ্ধের শরণ করলাম, বোধি লাভ জীবনের সংখ্যা উদ্দেশ্য। বুদুত্ব মানে পূর্ণ সত্য পবিত্রতা চরম অধ্যাাত্বিক জ্ঞান। বৌদ্ধ ধর্ম হচ্ছে, মহামতি বলতে একজন জ্ঞানপ্রাপ্ত, উদ্বোধিত, জ্ঞানী, জাগতিক মানুষকে বোঝায়। মহামতি গৌতম বুদ্ধের এ বাণী কি মিয়ানমারের শাসক গোষ্টী এবং উগ্রপন্থী রাখাইনরা মানছে ? জীব হত্যা মহাপাপ অথচ রাখাইন (আরাকান) রাজ্যে সন্ত্রাস দমনের নামে সে দেশের রাখাইন সেনাবাহিনী ও উগ্রপন্থীরা আরাকানের রোহিঙ্গা মুসলমানদের উপর দমন নিপীড়ন ও নির্বিচারে গণহত্যা, ধর্ষণ চালিয়ে যাচ্ছে। প্রশ্ন উঠেছে, রোহিঙ্গা হত্যা কি মহাপাপ। অহিংসা পরম ধর্ম বাণী যেন নীরবে কাঁদছে। রোহিঙ্গা হত্যার পরম ধর্ম আর সংসার ত্যাগ করে, বাণীকে চুকিয়ে মিয়ানমারের বৌদ্ধ ধর্মবলম্বীরা সংসার শুধু ত্যাগ নয়, ক্ষমতা ভোগ করা, ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করতে অন্য ধর্মাবলম্বীদের কচুকাটা করো এনীতিতে তারা নেমেছে, মূলত গৌতম বুদ্ধের এ বাণী মিয়ানমারে নীরবে কাঁদছে। প্রশ্ন হলো মিয়ানমারের ক্ষমতাসীন বৌদ্ধদের সন্ত্রাস-তান্ডব এবং ভয়ংকর নিষ্টুরতা আর কতদিন চলবে ? শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অংচান সূচির নির্যাতিত এবং দেশহারা রোহিঙ্গা মুসলমানরা ছাড়াও বিশ্ব সম্প্রদায় ও আস্থা রাখতে পাচ্ছেনা কেন ? শান্তিতে নোবেল পাওয়া সূচির জামানায় কেন এই অশান্তি ? যে কোন জীব হত্যা মহাপাপ হলেও মিয়ানমার বৌদ্ধরা নির্বিচারে রোহিঙ্গা মুসলমানদের অব্যাহতভাবে গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে। সংসার ত্যাগ করার পরিবর্তে রাষ্ট্রের সার্তে¦ গণহত্যায় সব ভান্তে এককাটটা হয়েছে।
বাস্তবতা হলো নির্যাতিত বিতাড়িত রোহিঙ্গা মুসলমানরা আরাকানের ভূমিপুত্রঃ তাদের রয়েছে গৌরবময় অতীত। ১৩৫ টি জাতি গোষ্টীর দেশ আরাকান এখন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের বন্ধুকেরনলে শামিত হলেও আরাকানের অতীতে রাজারা সব সময় মুসলিমদের গুরুত্ব দিতেন এবং নিজেরা মুসলমান উপাধি করতেন। রাখাইনের (আরাকান) রাজদর বারে অনেক মুসলমান রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ট ছিলেন। ইতিহাস বিধদের মতে ১৪০৬ সালে আরাকানের রাজ বংশের প্রতিষ্ঠাতা নরমিখলা ক্ষমতাচ্যত হয়ে বাংলার রাজধানী গৌড়ে আশ্রয় নেয়। গৌর্ভের শাসক জালালুদ্দিন শাহ্ বর্মী রাজাকে উৎখাতে নরমিখলারকে ৩০ হাজার সৈন্য দেন। রাজ্য উদ্ধারের পর রাজা নরমিখলা অবশেষে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন এবং মোহাম্মদ সোলায়মান শাহ নাম ধারণ করে, আরাকানের সিংহাসনে বসেন। রাজ বংশ ১শত বছর এই আরাকান শাসন করেন। মধ্যযুগে বাংলা সাহিত্যচর্চা একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র ছিল আরাকানের রোসাং রাজদরবার। মহাকবি আলাগুল ওই দরবারের রাজকবি ছিলেন।
তিনি লিখে ছিলেন- সাহিত্যের অমর মহাকাব্য পদ্মাবতী। এছাড়া সতী ময়না ও লোর-চন্দ্রনী, সাইফুল মূলক, জঙ্গনামা কাব্যগুলো রচনা করে রোমাং রাজদরবারের পৃষ্ঠপোষকতায়। ষোড়শ শতকে রাজসভায় মহাকবি আলাউল ছাড়া ও কোরেশী মাগন ঠাকুর শাহ মোহাম্মদ মগীর সৈয়দ সুলতান আরাকানে বসেই কালজয়ী সাহিত্য পদ্মাবতী, ইউসুপ জুলেখা সৃষ্টি করেন। সুলতানী ও মূখল আমলে বাংলা মুলূকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য চর্চার অনুকূলে পরিবেশ সৃষ্ঠি হয়। আরাকান রাজাদের আনুকূল্যেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক প্রখ্যাত রামপন্থী গভেষক অধ্যাপক ডঃ আহমদ শরীফ লিখেছেন, সপ্তম শতাব্দীতে বঙ্গোপ সাগরে ডুবে যাওয়া একটি জাহাজ থেকে বেঁচে যাওয়া আরব বনিকরা পাশ্ববর্তী উপকূলে আশ্রয় নেন। তারা সাগরে মাঝখানেই অলৌকিকভাবে আল্লাহর রহমতে বেঁচে যান। সেই রহম থেকেই রোহিঙ্গা জাতির উদ্ভব ঘটে। আরব বনিকেরা ব্যবসার পাশাপাশি ইসলাম ধর্ম প্রচার করেন।
১৯৬০ সালে আরাকানের রাজা চন্দ্রসু ধর্মার হাতে মোগল রাজপুত্র শাহসুজা নিহত হলে। এর পর দীর্ঘ সময় ধরে আরাকানে বিরাজ করে অস্থিরতা। ১৭৮৪ সালে বর্মী রাজা ভোধাপোয়া আরাকান দখলে নেন। ১৭৫৭ সালে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী ভারত বর্ষ দখলের প্রায় ৭০ বছর পর ১৮২৪ সালে বার্মা দখল করে। এরপর দীর্ঘদিন আরাকানি মুসলিমরা স্বস্তিতে ছিলেন। ১৯৪২ সালের যুদ্ধে আরাকান জাপানিদের অধীনে চলে যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ বিপুল সংখ্যক মুসলিম প্রাণ হারায়। যুদ্ধের মাধ্যমেই ১৯৪৫ সালে বৃটিশরা পূণরায় আরাকান দখল করে। পাকিস্তান ও ভারতের স্বাধীনতা লাভের এক বছর পর ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতা লাভ করে বার্মা। ইতিহাসবিদদের মতে ১৪০৪ সাল স্বাধীনতা লাভ করে বার্মা।
ইতিহাসবিদদের মতে ১৪০৪ সাল থেকে ১৬২২ সাল পর্যন্ত ১৬ জন মুসলিম শ্সাক আরাকান রাজ্য শাসন করেন। দুঃখের বিষয় যে সেই আরাকানের নামকরণ করা হয়েছে রাখাইন রাজ্য। সেখানের ভূমিপুত্র রোহিঙ্গা মুসলিমরা এখন দেশছাড়া। ১৯৮২ সালে নাগরিক সংশোধন আইন করে তাদের নাগরিকত্ব ছিনতাই করা হয়। রাষ্ট্রহারা নাগরিত্বহীন রোহিঙ্গা জনগোষ্টীকে মিয়ানমার থেকে বহিস্কারের লক্ষ্যে অপরেশন পাইথারা বা পরিস্কার ও সুন্দর জাতি অপারেশন নামে অভিযান চালানো হয়। অথচ ষাটের দশকের প্রথমার্ধে অংসান সূচির বাবা জেনারেল অংসানের শাসনামলে মন্ত্রিসভায় মুসলিম সদস্য ছিলেন। বছরের পর বন্দী সুচির মুক্তির মুক্তির দাবিতে রোহিঙ্গা মুসলিমেরা আন্দোলন করেছেন। সেই সুচির শাসনামলে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী সন্ত্রাসীদের তান্ডবে টিকতে না পেরে লাখ লাখ রোহিঙ্গা মুসলিমরা বাংলাদেশের শরনার্থী হয়ে আশ্রয় নিয়েছেন। আরাকানে রোহিঙ্গা মুসলিমদের হাজার হাজার বাড়ীঘর জ্বালিয়ে দেয়ার, ভয়াবহদৃশ্য আন্তজাতিক মহল দেখেছে। সেই সাথে হাজার হাজার তরুণ যুবক ও শিশু রোহিঙ্গাদের নির্মমভাবে হত্যা করেছে। গণধর্ষনের শিকার হয়েছে রোহিঙ্গা গৃহবধু ও যুবতীরা রাখাইন মগ দস্যুদের হাতে। রোহিঙ্গা মুসলমানরা আজ রাষ্ট্রহীন।
বাংলাদেশ আজ মানবিক কারণে মায়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ার আন্তজাতিক মহলের কাছে প্রসংসিত হয়েছেন। রোহিঙ্গারা যে, মিয়ানমারের জাতি সেটি তারা মানতে নারাজ। ২০১৭ সালের ২৫ আগষ্ট মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও সন্ত্রাসী মগদেরর দমন নিপীড়ন হত্যা ও গণ ধর্ষণের শিকার হয়ে প্রাণভয়ে প্রায় দশ লাখ রোহিঙ্গা নারী পুরুষ ও শিশুরা নাফ নদী পাড়ি দিয়ে কক্সবাজার জেলার উখিয়া-টেকনাফে বিভিন্ন আশ্রয় শিবিরে আশ্রয় দিয়েছে। দেশে দক্ষিণ সীমান্তের বিশাল বনভূমি আজ রোাহিঙ্গাদের আবাসভূমিতে পরিনত হয়েছে। লুপ্ত পাচ্ছে বন্য প্রাণী। বনভূমিতে মানুষের আবাসস্থল গড়ে উঠায় হাতির আবাস ও খাদ্য সংকটের কারণে হাতি তার প্রতিশোধ নিচ্ছে।
রোহিঙ্গারা আজ মানচিত্রহীন ভাসমান একটি জাতি। তাদের দুঃসময়ে মুসলিম রাষ্ট্র তুরস্ক ছাড়া কেউ এগিয়ে আসছেনা। রাসূল (স:) বলেছেন, পৃথিবীর সকল মুসলিম একটি শরীর বা দেহ বলেছেন। দেহের কোন অংশে আগাত লাগলে যেমন আগাত অনুভূত হয়। তেমনিভাবে বিশ্বের যে কোন রাষ্ট্রের মুসলমানের উপর আঘাত আসলে, তাহা সহ্ন্য করার মতো নয়। কেননা তারা একই কলেমার অনুসারী, আল্লাহ পাক বলেন, যে ব্যক্তি কোন কারণ ছাড়াই কোন ব্যক্তিকে হত্যা করে ফেতনা সৃষ্টি করলো, পক্ষান্তরে সে একটি জাতীকে হত্যা করার শামিল। (মাযদা ৩২।।) আল্লাহ পাক আরো বলেন, তোমাদের কি হয়েছে তোমরা কেন? আল্লাহর পথে লড়াই করছনা। অথচঃ নির্যাতিত নারী পুরুষ আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করছে আমাদের জন্য বন্ধু এবং সাহায্যকারী পাঠাও।
পাশ্ববর্তী দেশ সংখ্যা গরিষ্ট মুসলিম দেশ হিসাবে আমাদের যতেষ্ট ইমানী দায়িত্ব রয়েছে। তাদের আপদ বিপদ ও নির্যাতনের পাশে থাকা মুসলিম হিসাবে বসে থাকতে পারিনা। মানসিক ও আর্ত-মানবতার সেবায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আশ্রয় দিয়ে বিশ্বের কাছে প্রসংশিত হয়েছেন। বাংলাদেশের দক্ষিণ পূর্বে এবং আন্তজাতিক নাফ নদীর তারে রাখাইন (আরাকান) রাজ্যের অবাস্থান আয়ত ১৫ হাজার বর্গ কিলোমিটার। জনসংখ্যা প্রায় ১৫ লাখ। এর মধ্যে রোহিঙ্গা মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ট। বান্দরবান পার্বত্য জেলার দক্ষিণ সীমান্ত এলাকা থেকে টেকনাফ সেন্টমার্টিনদ্বীপ জোড়ে এর দুরত্ব। আরাকান রাজ্যে প্রায় ৪৭৫টি পাড়া রয়েছে। তার মধ্যে ২৮৫টি পাড়া মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও সন্ত্রাসী রাখাইন কর্তৃক আক্রান্ত।
উখিয়া টেকনাফ উপজেলার ৭টি আশ্রয় শিবিরে পালিয়ে আশা বিশাল রোহিঙ্গা জনগোষ্টী আশ্রয় নিয়েছে। গত ২৯/নভেম্বর পর্যন্ত এসব আশ্রয় শিবিরে ৭লাখ ৭৫ হাজার ৩৩২ জন রোহিঙ্গা নারী পুরুষ নিবন্ধিত হয়েছে। পৃথিবীর সর্ববৃহৎ শরণার্থী শিবির বনের ভিতর এবং প্রধান সড়কের পাশ্বে। এ সেনাবাহিনী, বিজিবি, র্যাব, পুলিশ, সরকারী কর্মকর্তা কর্মচারী আন্তজার্তিক বেসরকারী সাহায্য সংস্থা (এনজিও) আশ্রিত রোহিঙ্গাদের নিরলশভাবে সেবা দিয়ে যাচ্ছে।
আমরা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।