“কক্সবাজার ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি”
মাহবুবা সুলতানা শিউলি :
দিনগুলি মোর সোনার খাঁচায় রইলো না, সেই যে আমার নানা রঙের দিনগুলি—-
কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কালজয়ী সেই গানটির প্রতিধ্বনি শুনতে পাই সারা ক্যাম্পাস জুড়ে। হৃদয় মুছড়ে ওঠে। আনন্দের মাঝেও শুনতে পাই কষ্টে নীরব কান্না।
বিদায় কথাটি খুবই মর্মান্তিক। তবে বিদায় শুধু দুঃখের নয়, মহা আনন্দেরও হতে পারে। স্মৃতিতে জমা হয় হাজারও স্মৃতি। নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে ইতি টানলো কক্সবাজার ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ১ম ব্যাচের সমাপনী দিনের।
বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষে সামনের পথে চলার সময় এখন। প্রিয় ক্যাম্পাস আর বন্ধুদের ছেড়ে যেতে মন চায়না। কিন্তু জীবনের গতির সাথে এগিয়ে যেতে যে হবে..!
র্যাগড একটি ইংরেজি প্রবাদ। যার বাংলা অর্থ পড়ালেখা শেষের হৈচৈপূর্ণ দিন। ঘটা করে শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসের এ বিদায়ী অনুষ্ঠান পালন করে নেচে গেয়ে আর হাসি-তামাশা হৈহুল্লুডের মাধ্যমে। কিন্তু বাস্তবে র্যাগ-ডে কি কোনো আনন্দের দিন নাকি বেদনার?
সময়ের স্রোতে ভেসে যখন শিক্ষা জীবনের সমাপ্তি রেখায় দাঁড়ায় শিক্ষার্থীরা, তখন র্যাগ-ডে পালন করে। দীর্ঘ বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের জমা হওয়া বর্ণাঢ্য ও স্মৃতিময় ঘটনা এদিন চোখের সামনে ভেসে ওঠে তাদের।
ক্যাম্পাসের প্রথম দিন থেকে শুরু করে অজস্র ঘটনা এদিন খুব বেশি মনে পড়ে যায়। আসলে নাচ-গান আর ফুর্তি করে র্যাগ-ডে পালন করলেও মনের ভেতরে জমা হতে থাকে একরাশ বেদনা। মনে হয়, কোনো একটা প্রিয় জিনিস হারাতে বসেছে ওরা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ১ম ব্যাচের শিক্ষার্থীদের সকলের পরনে ছিল ধবধবে সাদা টিশার্ট। প্রিয়জনদের রঙ্গিন কলমের নানান লেখায় ও আচড়ে ভরে গেছে সাদা টিশার্টগুলি। লেখালেখিরই তো সময় এখন। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের চার বছরের পড়াশোনা শেষ করে এখন তাদের শিক্ষা সমাপনী দিন।
এতোক্ষণ যে ক্যাম্পাসের কথা বলছিলাম। সেটা হলো গত ৫, ৬, ৭, ৯ ও ১০ই ডিসেম্বর টানা মঙ্গলবার হতে রবিবার কক্সবাজার ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি আইন বিভাগ, ইংরেজি বিভাগ, কম্পিউটার সাইন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগ এবং হসপিটালিটি অ্যান্ড ট্যুরিজম বিভাগের প্রথম ব্যাচগুলোর শিক্ষা সমাপনী অনুষ্ঠানের আয়োজন করার দিনগুলিতে ঘটিত দৃশ্যপট বর্নানা করছি।
চার বছরে ৪৮ মাসের শিক্ষাজীবন শেষে বিদায় আয়োজনকে ঘিরে এ চারটি অনুষদের শিক্ষার্থীরা পরিকল্পনা করে নানা শিক্ষা সমাপনী উৎসবের। প্রতিটি বিভাগের প্রথম ব্যাচ ছাড়াও উক্ত বিভাগগুলোর অন্যান্য ব্যাচের শিক্ষার্থীরাও যোগ দেয় আনন্দমুখর এ উৎসবে। দিনের শুরুতে ক্যাম্পাস জুড়ে বিদায়ী শিক্ষার্থীদের কয়েকটি বড় র্যালী ক্যাম্পাস প্রদক্ষিণ করে অডিটোরিয়ামে এসে শেষ হয়। তখন পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ব্যাচের জুনিয়রেরা র্যালীতে যোগ দেয় এবং প্রথম ব্যাচ গুলোর বিদায়ে যুক্ত হয়।
স্মৃতিতে যোগ হয়েছে ক্যাম্পাসে ক্যাফেটেরিয়ায় বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা, ঘোরাঘুরি, ক্লাস, অ্যাসাইনমেন্ট, ভাইভা, প্রেজেন্টেশন নিয়ে দৌড়াদৌড়ি এভাবেই কেটে গেল শিক্ষাজীবনের চারটি বছর। ২০১৩ সালের ১৫ ই সেপ্টেম্বর শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ( ইউজিসি ) কর্তৃক অনুমোদন পাওয়ার পর কক্সবাজার ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির যাত্রা শুরু হয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন ২০১৪ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি। ২০১৪ সালের ৮ মার্চ থেকে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়।
সেই ২০১৪ সালে ইউনিভার্সিটির শিক্ষা কার্যক্রম শুরুর পর থেকে ১ম ব্যাচের শিক্ষার্থীদের পথচলায় ক্যাম্পাসের সবকিছুই ঘটেছে এ শিক্ষার্থীদের চোখের সামনে। ক্যাম্পাসের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে তাদের মজার স্মৃতি, সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনার বিভিন্ন ঘটনা। কিন্তু চার বছর পর মনের কোণে হঠাৎ যেন বেঁজেছে বিদায়ের ঘন্টা। তাই বিদায় বেলায় সবার মুখেই বিষাদের লুকানো ছাপ।
তবে দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখতে শিক্ষার্থীদের উচ্ছাস- উন্মাদনার কমতি ছিলোনা। কারো হাতে বেলুন, কারো হাতে বাঁশি,কারো হাতে ফুল, কারো হাতে রঙ। সবাই ব্যস্ত নিজের বিভাগকে মনের মতো করে সাঁজাতে। সকাল ৯ টার দিকে প্রায় প্রতিটি বিদায় অনুষ্ঠানের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানিত উপাচার্য প্রফেসর ড. মোঃ আবুল কাসেম।
বিদায়ী শিক্ষার্থীদের উজ্জল ভবিষ্যৎ কামনা করে দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্য দেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা ও ট্রাস্টি বোর্ডের সেক্রেটারি জনাব লায়ন মোঃ মুজিবুর রহমান। আর বক্তব্য প্রদানকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় সন্তানগুলোর বিদায়ের মুহুর্তে তাঁর চোখের কোণেও জল জমেছিল এক পশলা।
বিদায়ী শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে আরো বক্তব্য দেন ট্রেজারার প্রফেসর আবদুল হামিদ, আইন বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ড. মোঃ নায়ীম আলিমুল হায়দার, ইংরেজি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান আমিনুল ইসলাম, সিএসই বিভাগের বিভাগীয় প্রধান, ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের বিভাগীয় প্রধান রাজিদুল হক, হসপিটালিটি অ্যান্ড ট্যুরিজম বিভাগের বিভাগীয় প্রধান শাকিল আহমেদ, ইসলামি স্টাডিজ বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ড. বেলাল নূর আজিজি, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক এএসএম সাইফুর রহমান, রেজিস্ট্রার নাজিমুদ্দিন সিদ্দিকীসহ বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষকবৃন্দ।
এরপরই শুরু হয় মুল উম্মাদনা- আনন্দ শোভাযাত্রা। ব্যান্ড বাজিয়ে, নেচে-গেয়ে, একে অন্যকে রঙ মাখিয়ে শহরের কলাতলী ঘুরে শেষ হয় শোভাযাত্রা। দুপুরের পর শুরু হয় প্রত্যেকটি ডিপার্টমেন্টের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। একের পর এক চলে নাচ, গান, কৌতুক , নাটক, র্যাম্প শো ও স্মৃতিচারণ।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ দিনটিকে মনের মনিকোঠায় আঁগলে ধরে রাখতে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে, রঙ্গ মেখে স্মরণীয় করে রাখে। সাথে সাথে চলে ফটোসেশন আর সেলফির মাতামাতি। সন্ধ্যায় উড়ানো হয় ফানুস। সবশেষে বিদায়ী শিক্ষার্থীদের ক্রেস্ট দিয়ে সম্মাননা জানানো হয়। কিভাবে এতটা সময় পার করলেন ভাবতে পারেনা শিক্ষার্থীরা।
” যদি আবার প্রথম থেকে শুরু করতে পারতাম তাহলে মনে হয় আরো ভালো হতো!’’ এমনি আবেগতাড়িত কন্ঠে কথাগুলো বলছিলেন প্রথম ব্যাচের বিভিন্ন শিক্ষার্থীরা। এভাবে তারা তাদের অনুভূতি ব্যক্ত করে বলেন-” টানা চার বছর একসঙ্গে একটি পরিবারের মতো ছিলাম। অনেক আনন্দ লাগছে ঠিকই। কিন্তু এর মাঝেও খানিকটা কষ্ট লুকিয়ে আছে প্রিয় বিশ্ববিদ্যালয়, প্রিয় ক্যাম্পাস, প্রিয় বন্ধুদের আর এভাবে কাছে পাবো না সেজন্য। ”
প্রিয় ক্যাম্পাস ছেড়ে বিদায় নিতে হবে, বন্ধুদের ছেড়ে যাবার কষ্ট। স্মৃতি হয়ে থাকবে ভালোবাসার ক্যাম্পাস। হাসি-কান্নার সারথীদের আর পাওয়া যাবেনা একসাথে এভাবে। অনেকে আবেগে এক পশলা বৃষ্টি এনেছেন চোখের কোণে।
অবশেষে ফুরিয়ে এলো দিন। রাতের আধারের সঙ্গে মিলিয়ে যেতে লাগলো আনন্দ- বেদনা। একে একে বিদায় নিলো সবাই। প্রানোচ্ছল চিত্র মুছে গিয়ে সবকিছু যেন নীরবে। বিদায় বেলায় মনের গহীনে একটাই কথা-আবার হবে তো দেখা..! এমন আবেগ, আক্ষেপ আর স্মৃতিতে উজ্জ্বল ছিলো ১ম ব্যাচগুলির বিদায়ের দিনগুলি। বিদায় বেলা ভেবেছিলাম—
অশ্রু জলে দেবোনা বিদায় দেবো হাঁসি মুখে মনের কান্না মিথ্যে হাঁসির ঘোমটায় মুড়ে বলবো “এইতো, আবার হবে গো দেখা !” হৃদয় শাখে ফোটা মঞ্জরি দিয়ে গেঁথে নেবো মালা পরিয়ে দেবো তোমার গলে । কিন্তু বিদায় বেলায় একি হলো হায় ! বুকের বাঁধ ভেঙ্গে চোখের কূল ছেপে এলো জোয়ার ! অশ্রু কণায় ভিজলো তোমার যাত্রা-পথ!! এভাবেই সমাপ্তি ঘটে বহু প্রতিক্ষিত বিদায়ের।
লেখকঃ মাহবুবা শিউলী, সদস্য ট্রাস্টি বোর্ড,কক্সবাজার ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি।
আমরা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।