মোঃ আকতার হোছাইন কুতুবী ॥
কুতুব আউলিয়ার দ্বীপ কুতুবদিয়া পর্যটকদের বিনোদনে নয়নাভিরাম আকর্ষণীয় পর্যটন স্পট। অপার সম্ভাবনার সাগরকন্যার উন্নয়নের জন্য সরকারকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। সরকারের সুনজরে হয়ে উঠতে পারে বাংলাদেশের অন্যতম বিনোদন বান্ধব শ্রেষ্ঠ স্থান। আর সরকার পাবে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব।
দেড় হাজার বছরের পুরনো বাংলাদেশের মূল-ভূখ- থেকে বিচ্ছিন্ন দ্বীপ কুতুবদিয়া। বঙ্গোপসাগরের মধ্যখানে অবস্থিত হওয়ায় কুতুবদিয়া দ্বীপকে ‘সাগর কন্যা’ নামেও কবিরা কবিতায় তুলে এনেছেন। শিল্পীরা গানের ছন্দে ছন্দে সাগর কন্যাকে ফুটিয়ে তুলেছেন। বিখ্যাত অলি হজরত কুতুব উদ্দিন আউলিয়া (রহ.) এর নামে দ্বীপ কুতুবদিয়ার নামকরণ হয়েছে বলে কথিত রয়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্যে সমুদ্রে জাহাজ চলাচলে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারের কাছে এ দ্বীপ ছিল অতি গুরুত্বপূর্ণ। যে কারণে ১৮৪৬ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশ সরকার দৃষ্টিনন্দন বিখ্যাত কুতুবদিয়া বাতিঘর নির্মাণ করেন। ইতিহাসে এ “বাতিঘর” নামেই কুতুবদিয়ার পরিচিত। দ্বীপের আইন-শৃংখলা, শান্তি, প্রগতি রক্ষার প্রয়োজনে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার ১৯১৭ সালে পুলিশ স্টেশন স্থাপন করেন। থানা প্রতিষ্ঠার সুনির্দিষ্ট তারিখ জানা না গেলেও ইতিহাসবিদদের মতে ১৯১৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় কুতুবদিয়া থানা। আর চলতি বছরের ডিসেম্বরেই ১০০ বছর পূর্ণ হলো কুতুবদিয়া থানার।
দ্বীপের উত্তর-দক্ষিণ ও পশ্চিমে বঙ্গোপসাগর এবং পূর্বে আড়াই কিলোমিটার দূরত্ব বিশিষ্ট কুতুবদিয়া চ্যানেল। বাস্তবায়নাধীন দক্ষিণ এশিয়ার সর্ববৃহৎ মহেশখালীর সোনাদিয়া গভীর সমুদ্র বন্দরের মোহনায় অবস্থিত কুতুবদিয়া লবণ, মাছ, কৃষি ও খনিজ সম্পদের জন্য বিখ্যাত। উপকূলীয় উপজেলা বাঁশখালী, পেকুয়া ও মহেশখালীকে বঙ্গোপসাগরের সরাসরি বিক্ষুব্ধতা থেকে এ দ্বীপই রক্ষা করছে। দ্বীপের দর্শনীয় স্থানের মধ্যে আধ্যাত্মিক জগতের কা-ারী হযরত শাহ্ আবদুল মালেক আল-কুতুবী (রাহ.) কুতুব শরীফ দরবার, কুতুব আউলিয়া (রাহ.) মাজার, প্রাচীন স্থাপত্য কালারমার মসজিদ, বিসিকের লবণ উৎপাদন প্রদর্শনী খামার, শুঁটকী প্রক্রিয়াজাত কেন্দ্র, বায়ু বিদ্যুৎ, ঐতিহাসিক বাতিঘর ও সূর্যাস্তের খেলা। এছাড়া দীর্ঘ ২৫ কিলোমিটার বালিয়াড়ীযুক্ত সমুদ্র সৈকত যেন এক নৈসর্গিক সৌন্দর্য্যরে লীলাভূমি। সমুদ্র সৈকতজুড়ে রয়েছে ছায়াঘেরা আকর্ষণীয় ঝাউবিথী। প্রকৃতির অপরূপ সাজ-সজ্জার দ্বীপ-কুতুবদিয়াই হতে পারে সম্ভাবনাময় আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র। অত্যাধুনিক প্রযুক্তির বেড়িবাঁধ, জাতীয় গ্রীড লাইনে বিদ্যুতায়ন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত করা হলে কুতুবদিয়া দেশের সম্পদে পরিণত হবে নিঃসন্দেহে।
ঐতিহাসিকদের মতে ১৭শ’ শতাব্দীতে সৃষ্ট ১২০ বর্গ কিলোমিটার বিশিষ্ট দ্বীপটিতে ছিলোনা বেড়িবাঁধ। বিশাল চরে প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট গহীন প্যারাবন ও বালির ডেইলের ডাঙ্গালতাই (বুডিরলতা) সাগরের ঢেউ থেকে রক্ষা করতো এ দ্বীপকে। সচেতনতার অভাবে সেই প্যারাবন ও লতাগুল্ম উজাড় হয়ে যাওয়ায় সমুদ্রের তোপের মুখে পড়ে এ দ্বীপ। ১৯৬০ সাল থেকে সর্বশেষ ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত ছোট বড় অন্তত: ১০টি প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতসহ প্রতিনিয়ত ভাঙ্গতে থাকায় বর্তমানে দ্বীপটি ২৭ বর্গ কিলোমিটারে ঠেকেছে। জলবায়ুর প্রভাবে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে মান্দাতা আমলের ডিজাইনে নামমাত্র বেড়িবাঁধে এ ভয়াবহ ভাঙ্গন ঠেকানো যাচ্ছে না। তা ছাড়া আবহমান কাল থেকে দ্বীপের উত্তর-দক্ষিণ ও পশ্চিমে ভাঙ্গন দেখা গেলেও পূর্ব পাশে তেমন ভাঙ্গন ছিলনা। বরং জেগে ওঠতো চর। বিশাল চরের বনায়ন উজাড় করে মৌসুমী লবণমাঠ ও শুঁটকী কিল্লা গড়ে তোলাসহ উত্তর পয়েন্ট থেকে সিলিকাবালি পাচার অব্যাহত থাকায় বর্তমানে চারিদিকে সমানতালে ভাঙ্গছে দ্বীপটি। তাই দেশের মানচিত্রে স্থান করে রাখতে হলে সিভিল প্রশাসনের পাশাপাশি সেনাবাহিনীর তদারকির মাধ্যমে আত্যাধুনিক প্রযুক্তির টেকসই স্থায়ী বেড়িবাঁধ নির্মাণ ও অতি ঝুঁকিপূর্ণ পয়েন্টে রাবারড্যাম স্থাপনসহ ভিতরে বাইরে দু’স্তর বিশিষ্ট সবুজবেষ্টনী গড়ে তোলা হলে দেশের সম্ভাবনাময় এ দ্বীপটি রক্ষা করা সম্ভব বলে মনে করেন দেশের নামকরা বিজ্ঞানীরা।
আশির দশক থেকে ১৯৯১ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) পর্যায়ক্রমে ডিজেল চালিত ৩টি জেনারেটর ক্যাটারপিলার, ড্যানিস ও কামিন্সসহ সর্বশেষ ২০০৭ সালে বেসরকারি কোম্পানি ‘প্যান এশিয়া পাওয়ার সার্ভিসেস লিমিটেড’ প্রায় ১০ কোটি টাকা ব্যয়ে ১ হাজার কিলোওয়াট উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন উইং ব্যাটারি বায়ু বিদ্যুৎ (দেশের সর্ববৃহৎ বায়ু বিদ্যুৎ পাইলট প্রকল্প) স্থাপন করেও কাঙ্খিত বিদ্যুতের আলো দেখেনি দ্বীপবাসী। একমাত্র বিদ্যুৎ সমস্যার কারণে উন্নয়নে পিছিয়ে পড়েছে কুতুবদিয়া। বিশেষত: এখানে গড়ে ওঠছেনা বরফকল, লবণ ক্রাসিংমিল, মৎস্য প্রক্রিয়াজাত কেন্দ্র ও অন্যান্য শিল্পকারখানা। ১৩৩ কোটি টাকা ব্যয়ে দীর্ঘ ২২ কিলোমিটার সমুদ্রের তলদেশ দিয়ে সন্দীপে সাবমেরিন ক্যাবলের সাহায্যে জাতীয় গ্রীড লাইন বিদ্যুতায়ন করতে যাচ্ছে সরকার। এর এক-দশমাংশ টাকায় বাঁশখালীর ছনুয়া থেকে মাত্র আড়াই কিলোমিটার চ্যানেল দিয়ে একইভাবে কুতুবদিয়ায়ও বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া সম্ভব বলে বিশেষজ্ঞ মহল মনে করেন।
এ দ্বীপে চলাফেরার যথেষ্ট সুযোগ সুবিধা ও আবাসনের জন্য জেলা পরিষদের একটি ডাকবাংলো এবং ব্যক্তি মালিকানাধীন বেশ কয়েকটি আবাসিক হোটেলের মধ্যে হোটেল সমুদ্র বিলাস, হোটেল আলমাস, হোটেল সাগরিকা এবং বিভিন্ন এনজিও প্রতিষ্ঠানের রেস্ট হাউস অন্যতম। বাংলাদেশের যে কোন প্রান্ত থেকে গাড়িযোগে সোজা কক্সবাজার জেলার পেকুয়া উপজেলার মগনামা ঘাটে এসে কুতুবদিয়া চ্যানেল পার হয়ে স্পীড বোটে ৬-৭ মিনিট এবং ডেনিশ বোটে ২০-২৫ মিনিটে কুতুবদিয়া দ্বীপে পৌঁছা যায়। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দিক দিয়ে কুতুবদিয়ায় কোন অংশেই সেন্টমার্টিনের চেয়ে কম সৌন্দর্য নয়। যেহেতু সেন্টমার্টিন একটি মাত্র ইউনিয়ন। বিখ্যাত পর্যটন হনলুলু, ওয়াইকিকি, সিসিলি এ রকম বিছিন্ন সাগর বেষ্টিত পর্যটন কেন্দ্র আজ পৃথিবীখ্যাত। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় কুতুবদিয়ার মত একটি দারুণ সম্ভাবনাময় পর্যটন কেন্দ্র থাকার পরেও এর উন্নয়নে কোন পদক্ষেপ এ পর্যন্ত নেয়া হয়নি।
অভিযোগ ওঠেছে দ্বীপের পৌণে প্রায় দু’লাখ মানুষ অজ¯্র সমস্যা নিয়ে রীতিমতো প্রকৃতির সাথে জীবনযুদ্ধের মাঝে বসবাস করলেও তেমন মাথাব্যথা নেই স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের। যার কারণে সরকারেরও দৃষ্টি নেই দ্বীপবাসীর প্রতি। এ অবস্থায় কুতুবদিয়ার অস্তিত্ব ও উন্নয়নের স্বার্থে দলমতের ঊর্ধ্বে ওঠে সকল শ্রেণী-পেশার মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হওয়া সময়ের দাবি বটে। বিশেষত: বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, স্কুল ও মাদ্রাসায় দ্বীপের পড়–য়া শিক্ষার্থীরা মাতা-মাতৃভূমি কুতুবদিয়ার উন্নয়নে সরকারের প্রতি জোরালো দাবি তোলা দরকার বলে অনেকে জানান।
লেখক পরিচিতি : মো: আকতার হোছাইন কুতুবী, প্রধান সম্পাদক জাতীয় ম্যাগাজিন জনতার কণ্ঠ, উপদেষ্টা সম্পাদক জাতির আলো, সহ-সম্পাদক জাতীয় দৈনিক আমার কাগজ ও দি গুডমর্নিং, ঢাকা। মোবাইল : ০১৮২২৮৫৮৪০০, ই-মেইল : akterkutubinews@gmail.com
আমরা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।