সায়ীদ আলমগীর, কক্সবাজার:
নিজ দেশ মিয়ানমারে সেনা ও রাখাইন যুবকদের পাশবিকতা থেকে বাঁচতে সীমান্ত প্রতিবেশি বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে প্রায় ৮ লাখ রোহিঙ্গা। নি:স্ব হয়ে দেশান্তরি হলেও মুছে ফেলতে পারেনি দেশে জন্মনেয়া পুরোনো শত্রুতা। তাই মানবিক আশ্রয়স্থলে পুরোনো শত্রুতায় ঘটনানো হচ্ছে খুনের মতো জঘন্য অপরাধ। গত এক সপ্তায় উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে স্বজাতির হাতেই খুন হয়েছেন দু’রোহিঙ্গা। এ ঘটনায় বুধবার দু’জনকে গ্রেফতারও করেছে আইনপ্রয়োগকারি সংস্থা। এছাড়াও চলতি মাসের শুরুর দিকে অস্ত্রসহ আরো দু’রোহিঙ্গাকে আটক করেছে র্যাব সদস্যরা।

বিশ্ব মিডিয়া ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মিয়ানমারের আরাকানে হত্যার বিভীষিকা দেখে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মানবিক কারণে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেন। এ আশ্রয়ে নতুন করে সীমান্ত উপজেলা উখিয়া-টেকনাফে ঢুকেছে প্রায় ৮ লাখ রোহিঙ্গা। ফলে নতুন-পুরোনো মিলে এখন ১০ থেকে ১২ লাখ রোহিঙ্গা নিয়ে চরম বেকায়দায় রয়েছে স্থানীয় লোকজন।

এরপরও সব রোহিঙ্গার খাদ্য-বাসস্থান, চিকিৎসা ও নিরাপত্তা জোরদারে নিরলস কাজ করছে বাংলাদেশ সরকার। প্রতিদিন অব্যাহত রয়েছে রোহিঙ্গা পরিবারগুলোতে ত্রাণ বিতরণ। মানবিকতার কারণে এভাবে সহানুভূতি পেলেও আশ্রিত রোহিঙ্গারা দিন দিন হিংস্র হয়ে উঠছে। খুন, ডাকাতি, ইয়াবা ও মানবপাচার, হামলা এবং বনভূমি দখলসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে তারা। সাধারণ মানুষের পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের হাতে হামলার শিকার হয়েছেন আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার লোকজনও।

গত শুক্রবার থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত কক্সবাজারের উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে রোহিঙ্গা হাতেখুন হয়েছে স্বজাতি দুই রোহিঙ্গা।

তথ্যমতে শুক্রবার উখিয়ার থাইংখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পে দুর্বৃত্তদের ছোড়া গুলিতে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান রোহিঙ্গা নেতা মো. ইউছুপ। শুক্রবার দিবাগত রাত গুলিতে নিহত রোহিঙ্গা মো. ইউসুফ (৩৮) উখিয়ার পালংখালীর থাইংখালী তানজিমার খোলা রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ডি-ব্লকের মাঝির (নেতা) দায়িত্ব পালন করছিলেন। একই ভাবে সোমবার ভোরে উখিয়ার বালুখালী ক্যাম্পে দুর্বৃত্তের ছুরিকাঘাতে ইউছুফ জালাল (৬০) নামে এক রোহিঙ্গা খুন হয়েছেন। নিহত ইউছুফ জালাল মিয়ানমারের মংডু এলাকার আশরাফ আলীর ছেলে ও বালুখালী ক্যাম্পের বি-ব্লকের ১০ নম্বর ইউনিটে বাস করতেন। পাশাপাশি ওই ব্লকের একটি মসজিদে মোয়াজ্জিনের দায়িত্ব পালন করতেন জালাল।

উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আবুল খায়ের হত্যাকান্ড দুটি সম্পর্কে বলেছিলেন, মিয়ানমারে থাকাকালীন জন্ম নেয়া শত্রুতার জের ধরেই আশ্রিত জীবনেই প্রতিপক্ষকে খুন করেছে রোহিঙ্গারা। আমরা মানবিকতার পাশাপাশি অপরাধ দমনেও সচেষ্ট হচ্ছি।

ওসি আরো জানান, আইনপ্রয়োগকারি সংস্থা শুক্রবার রাতেই রোহিঙ্গা মো. আলম নামে এক যুবককে অস্ত্রসহ গ্রেফতার করেছে। বুধবার বালুখালীর পানবাজার এলাকা থেকে লম্বা কিরিচসহ তাজিমারখোলা রোহিঙ্গা ক্যাম্পের সি-৬ ব্লকের নূর মোহাম্মদ (৩০) ও সি-২২ ব্লকের আতাউর রহমান (১৬) গ্রেফতার করা হয়। তারা প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে রোহিঙ্গা শিবিরের মাঝি ইউসুফ হত্যাকান্ডে জড়িত বলে স্বীকার করে।

উখিয়ার পালংখালী ইউপি চেয়ারম্যান ও রোহিঙ্গা প্রতিরোধ সংগ্রাম পরিষদ’র সদস্য সচিব গফুর উদ্দীন চৌধুরী জানান, মাত্রাতিরিক্ত রোহিঙ্গাদের ভারে উখিয়া-টেকনাফ নুয়ে পড়েছে। রোহিঙ্গাদের চাপে স্থানীয় লোকজন স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে। তাদের অপরাধ কর্মে বিষিয়ে উঠছে এলাকার পরিবেশ। এতে নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়েছে স্থানীয়দের জীবন। অদূর ভবিষ্যতে রোঙ্গিহারা চরম বিষফোঁড়া হয়ে দাঁড়াবে। এর পূর্বাভাস সাম্প্রতিক দুটি খুন।

কক্সবাজার সিভিল সোসাইটির সভাপতি আবু মোরশেদ চৌধুরী খোকা বলেন, মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি হলো দেশান্তর হলে পুরোনো শত্রুতা ভূলে যায়। কিন্তু রোহিঙ্গাদের চিত্র ভিন্ন। তারা সম্প্রতি যে কয়েকটি খুনের ঘটনা ঘটালো তা উদ্বেগজনক। এটি আমাদের পারিপার্শ্বিকতার জন্যও হুমকি স্বরূপ।

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক ও উখিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরীর মতে, রোহিঙ্গাদের কারণে সীমান্তের সামগ্রিক পরিবেশ বিনষ্ট হচ্ছে। তাদের শক্ত হাতে দমন করা না হলে অপরাধ প্রবণতা বাড়বে। তাই রোহিঙ্গাদের বেপরোয়া চলাচলে কঠোর নজরদারি রাখতে প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।

কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আফরুজুল হক টুটুল জানান, রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে গিয়ে নিজেদের সুযোগ-সুবিধা বিসর্জন দিচ্ছে স্থানীয়রা। এরপরও রোহিঙ্গা রোহিঙ্গাদের প্রাণ নিচ্ছে এটা বড়ই নির্মম। রোহিঙ্গারা নানা অপরাধ ঘটানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু পুলিশসহ অন্যান্য বাহিনীর তাদেরকে নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। রোহিঙ্গাদের অপরাধ নিয়ন্ত্রণে পুলিশ কঠোর নজরদারি রেখেছে।

উল্লেখ্য, গত ২৫ আগস্ট থেকে ২৫ অক্টোবর পর্যন্ত বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে ৮ লাখের বেশি নতুন রোহিঙ্গা। পুরাতনসহ এখন উখিয়া-টেকনাফে ১০ থেকে ১৩ লাখ। রোহিঙ্গাদের চাপে স্থানীয় লোকজন কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। আবার তাদের হিংস্রতার শিকারও হচ্ছে স্থানীয়রা। গত অক্টোবরেও রামুতে এক যুবককে খুন, উখিয়ায় ৪ বাংলাদেশীকে প্রহার ও ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের ডাকাতি কালে স্বশস্ত্র রোহিঙ্গা আটকসহ গত তিন মাসে অসংখ্য অপরাধমূলক কর্মকান্ড ঘটিয়েছে মানবিক আশ্রয়ের আওতায় থাকা রোহিঙ্গারা। ###

### সায়ীদ আলমগীর, কক্সবাজার। ০১৮১৮১৪২০৮৮ ###