–  মাহবুবা সুলতানা শিউলি

গত ২১ জানুয়ারি, রোববার রাতে চট্টগ্রাম নগরীর আকবর শাহ থানার বিশ্ব কলোনি এলাকার ‘আয়েশা মমতাজ মহল’ নামের পাঁচতলা বিশিষ্ট একটি ভবনের দ্বিতীয় তলার সিঁড়ির পাশ থেকে ফাতেমা আক্তার মীম নামের নয় বছর বয়সী এক কন্যা শিশুর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। শিশুটিকে গণধর্ষণের পর হত্যা করে লাশ ফেলে রাখা হয়েছিল। কন্যা শিশুটি স্হানীয় একটি মাদ্রাসার তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী। মীম স্হানীয় বাসিন্দা জামাল ও রাবেয়া বেগমের মেয়ে। তার বাবা কাপড় ধোয়ার কাজ করেন। পুলিশ প্রথমে এ খুনটির মূল রহস্য বের করতে না পারলেও হত্যাকান্ডের পাঁচদিনের মাথায় মীম হত্যার মূল কারণ উদঘাটন করতে সক্ষম হয়েছে। একই সঙ্গে শিশু মীমকে ধর্ষণ ও শ্বাসরোধ করে হত্যার সাথে জড়িত ৬ জনকে আটক করেছে পুলিশ। পত্রিকার খবরের সূত্রমতে, আটক ৬ জনই শিশু মীমকে ধর্ষণ করেছে। ঘটনার সাথে জড়িত ৬ ধর্ষক মীমের ধর্ষণকারী হিসেবে পুলিশের কাছে স্বীকারোক্তিও দিয়েছে। এ ঘটনার সাথে আরো এক নরপশু জড়িত। যাকে পুলিশ এখনো আটক করতে পারেনি বলে সংবাদ মাধ্যমে এসেছে। মীমের ধর্ষণকারী হিসেবে যাদের ছবি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে , সেখানে একজন মীমের বাপের বয়সী হবে। সে নরপশুর ছবি দেখলে বুঝা যায়, তার ঘরেও হয়তো মীমের বয়সী সন্তান রয়েছে। কিন্তু শিশু মীমকে ধর্ষণ ও হত্যা করতে গিয়ে এই নরপশুর মনে একবারের জন্যও ভাবনা আসেনি যে, সে কতো বড় জঘণ্য, ঘৃণিত অপরাধে লিপ্ত হচ্ছে।
বর্তমানে আমাদের সমাজে ধর্ষণ একটি আতঙ্কের নাম। সভ্য সমাজে ধর্ষণকে সব থেকে বড় এবং ঘৃণ্য অপরাধ বলে গণ্য করা হয়। আজকাল পত্রিকার পাতায় চোখ রাখলে লোমহর্ষক ধর্ষণের ঘটনায় আঁতকে উঠতে হচ্ছে আমাদেরকে প্রতিনিয়ত। শিশু, কিশোরী, তরুণী, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থী এমনকি কর্মজীবী নারীরাও প্রতিনিয়ত ধর্ষণের শিকার হচ্ছে যা অন্তরালেই রয়ে যায়। নরপশু ধর্ষকরা দুধের বাচ্চা থেকে শুরু করে ৬০- ৬৫ বছরের বৃদ্ধা নারীদেরকেও ধর্ষণ থেকে রেহায় দিচ্ছেনা। বিকৃত মানসিকতা ছাড়াও বিশেষ করে পারিবারিক বিরোধ, প্রতিহিংসা, লোভ-লালসা ও স্বার্থের দ্বন্দ্বের বলি হচ্ছে শিশুরা। শিশু মীমও বিরোধের বলি হলো। পত্রিকার ভাষ্যমতে, ‘বিজয়ের মায়ের সঙ্গে মীমের মায়ের টাকাপয়সা নিয়ে বিরোধ ছিলো। সেই বিরোধের শোধ নিয়েছে বখাটে বিজয়। মাস ছয়েক আগে এনজিও সংস্থা ব্র্যাক থেকে মীমের মা রাবেয়া বেগমের মাধ্যমে ৫০ হাজার টাকা ঋণ নেন ধর্ষক বিজয়ের মা শিল্পী বেগম। কিন্তু বিজয়ের মা শিল্পী বেগম ঋণ শোধ না করায় সেই ঋণের বোঝা এসে পড়ে মীমের মা রাবেয়ার উপর। এটা নিয়ে তাদের মধ্যে কয়েকবার ঝগড়া হয়েছে। ঋণের টাকা পরিশোধ না করা নিয়ে ঝগড়াকে কেন্দ্র করেই শিল্পী বেগমের বখাটে ছেলে বিজয় ও তার পাঁচ সহযোগীর দ্বারা শিশু মীম প্রথমে ধর্ষণ এবং পরে শ্বাসরোধ করে হত্যার শিকার হলো।

এরকম ঘৃণ্যনীয় অপরাধ করার ব্যাপারে যে মনস্তাত্ত্বিক শক্তি দরকার, অপরাধীদের এই শক্তির জোগানদাতা কে? এই প্রশ্নটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। অধিকাংশ গণধর্ষণ বা একক ধর্ষণের পেছনে, অপরাধীদের শক্তি জোগায় তার রাজনৈতিক পরিচিতি অথবা আর্থিক শক্তির জোর। ধর্ষণ অপরাধের প্রণোদক আর্থিক শক্তিরও পেছনে সাহস জোগায় কালো টাকা ও রাজনৈতিক ক্ষমতা।
আমরা মীমের ধর্ষণকারী ও হত্যাকারীদের সর্বোচ্চ দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছি। কিন্তু এখানে আমাদের সংশয় আছে। কারণ অধিকাংশ সময় দেখা যায়, ধর্ষকরা রাজনৈতিক শক্তিতে বলীয়ান হয়ে এসব অপকর্ম করে নির্ভয়ে। আবার অধিকাংশ ধর্ষণ ও হত্যাকান্ডের ঘটনার সাথে রাজনীতি জড়িয়ে যায়। যার দরুন অনেক সময় এসব অপরাধের শাস্তি দেবার ক্ষমতা স্থানীয় প্রশাসনের থাকেনা। তার বাস্তব প্রমাণ হলো চট্টগ্রামের কর্ণফুলী উপজেলার বড় উঠান ইউনিয়নের চার নারী ধর্ষণের ঘটনা। ঘটনার শুরুতে রাজনীতি জড়িত ছিল বলে ঐ ঘটনার এক সপ্তাহ পর থানায় মামলা রুজু হয়।
আরো দেখা যায়, ধর্ষক বা ধর্ষকগোষ্ঠী কোনো না কোনোভাবে ক্ষমতাবান রাজনৈতিক শক্তির অংশীদার। ধর্ষক ভাবে, তার অপরাধ যাই হোক না কেন ক্ষমতা আর টাকার জোরে সে প্রচলিত আইন ও আদালতকে তার নিজের পক্ষে ব্যবহার করতে পারবে। এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায় ধর্ষক বা ধর্ষকগোষ্ঠীর রাজনৈতিক, আর্থিক ক্ষমতার কাছে মাথা নত করে থানা, পুলিশ, তদন্ত কর্মকর্তা, প্রশাসন, আদালত, সাক্ষী, ধর্ষণ আলামত পরীক্ষাকারী চিকিৎসক ও হাসপাতাল। ফলে অপরাধীরা এক ধরণের দায়মুক্তি পেয়ে যায়। আমাদের প্রত্যাশা, মীমের ধর্ষণের বিচারটিতে যেনো রাজনীতি ও টাকার কাছে মাথানত না করে।
নারীরা আজ কোথাও নিরাপদ নয়। পরিবারের সদস্য, শ্বশুরালয়, কর্মস্থলের সহকর্মী ও গৃহকর্তা-কর্ত্রী কারো কাছেই যেন নিরাপদ নয় নারী-শিশু। সামাজিক অস্থিরতার কারণে প্রতিনিয়ত নারী শিশুরা নিগ্রহ, নির্যাতন, ধর্ষণ ও হত্যাকান্ডের শিকার হচ্ছে । সমাজের কন্যা শিশুরা বিকৃতমস্তিষ্কের বিকারগ্রস্ত, বিকৃতকামী মানুষের সহজ শিকার। সরলতার সুযোগ নিয়ে সহজে ভোলানো যায় অবুঝ শিশুদের। শিশুরা বুঝতে পারে না, চিনতে পারে না নর পিশাচের থাবা। আর বুঝলেও করতে পারে না প্রতিবাদ, প্রতিরোধ। ধর্ষণের বিরুদ্ধে শাস্তির বিধান থাকলেও সে বিধান কার্যত বাস্তবায়ন হচ্ছেনা ধর্ষকের ক্ষেত্রে। একজন খুব সহজেই মুক্ত হওয়ার পর আরো বেপরোয়া হয়ে উঠছে ধর্ষকগোষ্ঠী। এভাবে সহসা বিনা বিচারে ধর্ষণকারীরা পার পেয়ে যাওয়ার ফলে আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে নারী শিশু ধর্ষণের ঘটনা। শিশুর প্রতি এ ধরনের পাশবিকতা আমাদের সামাজিক নিরাপত্তার সংকট কতোটা প্রকট তার ইঙ্গিত দেয় শিশু মীমের হত্যাকান্ড। ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক বিচার না হওয়ায় এখন শিশু ধর্ষণ আরো প্রকট বৃদ্ধি পেয়েছে। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, সমাজপতিরা ধর্ষকের সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করেন। তাই ঘটনার শিকার দরিদ্র পরিবারগুলো সামাজিক বাধ্যবাধকতা মানতে গিয়ে এমন নির্মমতার বিচার চাওয়ারও সাহস দেখান না। শিশু মীমের পরিবারও একটি দরিদ্র পরিবার। জানি মীমের পরিবারও বিড়ম্বনার শিকার হবেন।
নারী ও শিশু নির্যাতনের কঠোর আইন বাংলাদেশে বিদ্যমান আছে। কিন্তু সেগুলোর যথাযথ প্রয়োগ নেই। বিচারের দীর্ঘসূত্রিতা, আইনের শাসনের অকার্যকারিতা, প্রভাবশালীদের হস্তক্ষেপ প্রভৃতি কারণে নারী ও শিশু ধর্ষণ বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না। এই জন্যই দিনে দিনে শিশু ও নারী ধর্ষণ বেড়েই চলেছে।
অন্যদিকে মীমের প্রতি এতটা নৃশংসতা আমাদের মানবিকতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে । মীম, আমাদের ক্ষমা করো। তোমার জন্য আমরা কিছুই করতে পারলাম না। শুধুমাত্র এতটুকু জানি, আমাদেরকে আরও বেশি মানবিক হতে হবে। যা আমাদের পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র শেখাবে। আর সেটা যদি শিখতে পারি তাহলে তোমার মতো অন্যকোন মীম’কে এরকম নির্মম নৃশংসতার শিকার হতে হবেনা।
_________________________
লেখক: মাহবুবা সুলতানা শিউলি
মেম্বার, বোর্ড অব ট্রাস্টিজ
কক্সবাজার ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি