ইমাম খাইর, সিবিএন:
বাংলাদেশী পাসপোর্টে মালয়েশিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমাচ্ছে রোহিঙ্গারা। এদের বিদেশে পাঠানোকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে শক্তিশালী দালালচক্র। তারা মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশী নাগরিক সাজিয়ে পাসপোর্ট দিয়ে বিদেশ পাঠাচ্ছে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, ট্রাভেল এজেন্সি, দালাল, বিভিন্ন এয়ারলাইন্সের কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং পুলিশ এ সিন্ডিকেটের সহযোগী বলে অভিযোগ দীর্ঘদিনের। দায়ী করা হচ্ছে দুর্বল পুলিশ ভেরিফিকেশনকে।

রবিবার (৪ ফেব্রুয়ারী) বাংলাদেশী পাসপোর্ট নিয়ে মালয়েশিয়া যাওয়ার পথে কক্সবাজার বিমান বন্দরে মিয়ানমারের এক নারীকে আটক করে কক্সবাজার মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। এসময় তার সঙ্গে থাকা আবুল ওসমান (৩৫) নামে আরেক রোহিঙ্গা যুবককে আটক করা হয়। সে কুতুপালং ৪ নং ব্লকের ডি-৪ এর বাসিন্দা। প্রথমে ওই রোহিঙ্গা নারী আবুল ওসমানকে নিজের স্বামী বলে পার পেয়ে যেতে চায়। অবশ্য পরে স্বীকার করেছে, আবুল ওসমান তার ভাইশ্বশুর। স্বামী আবু তাহের এক বছর আগে থেকে মালয়েশিয়া থাকে। গত রমজান মাসে তাদের বিয়ে হয়।

দালালের মাধ্যমে বাংলাদেশী পাসপোর্ট বানিয়ে মালয়েশিয়া পাড়ি জমানোর কথা রোহিঙ্গা নারী নিজেই স্বীকার করেছে। সে জানায়, সব কিছু স্বামী মালয়েশিয়া থেকে করেছে। বেসরকারী বিমান রিজেন্ট এয়ারওয়েজের তিনটার ফ্লাইট ছিল তার।

উড়াল দেয়ার আগেই তার যাত্রা আটকে দেয় মাদকদ্রব্য অধিদপ্তরের চৌকশ অভিযানকারীদল। আটককালে রোহিঙ্গা নারীর কাছ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে জাতীয়তা পরিচয় সংক্রান্ত বেশ কিছু ডকুমেন্ট।

ওইসব ডকুমেন্ট অনুযায়ী রোহিঙ্গা নারীর নাম ইয়াছমিন আকতার। পিতা মৃত মোহাম্মদ হোসেন। মাতা নুর নাহার বেগম। ঠিকানা-পশ্চিম নতুনবাহারছড়া, ২ নং ওয়ার্ড, কক্সবাজার পৌরসভা। তার হাতে স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর মিজানুর রহমান স্বাক্ষরিত ভূমিহীন প্রত্যয়নও পাওয়া গেছে। তবে, জিজ্ঞাসাবাদে আটক রোহিঙ্গা নারী নিজের আসল নাম নূর নাহার বেগম, পিতা শামসুল আলম, মাতা শাকিলা বেগম, ঠিকানা বালুখালী অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্প বলে জানিয়েছে। পাসপোর্ট পাওয়ার জন্য সে বাংলাদেশী নাগরিকের ডকুমেন্ট ব্যবহার করেছে বলেও সংশ্লিষ্টদের কাছে স্বীকার করেছে।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর কক্সবাজার এর সহকারী পরিচালক সোমেন মন্ডল সিবিএনকে জানান, মাদকদ্রব্য পাচারের সংবাদে তাদের আটক করা হয়। পরে জিজ্ঞাসাবাদে তারা মালয়েশিয়া যাওয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছে বলে জানায়। তবে, পাসপোর্ট, ভিসা দালালচক্রের হাতে রয়ে যাওয়ায় তা পাওয়া যায়নি। তিনি জানান, আটক দুই রোহিঙ্গাকে উখিয়া থানায় হস্তান্তর করা হয়েছে। বিস্তারিত অনুসন্ধান করে থানা ব্যবস্থা নেবে।

উখিয়া থানার ওসি আবুল খায়ের সিবিএনকে জানান, ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ শেষে স্বজনের কাছে তাদের তুলে দেয়া হয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশি নাগরিক সাজিয়ে পাসপোর্ট দিয়ে বিদেশ পাঠাচ্ছে। এছাড়া রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরগুলোয় ‘জাতীয় পরিচয়পত্র’ বিক্রি হচ্ছে।

প্রবাসী রোহিঙ্গারাই বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া তাদের আত্নীয়দের বিদেশে পাড়ি দেয়ার ক্ষেত্রে করণীয় সবকিছু করতে টাকা দিচ্ছে। চুক্তির ভিত্তিতে জনপ্রতি ৪/৫ লাখ টাকা ব্যয় করে জন্ম নিবন্ধন, জাতীয়তা সনদ, পুলিশ ভেরিফিকেশন, পাসপোর্ট, ভিসা, ইমিগ্রেশন সম্পন্ন করে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশ থেকে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, দুর্বল পুলিশ ভেরিফিকেশন, সত্যায়নকারীর অসাধুতা ও অবহেলা, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের আশ্রয়-প্রশ্রয়, পাসপোর্ট অফিস ঘিরে গড়ে ওঠা দালাল চক্রের সহায়তা, প্রকৃত রোহিঙ্গা চিহ্নিতকরণ জরিপ না করার কারণে তারা পাসপোর্ট পাচ্ছে।

পুলিশ ও পাসপোর্ট অফিসের কর্মকর্তাগণ এ ব্যাপারে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের দায়ী করে বলেন, জনপ্রতিনিধিগণ জাতীয়তা সনদপত্র ইস্যু করে থাকেন। এক্ষেত্রে আমাদের করার বিশেষ কিছু থাকে না।

দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানায়, রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের সামজিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতির জন্য বিশাল সমস্যা। মানবিক কারণে তাদের আশ্রয় দেওয়া হলেও বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়ে বিদেশে যাওয়ার সুযোগ দেওয়া হবে না। তাই কক্সবাজার জেলার বাসিন্দাদের জন্যেও জন্ম নিবন্ধনের পাশাপাশি পুলিশ ভেরিফিকেশনে কঠোর হতে বলা হয়েছে। পাসপোর্ট অধিদপ্তর থেকে সংশ্নিষ্টদের এমন নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু পুলিশ ভেরিফিকেশনের দূর্বলতার কারণে বাংলাদেশী পাসপোর্ট যাচ্ছে রোহিঙ্গাদের হাতে।