এমরান হোসাইন শেখ :
দুর্নীতির দায়ে বিচারিক আদালতে সাজা হলেও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অযোগ্য হওয়ার সুযোগ কম বলে মনে করছেন আইনজ্ঞরা। তাদের মতে, বিচারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করলেই সাজা স্থগিতের পাশাপাশি খালেদা জিয়া নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুবিধা ফিরে পাবেন।
প্রসঙ্গত, রাজধানীর বকশিবাজারে স্থাপিত বিশেষ জজ আদালত জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার রায় ঘোষণা করার দিন ৮ ফেব্রুয়ারি ধার্য করেছেন। দুই কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজর ৬৭১ টাকার দুর্নীতির মামলায় খালেদা জিয়া ও তার ছেলে তারেক রহমানসহ ৬ জন আসামি রয়েছে। আদালতে মামলার শুনানি শেষে দুর্নীতি দমন কমিশনের আইনজীবীরা প্রত্যাশা করছেন, ছয় আসামির সর্বোচ্চ সাজা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হবে। এদিকে নির্দোষ দাবি করে খালেদা জিয়া খালাস পাবেন বলে আশা করছে তার আইনজীবীরা।
সংবিধানে অনুযায়ী, নৈতিক স্খলনজনিত কারণে কারও দুই বছরের বেশি সাজা হলে সাজা ভোগের ৫ বছরের অতিক্রম না হওয়া পর্যন্ত কোনও নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না। এ বিষয়ে সংবিধানের ৬৬ (১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘কোনও ব্যক্তি সংসদের সদস্য নির্বাচিত হইবার এবং সংসদ-সদস্য থাকিবার যোগ্য হইবেন না, যদি…(ঘ) তিনি নৈতিক স্খলনজনিত কোনও ফৌজদারি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হইয়া অন্যূন দুই বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন এবং তাহার মুক্তিলাভের পর পাঁচ বৎসরকাল অতিবাহিত না হইয়া থাকে।‘
সংবিধানের এই বিধানের ব্যাখ্যা দিয়ে আইনজীবীরা বলেছেন, আদালতে দুই বছর বা তারও বেশি সময় সাজা হলে কেউ নির্বাচন করতে পারবেন না, এটা যেমন সত্য, তেমনি নিম্ন আদালতের কোনও রায়ই চূড়ান্ত নয়, সেটাও সত্য। তারা জানান, কোনও আদেশের বিরুদ্ধে আপিল পেন্ডিং থাকলে সত্যিকার অর্থে সাজা হয়েছে বলে ধরা যাবে না। আপিল ফাইল হওয়ার পর ধরে নিতে হবে বিচারিক আদালতে রায় চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে; বিষয়টির চূড়ান্ত সমাপ্তি হয়নি। এর অর্থ বিচারিক আদালতে সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তি নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ পাবেন।
অবশ্য আইনজ্ঞরা আপিল পেন্ডিংয়ের শর্তে বিচারিক আদালতে সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তির নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযোগের পক্ষে মত দিলেও অতীতে কিছু ঘটনার ক্ষেত্রে এর ভিন্ন চিত্র তুলে ধরেছেন। তারা বলছেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নির্বাচনের সুযোগ দেওয়া হলে দুই-একজন বঞ্চিত হয়েছেন। এ বিষয়ে স্থায়ী সমাধানে উচ্চ আদালতের একটি ব্যাখ্যা বা আইনের মাধ্যমে সুস্পষ্ট করা প্রয়োজন বলেও মনে করেন তারা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘নৈতিক স্খলনজনিত কারণে কারও দুই বছর বা তার অধিককাল সাজাপ্রাপ্ত হয় এবং আপিল করা হলে ওই সাজা যদি বহাল থাকে, তাহলে তিনি সাজা ভোগের ৫ বছরের আগে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবেন না। তবে, কেউ যদি সাজাপ্রাপ্ত হয়, তারপর আপিল করে ওই সাজা স্থগিত থাকে এবং ওই ব্যক্তি জামিনে থাকেন; তাহলে নির্বাচন করতে পারবে।
এক প্রশ্নের জবাবে এই সিনিয়র আইনজীবী বলেন, ‘আপিল করতেই বিচারিক আদালতের আদেশ স্থগিত হবে এমন কোনও কথা নয়। এজন্য স্থগিত আদেশ লাগবে। জামিন আদেশ লাগবে।’ এসব মামলার ক্ষেত্রে আপিল গ্রহণ হওয়ার রেওয়াজ রয়েছে বলেও জানান তিনি।
বিচারিক আদালতের রায় কখনোই কনভিকশন নয় উল্লেখ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল বলেন, ‘নিম্ন আদালতের কোনও শাস্তিই চূড়ান্ত নয়। এটি একটি অসম্পূর্ণ রায়। বিচারিক আদালতের শাস্তি উচ্চ আদালতে খারিজ হওয়ার বহু নজির রয়েছে। উচ্চ আদালতে আপিল করার সঙ্গে সঙ্গেই নিম্ন আদালতের দণ্ড স্থগিত হয়ে যাবে। অর্থাৎ সেই মুহূর্তে কেউ আপিল করলে সঙ্গে সঙ্গে তার সাজা স্থগিত হয়ে গেলো। এর অর্থ তিনি অবশ্যই নির্বাচন করতে পারেন।’
খালেদা জিয়ার মামলা প্রসঙ্গ টেনে আসিফ নজরুল বলেন, ‘খালেদা জিয়াকে নির্বাচন থেকে বাইরে রাখার টার্গেট করে সরকার যদি নতুন আইন করে যে, বিচারিক আদালতে কারও সাজা হলে আপিল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত নির্বাচন করতে পারবেন না, তাহলে তার নির্বাচনে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হবে। অবশ্য এ ধরনের আইন হলে তা আদালতে চ্যালেঞ্জ করারও সুযোগ রয়েছে।’
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, ‘নিম্ন আদালতের কোনও সাজাকে চূড়ান্ত মনে করলে ওই সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তির নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার কোনও অধিকার নেই। নিম্ন আদালতের আদেশ তো চূড়ান্ত নয়। কোনও আদেশের বিরুদ্ধে আপিল ফাইল হওয়ার পর তা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলে ধরে নিতে হবে। সেক্ষেত্রে ধরে নিতে হবে যে, সাজাটি নিম্ন আদালতে হয়েছিল তা চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে। এর অর্থ চূড়ান্ত সমাপ্তি এখনও হয়নি। আর জাজমেন্টগুলো যখন ফাইনাল স্টেজ পর্যন্ত নিষ্পত্তি হয়ে যাবে, তখন নিম্ন আদালতের সাজা বহাল থাকে, তাহলে কেবল সাজা ভোগের ৫ বছর অতিক্রান্ত না হয় তাহলে তিনি তার নির্বাচন করতে পারবেন না।’
অবশ্য আপিল পেন্ডিংয়ে নির্বাচনে অংশ গ্রহনের সুযোগ পাওয়া না পাওয়ার ক্ষেত্রে দুই ধরনের উদাহরণ হয়েছে বলে জানান ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া। তিনি বলেন, ‘বিচারিক আদালতে নাসির উদ্দিন আহাম্মেদ পিন্টুর সাজা হওয়ার পর তা আপিলে পেন্ডিং থাকলেও তার প্রতিদ্বন্দ্বিতা বাতিল করা হয়েছিল। আবার একই ধরনের কেসে ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীরসহ আরও অনেকেই প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযোগ পেয়েছেন।’
এক প্রশ্নের জবাবে ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, ‘সংবিধানের বিদ্যমান অনুচ্ছেদ পর্যালোচনা করে এ বিষয়ে আইনের ব্যাখ্যা দিলেও এ বিষয়ে এখনও আইনগতভাবে কোনও সিদ্ধান্ত আসেনি। কাজেই এ বিষয়ে আমরা যে ব্যাখ্যা দিচ্ছি, সেটা যে একমাত্র ব্যাখ্যা, তা বলা যাবে না। এ ধরনের কোনও ইস্যু নিয়ে এখনও কেউ আদালতের শরণাপন্ন হননি। আমার মনে হয়, এই বিষয়ে আদালতের কাছে ব্যাখ্যা চাওয়ার সময় হয়েছে। এটি হলে এ বিষয়ে স্থায়ী একটি সমাধান আসবে।’

-বাংলাট্রিবিউন থেকে সংগৃহীত