হাফেজ মুহাম্মদ কাশেম, টেকনাফ:
পানের অস্বাভাবিক দামে টেকনাফ উপজেলায় পান চাষীরা খুশীতে আতœহারা। সেই সাথে পাল্লা দিয়ে খিলি পানের দামও বেড়ে যাওয়ায় পানে অভ্যস্থ তথা পান খেকোরা চরম বেকায়দায় দিশেহারা হয়ে পড়েছেন বলে জানা গেছে। বর্তমানে টেকনাফ উপজেলার ৬টি ইউনিয়ন এবং ১টি পৌরসভার মধ্যে শুধুমাত্র সাবরাং ইউনিয়ন ব্যতিত অবশিষ্ট ৫টি ইউনিয়ন এবং ১টি পৌরসভা এলাকায় ১ খিলি পান ৭ থেকে ৮ টাকা দরে বেচা-কেনা হচ্ছে। এতদিন ১ খিলি পানের দাম ছিল ৫ টাকা। পানের দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পাওয়ায় খিলি পানের দামও বাড়ানো হয়েছে বলে দোকানীরা দাবি করেছেন। তবে বিগত বছরগুলোতে পানের দাম না বাড়লেও এমনকি এক বিরা (৮০টি পানে ১ বিরা) পানের দাম মাত্র ২০ টাকার সময়ে খিলি পানের দাম ৫ টাকা থেকে না কমানোর যুক্তিতে সাবরাং ইউপি চেয়ারম্যান আলহাজ্ব নুর হোসেন উদ্যোগ নিয়ে খিলি পানের দাম বাড়াতে দেননি। এতে পানে অভ্যস্থ তথা পান খেকোরা সাবরাং ইউপি চেয়ারম্যান আলহাজ্ব নুর হোসেনকে সাধুবাদ জানিয়েছেন।

জানা গেছে, তিন সপ্তাহ আগের চেয়ে বর্তমানে কয়েক গুণ বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে এখানকার উৎপাদিত পান। অন্যান্য বছর এসময়ে যে সাইজের এক বিরা পান মাত্র ২০ থেকে ৩০ টাকা দরে বেচা-কেনা হত, সে সাইজের এক বিরা পান বর্তমানে বেচা-কেনা হচ্ছে ২০০ টাকা থেকে ২৫০ টাকা দরে। পাহাড়ি এলাকায় একবার পানের চাষ করলে প্রায় দুই বছর পর্যন্ত ফলন পাওয়া যায়। সমতল জমিতে ফলন পাওয়া যায় প্রায় নয় মাস। সমতল জমিতে পানের চাষ শুরু হয় অক্টোবরে, শেষ হয় জুন মাসে। আর পাহাড়ি এলাকায় পানের চাষ যেকোনো সময় অথবা বর্ষা মৌসুমে বেশি করা যায় বলে স্থানীয় কৃষকেরা জানিয়েছেন।

উপজেলার সাবরাং ইউনিয়নের নয়াপাড়া, সিকদারপাড়া, টেকনাফ পৌরসভার বাসস্টেশন, সদর ইউনিয়নের বটতলি, লেঙ্গুরবিল, মিঠাপানিরছড়া, বাহারছড়া ইউনিয়নের বড় ডেইল, মাথাভাঙ্গা, শীলখালী, শামলাপুর, হ্নীলা ইউনিয়নের পানখালী, মৌলভীবাজার এবং হোয়াইক্যং ইউনিয়নের কাঞ্জরপাড়া, মিনাবাজার ও হোয়াইক্যং বাজারে পানের বড় বড় বাজার বসে। সপ্তাহে প্রতি রোববার ও বুধবার এই দুই দিন এসব হাটবাজারে পান বিক্রি হয়।

টেকনাফ সদর ইউনিয়নের লেঙ্গুরবিল গ্রামের পান চাষী আমির আহমদ বলেন ‘২০-২৫ বছর আগে এক বিরা বিক্রি হয়েছে ৫০ থেকে ৮০ টাকায়। এরপর গত বছর বিক্রি হয় ১৫০ থেকে ২২০ টাকায়। এখন চলতি মৌসুমে সেই পান ছোট-বড় আকার ভেদে বিক্রি হচ্ছে ৪৫০ থেকে ৫৫০ টাকায়’। উপজেলার বিভিন্ন বাজার ঘুরে জানা যায়, গত মাসে এক বিরা পানের দাম ছিল মাত্র ১৫০ থেকে ১৮০ টাকা। এখন সেই পান বিক্রি হচ্ছে ৪৫০ থেকে ৫৫০ টাকা পর্যন্ত। এ রকম পানের দাম অতীতে আর কখনো বাড়েনি।

টেকনাফ সদর ইউনিয়নের নতুন পল্লানপাড়ার পান চাষী সুলতান আহমদ বলেন ‘গত বছর ঘূর্ণিঝড় ‘মোরা’র আঘাতে কোটি কোটি টাকার পানের বরজ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় আমাদের আশঙ্কা ছিল এবার পান চাষ করে খরচ উঠে আসবে না। কিন্তু বর্তমানে বাড়তি দাম পেয়ে আমরা খুশি। হঠাৎ করে পানের দাম অনেক বেড়ে যাওয়ায় লাভের মুখ দেখেছি’। পান ব্যবসায়ী আবদুল গফুর বলেন ‘পাঁচ বছর ধরে ইউরোপে পান রপ্তানি বন্ধ রয়েছে। ইউরোপের বাজার খোলা থাকলে স্থানীয় চাষীরা বেশি লাভবান হতেন’।

সাবরাং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নুর হোসেন বলেন ‘গত বছর ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় চাষীরা অনেকটা হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। কিন্তু তিন সপ্তাহ ধরে পানের বাজার চাঙা হয়ে উঠেছে।

চট্টগ্রাম অঞ্চলের জন্য পান একটি অর্থকরী ফসল। অথচ সরকারিভাবে চাষীদের কোনো ধরনের সহায়তা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেই’।

হঠাৎ করে পানের দাম অতীতের রেকর্ড ছাড়ানোর বিষয়ে টেকনাফ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোহাম্মদ শহীদুল ইসলাম বলেন ‘মিয়ানমার থেকে ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশের কারণে স্থানীয়ভাবে চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় পানের দাম এভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। চলতি মৌসুমে গত বছরের তুলনায় পান চাষ তেমন বাড়েনি। কিন্তু লোকসংখ্যার পাশাপাশি চাহিদা হঠাৎ বেড়ে যাওয়ায় পানের দাম অনেক বেড়ে গেছে। পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র মিয়ানমার থেকে ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গা পালিয়ে উখিয়া-টেকনাফে আশ্রয় নিয়েছে। রোহিঙ্গাদের মধ্যে পানের চাহিদা বেশি থাকায় স্থানীয়ভাবে পানের দাম অনেক বেড়েছে। টেকনাফ উপজেলায় ৪৮০ হেক্টর জমিতে পানের চাষ হচ্ছে। উপজেলার ২ হাজার ৭৫০ জন চাষীর ২ হাজার ৮৯৫টি পান বরজ রয়েছে’।

উল্লেখ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত (ইইউ) দেশগুলোতে রপ্তাণী হওয়া বাংলাদেশের পানে ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া স্যালমোনেলার অস্তিত্ব পাওয়ায় বর্তমানে পান রপ্তাণীতে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। ২০১৪ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারী প্রথম দফায় এই নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর থেকে বিদেশে পান রপ্তাণী বন্ধ রয়েছে বলে জানা গেছে।

এদিকে টেকনাফে মিষ্টি পানের চাষ এবং কদর দিন দিন বাড়ছে। সেই সাথে চাষীরাও মিষ্টি পান চাষের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। পর্যটন ও সীমান্ত উপজেলা টেকনাফের শত শত পরিবার শুধু পান চাষ করেই জীবিকা নির্বাহ করছে। বছর দু’য়েক আগে যে মিষ্টি পান অন্য জেলা এবং উপজেলা থেকে এনে বিক্রি করা করা হত, সেই মিষ্টি পানের চাষ এখন টেকনাফ জুড়েই হচ্ছে। এখানকার মাটি এবং পরিবেশ অনুকূল হওয়ায় মিষ্টি জাতের পান চাষে সীমান্তের কৃষকরা সফলতার মুখ দেখছেন। আশানুরুপ দাম থাকায় কৃষকগণ লাভবানও হচ্ছেন।

তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, স্থানীয়রা ঝাল পান খেয়ে অভ্যস্ত বলেই টেকনাফের চাষীগণ সনাতন পদ্ধতিতে যুগ যুগ ধরে ঝাল পান বা গাছ পানের চাষ করে আসছেন। পর্যটন এলাকা হওয়ায় বছরজুড়ে টেকনাফে বিভিন্ন জেলার মানুষ আসেন। পর্যটক বা অন্য জেলার বাসিন্দাদের কাছে মিষ্টি পান খুবই জনপ্রিয়। তাঁরা পান হিসেবে সাধারণতঃ মিষ্টি পানই খেয়ে থাকেন। অনুকুল পরিবেশ এবং চাহিদা বাড়ায় এবছর মিষ্টি পানের চাষ করে সীমান্তের অনেক কৃষক লাখপতি হয়েছেন। কৃষকরা জানান চারা রোপনের ৫০-৬০ দিনে পরিপূর্ণ পানে পরিণত হয়। যা থেকে কৃষক সারা বছরই পান বিক্রি করতে পারে। ঝাল পানের গাছ এক মৌসুমেই শেষ হয়ে যায়। কিন্তু মিষ্টি পানের গাছ কয়েক বছরই একই বরজে রাখা যায়। তবে চরাঞ্চলের চেয়ে পাহাড়ী এলাকায় মিষ্টি পানের গাছ বাঁচে দীর্ঘ মেয়াদী। সুবিধা হচ্ছে ঝাল পানের চেয়ে মিষ্টি পানের দাম একটু বেশী। সপ্তাহ পর পর সেচ এবং আধুনিক পদ্ধতিতে সহজে চাষ করা যাচ্ছে বলেই অন্য কৃষকরাও মিষ্টি পান চাষের প্রতি আগ্রহী হচ্ছেন।