আব্দুল্লাহ আল মামুন :
বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারী, বুকের রক্ত দিয়ে ভাষা শহীদেরা রচনা করেছিল বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের ভিত্তি প্রস্তর। এর পর ’৫৪-এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে বিজয়, ’৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৬-এর স্বাধিকার আন্দোলন, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ’৭০-এর জাতীয় নির্বাচনে জয়লাভ, ’৭১-এর ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা সংগ্রামের আহ্বান, ও ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ’৭১-এর ১৬ই ডিসেম্বর আমরা পাই চ’ড়ান্ত বিজয়। তাই একুশ হচ্ছে বাঙালি জাতির আত্মপরিচয় খুঁজে পাবার দিন।
সময়ের সাথে পরিবর্তন হচ্ছে সবকিছুর। পরিবর্তন হচ্ছে ভাষা, সংস্কৃতি, কৃষ্টি, প্রযুক্তি ও আমাদের জীবনধারা। ২১০০ সালে একুশ কি বায়ান্নর একুশের মত থাকবে? ২১০০ সালে কি বাঙালির বৈশিষ্ট, সংস্কৃতির স্বাতন্ত্র্য অক্ষুন্ন থাকবে? আজ থেকে প্রায় আট দশক পর কি হতে পারে তা আমাদের পারিপাশির্^ক পরিবর্তন ও ঘটনা প্রবাহ দেখে কিছুটা আঁচ করা যায়।
একুশে ফ্রেবুয়ারী আজ আর্ন্তজাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি পেয়েছে। সম্প্রতি ঢাকা সফরে এসে ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি বলেছেন, “বাংলাদেশই হচ্ছে বাংলা ভাষার রক্ষক”। এই স্বীকৃতি আমাদের জন্য অত্যন্ত গর্বের। কিছুদিন আগে কলকাতায় যেয়ে প্রনব মুখার্জির মন্তব্যের যথার্থতা খুঁজে পেয়েছি। জীবনানন্দ, কাজী নজরুল আর রবিঠাকুরের কলকাতা শহরে বাংলা অনেকটা নির্বাসনে যেতে বসেছে। দোকানপাট, রাস্তাঘাটে সাধারণ মানুষ, সুযোগ পেলেই বাংলা ছেড়ে হিন্দি বলতে শুরু করেন। কলকাতায় বাঙালির সংস্কৃতিকে যেনো গিলে খাচ্ছে বলিউড। বিস্মত হয়েছি এসব দেখে।
তবে প্রশ্ন হচ্ছে আমাদের রাষ্ট্র, শিক্ষা ব্যবস্থা ও সামাজিক জীবনে, বাংলা ভাষার প্রচলন ও বিকাশ কি আমরা নিশ্চিত করতে পেরেছি? কিছু সাফল্য যে আছে তা নয়, কিন্তু ব্যর্থতার মাত্রা অনেক বেশী। উচ্চশিক্ষায় ও আদালতের কর্মকান্ডে এখনো বাংলা ভাষার ব্যবহার অত্যন্ত সীমিত। আদালতের জজ এবং সরকারি কর্মকর্তারা ইংরেজী ভাষার ব্যবহারে আভিজাত্যের ছায়া দেখতে পান। ভাষা আন্দোলনের মূল দাবী ছিল সর্বস্তরে বাংলা প্রচলন। কিন্তু সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলনের জন্য নির্দেশিত আদালতের রায় এখনও বাস্তবায়িত হয়নি।
আমরা অনেকেই শুদ্ধ করে বাংলা লিখতে পারিনা। ব্লগে ও ফেসবুকের স্ট্যাটাসে তার করুণ প্রতিফলন দেখতে পাই। ভুল হচ্ছে জেনেও বাংলা অভিধানের সাহায্য নিয়ে ভাষা শুদ্ধ করার প্রচেষ্টা নেই আমাদের মাঝে। নতুন প্রজন্মের মধ্যে আধো বাংলা ও আধো ইংরেজী মিশিয়ে, বিজাতীয় উচ্চারণে কথা বলা একটা ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঢাকার কয়েকটা এফএম রেডিওতে সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে ব্যাপারটা লক্ষ্য করেছি। রেডিও ডিজেদের খুবই সপ্রতিভ ও মেধাবী মনে হয়েছে। কিন্তু কথা বলার সময় কেনো জানিনা তারা এক ধরনের মিশ্র ভাষা ব্যবহার করেন। এটা কি আজকের ফ্যাশন না সময়ের দাবী বলতে পারবোনা। ভাষাকে এভাবে লাগামহীনভাবে চলতে দিলে একসময় গতিপথ হারিয়ে দিকভ্রান্ত হয়ে অজানায় হারিয়ে যাবে।
এছাড়া টেলিভিশনেও অনেকে যে ধরনের ইংরেজী-বাংলা মেশানো ভাষায় কথা বলেন তা শুনে আমাদের নতুন প্রজন্মের দর্শকরা কি শিক্ষা নিচ্ছেন তা বলাই বাহুল্য। বায়ান্ন সালের ভাষা আন্দোলন ছিল উর্দু ভাষার প্রভাব থেকে আমাদের মুক্তির লড়াই। কিন্তু এখন হিন্দি ও বলিউড সংস্কৃতির হুমকির মুখে পড়েছে বাংলা ভাষা ও বাঙালির সংস্কৃতি। আমাদের বাড়ীর বৈঠকখানায় রাতদিন চলে হিন্দি সিরয়াল। কাজের বুয়া সহ বাড়ীর সদস্যদের মধ্যে অর্ধেক কথাবার্তা হয় হিন্দিতে। আবার অনেক সময় দেখা যায়, বিভিন্ন অফিসের কর্মকর্তারা নিজেদের ক্ষমতা প্রকাশের জন্য ইংরেজীতে কথা বলতে শুরু করেন। যে যত উঁচু পদের অফিসার, যে তত বেশী ইংরেজীতে কথা বলেন। তিনি ভুল কি শুদ্ধ বললেন, সে নিয়ে ততটা গরজ করেন না। এটা ঠিক, জাতিগতভাবে আমরা রেগে গেলেই ইংরেজীতে খিস্তি-খেউর আওড়াতে থাকি।
সুখের কথা হল, দেশের সবগুলো রেডিও স্টেশনকে শুদ্ধ বাংলা ব্যবহার করে অনুষ্ঠান উপস্থাপনার নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশের তথ্য মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম রেডিও স্টেশনের বিভিন্ন অনুষ্ঠান উপস্থাপনার সময় বাংলা ও ইংরেজির মিশিয়ে ভাষার বিকৃত ব্যবহার বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছেন।
লক্ষ্যণীয়, হিন্দিটা যেমন মধ্যবিত্তের মধ্যে জায়গা করে নিয়েছে তেমনি উচ্চবিত্তের কাছে ইংরেজী সমান জনপ্রিয়। শহরের আনাকে কানাচে গড়ে উঠেছে বিচিত্র নামের ইংরেজী মিডিয়ামের স্কুল। দেখলে মনে হয়, অক্সফোর্ড এবং কেমব্রিজ এখন বাংলাদেশে। সামর্থ্যবানরা তাদের সন্তানদের পাঠান এই সব স্কুলে। আকাশচুম্বী বেতনের এসব স্কুলে সন্তানদের পাঠিয়ে বাবা-মায়েরা ভাবেন, তাদের ছেলে-মেয়েরা বৃটিশ বাবুদের মতো ইংরেজী শিখে ফেলছে। কিন্তু খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, এই সব স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীরা না জানে ভালো ইংরেজী, না জানে ভালো বাংলা।
শুধু ভাষা চর্চা করলেই চলবেনা। আমাদের সাংস্কৃতিক ধারাকেও অব্যাহত রাখতে হবে। ওপারের লেহেঙ্গা এবং অন্যান্য ফ্যাশনে ভরে গেছে আমাদের সাজঘর। বাড়ীর বৈঠকখানাড সিরিয়াল, কথাবার্তা, শিশুদের কার্টুন, অর্ন্তজালে গানের জুকবক্স দিয়ে যেভাবে হিন্দি ভাষার অনুপ্রবেশ হচ্ছে তা খুবই উদ্বেগজনক। বিদেশী স্যাটেলাইট চ্যানেলের প্রভাবে শিশুরা মায়ের ভাষা শেখার আগেই বিদেশী, বিশেষ করে হিন্দি ভাষায় আসক্ত হচ্ছে। প্রিয় কার্টুনের চরিত্রে শিশুরা এমনভাবে ঢুকে পড়ে যে, এক সময় তারা কার্টুনের ভাষায় কথা বলতে শুরু করে। এভাবে চলতে থাকলে ভয়াবহ সঙ্কটের মুখে পড়বে আমাদের মাতৃভাষা এবং বাংলা সংস্কৃতি।
বাংলাদেশে মানসম্মত শিল্পীদের যে আকাল পড়েছে তা নয়; কিন্তু বিয়ের অনুষ্ঠান, গানের অনুষ্ঠান, এমনকি গায়ে হলুদে প্রতিবেশী দেশ ভারতের শিল্পীদের আকাশচুম্বী সন্মানী দিয়ে আনা হচ্ছে। ভারতের বিভিন্ন রিয়েলিটি অনুষ্ঠানে অংশ নেয়া তরুণ শিল্পীদের, স্বদেশী শিল্পীদের চেয়ে ১০গুন বেশী টাকা দিয়ে আনা হ”েচ্ছ । তারা কি সত্যিই এতোটা পারিশ্রমকি পাওয়ার যোগ্য? সেদিন আমার একজন পরিচিত শিল্পপতি মাত্র দু’শ অতিথিদের মনোরঞ্জণের জন্য প্রায় ৫০ লক্ষ টাকা খরচ করে ভারত থেকে শিল্পী নিয়ে আসলেন। ইদানিং দেশের সিনেমা হলগুলোতো হিন্দি ছবি প্রদর্শনের জোর প্রচেষ্টা চলছে। এই ধারা অব্যাহত থাকলে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি খুব সহসা হিন্দি নামক ডাইনসরের পেটে চলে যাবে।
সময়ের সাথে সাথে ভাষা, কথা বার্তার ভঙ্গি, উপমা, সমাজিক আচার, রুচি, মূল্যবোধ, সংস্কৃতি, প্রযুক্তি সহ প্রায় সবকিছুতেই আসছে রূপান্তর। তবে সব রূপান্তর যে বর্জনীয় তা নয়। যেমন সময় সময় বাংলা, ইংরেজী সহ প্রায় সব ভাষাতেই বিদেশী শব্দের অনুপ্রেবশ ঘটেছে। যা ভাষাকে সমৃদ্ধ করেছে। কিন্তু রুপান্তরের প্রভাবে মাতৃভাষার স্বকীয়তা হারালে চলবেনা।
অকাশ সংস্কৃতির হাত ধরে ভিনদেশের সংস্কৃতি বাধভাঙ্গা নদীর ¯্রােতের মতো প্রবেশ করছে আমাদের বাড়ীতে। তবে কোনটা নেবো, আর কোনটা বর্জন করবো, সেই সিদ্ধান্ত আমাদেরই নিতে হবে। বায়ান্ন সালে আমরা যেভাবে উর্দুকে মোকাবেলা করেছিলাম, ঠিক তেমনি ভিন্ন ভাষা ও সংস্কৃতি যাতে আমাদের মায়ের ভাষাকে ছিনিয়ে না নেয় সে জন্য এখনই সচেতন হতে হবে।
“একটি জাতিকে যদি তোমরা পদানত করতে চাও, তাহলে সেই নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে দাও”। এই মূল্যবান কথাটি কে বলেছিলেন, ঠিক মনে নেই। তবে একুশে ফেব্রুয়ারী প্রতি বছর ফিরে এসে সেই কথাটিই যেনো আমাদের মনে করিয়ে দেয়। বাঙলি জাতিকে পদানত করার জন্য পাকস্তানী শাসক গোষ্ঠি আমাদের ভাষাকেই নিশানা করেছিল। কিন্তু বায়ান্নর রক্তঝরা আন্দোলন, সেই দুরভিসন্ধি সফল হতে দেয়নি। তাই আমাদের মায়ের ভাষা, সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য ও জাতি স্বত্ত্বা বাচিঁয়ে রাখার জন্য আগামী দিনগুলোতে, বায়ান্নর একুশই হবে অন্তহীন প্রেরণার উৎস, ও পথ প্রদর্শক।
(লেখকঃ প্রকৌশলী ও গবেষক)