রহিম আব্দুর রহিম

আজকের এই লেখাটি তৈয়ার করার পূর্বে লেখাটির শিরোনাম প্রথমে ঠিক করা হয়, ‘পোড়ালাশ, দোজখ-বেহেস্ত এবং বাস্তবতা’ পরক্ষনেই মনে হল, শিরোনামটি যথাযথ হয় নি। শিরোনামটি হওয়া উচিত, ‘শিক্ষা-অশিক্ষা-কুশিক্ষা বনাম মৃত্যু, অপমৃত্যু, অস্বাভাবিক মৃত্যু’। এবারও মনে হল, শিরোনামটি অন্য কিছু হওয়া উচিত। তবে, সেটা কি হবে? এটাও ঠিক করতে পারছিলাম না। যা নিয়ে লেখা, গত ২৪ ফেব্রুয়ারি বহুল প্রচারিত একটি অনলাইন পোর্টালে প্রকাশিত একটি সংবাদ শিরোনাম ছিল, ঠাকুরগাঁওয়ে বাথরুম থেকে মাদ্রাসা ছাত্রের মরদেহ উদ্ধার।’ যে সংবাদটি পরের দিন ঠাকুরগাঁও থেকে প্রকাশিত স্থানীয় দুটি পত্রিকাসহ, দেশের বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকায় বিভিন্ন শিরোনামে প্রকাশ হয়েছে। প্রকাশিত সংবাদটির সারসংক্ষেপ, ঠাকুরগাঁও নিশ্চিন্তপুর ফয়েজে আম কওমী মাদ্রাসার বাথরুম থেকে শনিবার সকালে মো. আবু বকর (১৬) নামে এক ছাত্রের পোড়ালাশ পুলিশ উদ্ধার করেছে। নিহত আবু বকর, ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার জগন্নাথপুর ইউনিয়নের বাহাদুরপাড়া গ্রামের সিরাজুল ইসলামের ছেলে। ছেলেটি গত ৩ বছর আগে এই মাদ্রাসার হেফজ শাখায় ভর্তি হয়। এ ঘটনায় ওই প্রতিষ্ঠানের ৮জন শিক্ষক এবং নিহত আবু বকরের ৩ সাথীসহ ১১ জনকে পুলিশ গ্রেফতার করেছিল এর মধ্যে পুলিশ বিভিন্ন জিজ্ঞাসাবাদ শেষে গত ২৭ ফেব্রুয়ারি ১০জনকে পুলিশ ছেড়ে দিয়েছে। নিহত আবু বকরের জনৈক প্রতিবেশি জানিয়েছে, আবু বকর মাদ্রাসায় যাওয়ার সময় তার বাড়ি থেকে দুইশত টাকা নিয়ে মাদ্রাসায় গিয়েছে। তার একনিকট আত্মীয় জানিয়েছে, এটা হত্যাকান্ড। এব্যাপারে ওই প্রতিষ্ঠানের একজন শিক্ষক’এর ধারণা, আবু বকর মাদ্রাসায় পড়াশোনা করতে অনাগ্রহী তার পরিবারের চাপাচাপিতে আবু বকর আত্মহত্যা করতে পারে। ঠাকুরগাঁও’র ওসি আব্দুল লতিফ মিয়া বলেছেন, তদন্ত সাপেক্ষে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সংবাদ শিরোনাম থেকে বুঝা যাচ্ছে, ১৫ বছর বয়সের এই কিশোর শিক্ষা নামক সোনার হরিণ ধরতে গিয়েই পরিস্থিতির শিকার। ঘটনাটিকে অপমৃত্যু, স্বাভাবিক মৃত্যু বা মৃত্যু না বলে পরিস্থিতির শিকার বললাম; কারণ খুন- ধর্ষণের মত অপরাধে কাউকে অপরাধী করার আগে ঘটনার ব্যাপক বিশ্লেষণ হওয়ার প্রয়োজন। এক্ষেত্রে কিছু প্রশ্ন অবশ্যই সামনে আনতে হবে। নিহত আবু বকর কেন গায়ে আগুন দিয়ে আত্মহত্যা করবে? তাকে কেন মেরে ফেলা হবে? তাকে মেরে ফেলার পিছনে কার কি স্বার্থ থাকতে পারে? তাকে যদি মেরেই ফেলা হয়, তবে সেটা কি পরিকল্পিত, নাকি অনাকাঙ্খিত? প্রথম প্রশ্নের বিশ্লেষণ; ব্যাপক নির্যাতন এবং চাপিয়ে দেওয়া শিক্ষা গ্রহনে অনীহার হাত থেকে মুক্তি পেতে সে আত্মহত্যা করতে পারে। কিন্তু গায়ে আগুন দিয়ে আত্মহত্যা কেন? ধরে নিলাম গায়ে আগুন দিয়েছে, মৃত্যুর আগে বাঁচার প্রবল আকুতিতে সে দৌঁড়াদৌঁড়ি, ছুটাছুটি করার কথা, কিন্তু এ ধরণের কোন লক্ষণ পাওয়া যাচ্ছে কি না? ঘটনাস্থলের প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্য মতে, ‘পোড়াগন্ধ পেয়ে কিছু লোকজন বাথরুমের দিকে যায়, বাথরুমের সিটকানী ভেঙ্গে তারা দেখতে পায় পোড়ালাশ, এরপর তারা পুলিশকে অবহিত করে। পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে পোড়ালাশ উদ্ধার করে! ধারণা করা অমূলক হবে না যে, এই লাশের গায়ের কোন আঘাতের চিহ্ন, নিশ্চিহ্ন করার উদ্দেশ্যে কে বা কারা গায়ে আগুন দিয়ে আত্মহত্যার নাটক তৈয়ার করতে পারে।

এই ঘটনা উদঘাটনে লেখাটির প্রারম্ভিক খসড়া, ‘পোড়ালাশ-দোজখ-বেহেস্ত এবং বাস্তবতা।’ এই শিরোনামের বিশ্লেষণ, সভ্যতার পরম যুগে আমরা এখনও চরম অন্ধত্ব-কুসংস্কারের অতল গহ্বরে ডুবে আছি। এখনও দোজখ-বেহেস্তের ভয় দেখিয়ে আমাদের ধর্মীয় অনুভূতি জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করা হয়। কোরআন, হাদীস, নবী-রাসুলের আদর্শ বিকৃত করে, পাড়ায় পাড়ায় ব্যাঙের ছাতার মত গড়ে উঠছে নুরানী, কওমী, আলিয়া, এতিমখানার মত বহুবিধ প্রতিষ্ঠান। যেখানে শুদ্ধ উচ্চারণে কোরআন হাদীস পড়ানো, পরকালে বেহেস্ত পাওয়ার দীক্ষা এবং বেহেস্তের সাকি-সুরা পাওয়ার দিক নির্দেশনা। মগজে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় শহীদিমন্ত্রণা। অথচ যে সুরা আয়াতের অর্থের বিশ্লেষণ হলে পৃথিবীর কোন মানুষ, ধর্মের নামে পরকালের সওদা করার মত অন্ধ বিশ্বাসে মুগ্ধ হত না। কোরআন হাদীসে স্পষ্ট করা হয়েছে, ‘ইহকালে সুষ্ঠু, পরিচ্ছন্ন বৈধভাবে গতর খেঁটে যে ব্যক্তি, পরিবার , গোষ্ঠী জীবন ধারণ করবে, একমাত্র সেই ব্যক্তি, পরিবার, গোষ্ঠীর উপর আল্লাহ তায়ালা পরকালে শান্তি বর্ষণ করবেন। একথাও উল্লেখ রয়েছে যে, তুমি পড়, বুঝ এবং আমল কর। অর্থাৎ জানবে, তা বুঝবে এবং অর্জিত জ্ঞান কর্মে প্রকাশ করবে। অথচ অদ্ভুত এই প্রতিষ্ঠানগুলোতে পরিচ্ছন্নভাবে এই পৃথিবীতে কর্ম করে বাঁচার কোন জীবনমুখী শিক্ষা প্রদান করা হয় না। তবে একটি শিক্ষা আছে, শিক্ষার্থী ধনী হোক আর দরিদ্র হোক, ‘দেন গো আল্লাহর রাস্তায় দেন’ নির্লজ্জভাবে মানুষের দ্বারে হাত পাতা। এই সমস্ত প্রতিষ্ঠানে অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের পাঠিয়ে মনে করেন, ওস্তাদের বেত্রাঘাত সন্তানের পরকালের বেহেস্ত পাওয়ার পথ প্রশস্ত করবে। অথচ মহানবী (সা:) এর জীবনাদর্শে স্পষ্ট হয়েছে, তিনি শিশুদের ভালবাসতেন, তিনি ঘোড়া সেজে তার নাতিদের পিঠে চড়িয়ে খেলা করতেন। রাস্তায় শিশুদের সাথে দেখা হলে তাদের সালাম দিতেন, তাদের খেলার সাথি হতেন। মসজিদে প্রথমে তবারক বিতরণ করতেন শিশুদের মাঝে। আর এখন নবী রাসুলের আদর্শ বহণকারী বলে পরিচয়ধারীদের গড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নেই শিশুতোষ খেলাধুলা, রক্তরাঙা ভয়ঙ্কর চোখ আর দজ্জালের লাঠি দিয়ে শিশুদের শিক্ষা দান করা হচ্ছে। নিহত আবু বকরের আসল হত্যাকারী চিহ্নিত করে সঠিক বিচার করা সম্ভব তখন, যখন এই হত্যাকান্ডের তদন্তকারী কর্মকর্তা, সাংবাদিক সমাজ একত্রিত হয়ে রহস্য উদঘাটনে আন্তরিক হবে। বিচার বহুদুর, তবে নিহতের আত্মা যে বেহেস্তে যাবে এ ধারণা অসংখ্য মানুষ পোষণ করছে। যে কিশোর এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকার ইচ্ছা নিয়ে জন্মেছিল, অথচ তার বাবা-মা’র পরকালের বেহেস্ত পাওয়ার ইচ্ছা পূরণ করতে গিয়ে, যে কিশোর সন্তানের অকালে প্রাণ গেল। সেই সন্তানটি বেহেস্তে যাবে এই অসার বাণী ধারণ করা আদৌ কি যুক্তিযুক্ত?

এবার বিশ্লেষণ, ‘শিক্ষা-অশিক্ষা-কুশিক্ষা বনাম মৃত্যু, অপমৃত্যু, অস্বাভাবিক মৃত্যু।’ শিরোনামটি শিক্ষার বহুবিধ সংজ্ঞা আমরা জেনেছি, সহজ কথায় ‘যে জ্ঞান, অভিজ্ঞতা, দক্ষতা ও যোগ্যতা মানুষকে ইতিবাচকভাবে বাঁচার ক্ষেত্র সৃষ্টি করে এবং বৈধ সম্পদের মালিক বানায়, তাই শিক্ষা। এক্ষেত্রে শারীরিক, মানসিক ও পুঁথিগত বিদ্যার গাঁথুনী একজন মানুষকে পরিপূর্ণ যোগ্য করে তোলে।’ পরকালের কান্ডারী এই প্রতিষ্ঠানগুলোতে কি আদৌ মানুষকে পরিচ্ছন্নভাবে বাঁচার শিক্ষা দেয়া হয়, শারীরিক, মানসিক যোগ্যতা অর্জনে কি প্রতিষ্ঠানগুলোতে শারীরিক চর্চা বা খেলাধুলার ব্যবস্থা রয়েছে? অপরদিকে, ‘যে পরিশ্রম মানুষকে কোন জ্ঞান, অভিজ্ঞতা, দক্ষতা ও যোগ্যতা অর্জনে সহযোগিতা করে না এবং জীবন সংগ্রামে কোন উপকারে আসে না তাই অশিক্ষা।’ ভিক্ষাবৃত্তি, শহীদি চেতনায় মগজ ধোলাই অশিক্ষারই আওতাভুক্ত। তেমনিভাবে ‘যে বিদ্যা মানুষের জীবনে নেতিবাচক উপার্জনে সহযোগিতা করে তাই কু-শিক্ষা।’ একজন শিক্ষিত মানুষের কখনও অপমৃত্যু হয় না। সত্যিকার মানুষ মৃত্যুবরণ করেন। তেমনি, সভ্য শিক্ষিত কোন মানুষ দ্বারা অন্য কোন প্রাণের অস্বাভাবিক মৃত্যু ঘটে না, ঘটতে পারে না। আবু বকরের অকাল মৃত্যুই প্রমাণ করে, সমাজ এখনও কু-সংস্কারেই পরিপূর্ণ। যে সমাজে অন্ধ, অনভিজ্ঞ, অযোগ্য, অ-দক্ষ রাখাল দ্বারা ধর্মীয় শিশু শিক্ষা পরিচালিত হচ্ছে। বর্তমান সরকার শিশুদের উপর থেকে নির্যাতন বন্ধে সুস্পষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন করেছেন। সাধারণ শিক্ষা থেকে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন বন্ধে কঠোর হয়েছেন। অথচ সভ্য দেশে এ কোন ভীনজগতের দানবী কর্মকান্ড! ঘটনাটি অপমৃত্যু, নাকি অস্বাভাবিক মৃত্যু তা উদ্ধার করার দায়িত্ব পুলিশের। তবে ঘটনা পরিকল্পিত নয়, অনাকাঙ্খিত হতে পারে। তবে ঘটনাটি ভিন্ন খাতে প্রবাহের জন্য যদি, গায়ে আগুন দিয়ে আত্মহত্যার নাটক তৈয়ার করা হয়ে থাকে তা অবশ্যই পরিকল্পিত। এক্ষেত্রে পুলিশ প্রশাসনের আন্তরিকতা, সিভিল প্রশাসনের দায়বদ্ধতাই আপাতত ভরসা।

এধরণের ঘটনার স্থায়ী সমাধানে সরকারের সুস্পষ্ট পরিকল্পনা, নির্দেশনা এবং নজরদারিই পারবে, আবু বকরদের মত হাজারো শিশুর উপর শিক্ষার আড়ালে নির্মম নির্যাতন বন্ধ এবং এদের অস্বাভাবিক মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করতে। এক্ষেত্রে সরকারের কালক্ষেপন করার সুযোগ নেই। এই আবু বকরের লাশ সামনে রেখে, সারা দেশে গড়ে ওঠা সকল ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিশুদের উপর মানসিক, শারীরিক নির্যাতন বন্ধ এবং ইহকাল ও পরকালের সু-শিক্ষা দানের পরিচ্ছন্ন নীতিমালা প্রণয়ন ও তা যথাযথ কার্যকর করা এখন সময়ের দাবী।

শিক্ষক, সাংবাদিক, কলামিস্ট ও নাট্যকার

মোবাবাইল: ০১৭১৪-২৫৪০৬৬

E-mail: rahimabdurrahim@hotmail.com