প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু :
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের খ্যাতনামা অধ্যাপক এবং জনপ্রিয় লেখক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল হামলার শিকার হলেন। গত ৩ মার্চ শনিবার বিকালে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এক অনুষ্ঠান চলাকালে তিনি এই হামলার শিকার হন। তাঁর পেছনে থাকা ফয়জুর রহমান নামে এক ব্যক্তি ধারালো অস্ত্র দিয়ে তাঁকে আঘাত করেন। গণমাধ্যমে প্রকাশিত ছবিতে দেখা যায় হামলাকারী ওই যুবক লেখক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালের মাথা বরাবর ঠিক পেছনেই অবস্থান নিয়েছিলেন। সুযোগের জন্য ওতপেতে থাকা ফয়জুর একপর্যায়ে সফল হয়ে গেলেন। কেবল ব্যর্থ হলেন নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিতরা। নিজের প্রিয় এবং অতি চেনা ক্যাম্পাসেই তিনি রক্তাক্ত হলেন। হামলাকারী ব্যক্তি ঘটনাস্থলে আটক হয়েছেন।
আক্রান্ত ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালকে প্রথমে ওসমানী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে নেওয়া হয়। পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাঁকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে রাতে ঢাকার সিএমএইচে নেওয়া হয়। ৫ সদস্যের মেডিকেল বোর্ডের অধীনে তাঁর সুচিকিৎসা চলেছে। অবশেষে ১৪ মার্চ নিজ প্রিয় ক্যাম্পাসে ফিরেছেন।
এই আঘাত কেবল কোন ব্যক্তি বিশেষের উপর নয়, এই আঘাত পুরো জাতির উপরে করা হয়েছে। এই আঘাতে তাঁর যে পরিমাণ রক্তক্ষরণ হয়েছে এর চেয়েও বেশি রক্তক্ষরণ হচ্ছে তাঁর অগনিত ভক্ত এবং জাতির হ্নদয়ে। ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালের মত কিছু আলোকিত এবং বরেণ্য মানুষদের বাদ দিলে আমাদের গর্ব এবং অহংকার করার মত খুব বেশি মানুষ থাকেনা। তাঁদের মত মানুষদের জীবনের পরিণতি যদি এই হয় তাহলে আমজনতা বিচলিত না হয়ে পারেননা।
তাঁর উপর হামলার পর দেশের মানুষ যেভাবে গর্জে উঠেছেন তা দেখে আমাদের প্রাণে এই আশার সঞ্চার হয় যে, এ দেশের মানুষ গুণীর সমাদর করতে জানেন, মানুষের পাশে মানুষ হিসেবে দাঁড়াতে জানেন এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে বরাবরই উচ্চকন্ঠ। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী হামলার পর থেকে এই পর্যন্ত যা যা করেছেন তা এক কথায় দেশের মানুষ তা উনার কাছে আশা করতেই পারেন। আমরা তাতে অশেষ আনন্দিত হয়েছি কিন্তু অবাক হইনি। কারণ এই মানবিক গুণাবলি তাঁর আছে। প্রধানমন্ত্রী হয়েও খেলার মাঠে দেশের সন্তানদের জয়ের আনন্দ যাকে ছুঁয়ে যায় তাঁকে মানুষের বেদনা স্পর্শ তো করবেই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ।
হামলাকারী ব্যক্তির সবদিক বিবেচনায় নিলে বুঝা যায় যে, এই ন্যক্কারজনক এবং বর্বর অপকর্মটি ঘটানোর পেছনে অন্যকোন রহস্য আছে। হামলাকারী যেহেতু আটক হয়েছেন তার থেকে প্রকৃত তথ্য উদঘাটন করা এখন সহজ হবে। হামলাকারী যুবক জিজ্ঞাসাবাদে যা বলছেন তাতে ঘুরপাক খেলে হয়তো বেশিদূর এগোনো যাবেনা। রাজনৈতিক বক্তব্য,
এবং প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার মত মন্তব্যকেও গুরুত্ব না দিয়ে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় তদন্তকার্য এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে সংশ্লিষ্ট তদন্ত কর্মকর্তাদের।
যে যুবক ড. জাফর ইকবালের উপর হামলা করেছেন তিনি কখনও তাঁর প্রতিপক্ষ হতে পারেননা, শত্রুও হতে পারেননা। যে যুবকরা ড. জাফর ইকবালকে অনুকরণ করেন, আদর্শ মানেন, একটি অটোগ্রাফ নেওয়ার জন্য তাঁর পিছু ছাড়েননা সেই আরেক যুবক কেন তাঁর উপর এত ঘৃণা এবং হিংসা পুষে রাখলেন? ড. জাফর ইকবাল তো সেই যুবকের কোন ক্ষতি করেননি! ড. জাফর ইকবাল তাঁর লেখনিতে ধর্ম অবমাননা করেছেন-একথা ফয়জুর কিভাবে জানলেন? ফয়জুরকে কে বা কারা এই ধারণা দিলেন? ফয়জুর এই সম্পর্কে নিজ থেকে ভাল করে জ্ঞান রাখলে এবং জানলে তিনি তো এইভাবে হামলে পড়তে পারতেননা। দিনদুপুরে প্রশাসনিক নিরাপত্তা এবং ছাত্র-জনতার বেষ্টনী ভেদ করে ফয়জুর ড. জাফর ইকবালের উপর রক্তাক্ত হামলা চালানোর আগে তিনি কি নিজের নিরাপত্তার কথা ভেবেছিলেন? অর্থ্যাৎ ফয়জুর সমস্ত বিপদ এবং তার প্রাণের ঝুঁকিকে মেনে নিয়েই পরিকল্পিত এই হামলা করেছেন।
ন্যক্কারজনক এই ঘটনায় একটা বার্তাও আছে। তা হল, আমাদের প্রজন্মের একাংশ ক্রমশ বিপদগামী হচ্ছে। তাদেরকে ভুল বুঝানো হচ্ছে। তাদের মনকে বিষিয়ে দেওয়া হচ্ছে। একজন মানুষের মূল চালিকা শক্তি হল তার নিজের চিত্ত বা মন। বিষে ভরা মন থেকে কখনও ভাল কিছু আশা করা যায়না। তাই একজন মানুষের মধ্যে আমূল পরিবর্তন বলতে তার মানসিক জগতের পরিবর্তন ঘটাতে হবে। একজন মানুষ অপরাধ সংঘটিত করার নেপথ্যে সে কোন ধর্মে বিশ্বাসী, কোন সম্প্রদায়ে তার জন্ম, কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সে বিদ্যার্জন করছে তার চেয়েও বড় বিবেচ্য এবং গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, সে প্রকৃত এবং সুশিক্ষা পেয়ে তার মানসিক বিকাশ এবং পরিবর্তন ঘটাতে পারছে কিনা সেটা। একজন অপরাধী অপরাধ করার আগে থেকে জানে যে, এই অপরাধে তার কঠিন সাজা হবে এমনকি মৃত্যুদন্ডও হতে পারে। এটা জেনেও অনেকটা মেনে নিয়ে অপরাধ সংঘটিত করার এই যে স্পৃহা এবং প্রবণতা এর থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে মানসিক পরিবর্তনের কোন বিকল্প নেই। তার মধ্যে যদি মানসিক শুদ্ধিতা আসে তাহলে তার মধ্যে হিতাহিত জ্ঞান আসবে। হিতাহিত জ্ঞান আসলে পরে সে ধর্ম-অধর্ম, পাপ-পূণ্য, ভাল-মন্দ, সুফল-কুফল বিবেচনা করার ক্ষমতা অর্জন করবে। এতে করে তার মধ্যে অপরাধ প্রবণতা হ্রাস পাবে এবং বিবেক জাগ্রত হবে। বিবেক জাগ্রত হলে কোন অপরাধই তাকে টানতে পারবেনা। তাই আইনের শাসনের পাশাপাশি আমাদের প্রজন্মকে মানসিক বিকারমুক্ত করে গড়ে তোলা প্রয়োজন।
এদিকে হামলার শিকার ড. জাফর ইকবাল শারীরিক শংকামুক্ত বলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করেছেন। দেশবাসী তা দেখেছেন এবং জেনেছেন। কিন্তু ভবিষ্যতে তিনি বিপদমুক্ত হতে পারলেন কিনা জানিনা। উনার মত মানুষকে এই বয়সে এসে যদি এভাবে রক্তাক্ত হতে হয়, শারীরিক আঘাতের ধকল সইতে হয় এটা খুব বেদনার এবং মেনে নেওয়া কষ্টকর।
হে জাতির বিবেক, অসাম্প্রদায়িক চেতনার কান্ডারী, মুক্তচিন্তার মূর্ত প্রতীক আপনি দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠুন। কিছু বিপদগামী মানুষের কথা বাদ দিলে গোটা জাতি এখন আপনার সুস্থতা কামনায় মগ্ন এবং আপনার ফিরে আসার অপেক্ষায় আছেন। আপনি দীর্ঘজীবি হউন।
লেখকঃ সম্পাদক, কক্সবাজার ট্রিবিউন ও আমাদের রামু ডটকম।
আমরা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।