মো:জয়নাল উদ্দীন :
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে শালবন বিহার দেখতে বের হলো একদল শিক্ষার্থী। বিহারের পাশে অবস্থিত বিশ্ববিদ্যালয়ও দেখে আসা হবে, মোস্তাক ভয় পেয়ে বলে ঐখানে পরীক্ষার্থী জানলে বড় ভাইয়েরা চরম র্যাগ দিবে।র্যাগের ভয়ে দর্শন পাওয়া হলো না ঐ শিক্ষার্থীদের স্বপ্নের কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।
জানা যায়, র্যাগিং শব্দের প্রচলিত অর্থ হচ্ছে ‘পরিচয় পর্ব’। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নতুন শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুরাতন শিক্ষার্থীদের একটা সখ্যতা গড়ে তোলার জন্য যে পরিচিতি প্রথা সেটাই র্যাগিং।অধিকাংশের মতে র্যাগিং সংস্কৃতি মূলত মিলিটারি থেকে এসেছে।যেখানে ‘চেইন অব কমান্ড’ মেনে চলতে হয়। আবার, অনেকের মতে, এর প্রথম শুরুটা হয়েছিল গ্রিক সংস্কৃতির সপ্তম ও অষ্ঠম শতকে খেলার মাঠে টিম স্পিরিট নিয়ে আসার জন্য।কালক্রমে যা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুপ্রবেশ করেছে চরম বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে।
এই ঘৃণ্য সামাজিক ব্যাধির আচরণ দ্বারা ব্যক্তির অপূরণীয় শারীরিক-মানসিক ক্ষতি হতে পারে। র্যগিং নাগরিক অধিকার পরিপন্থী, বেআইনি ও শাস্তি যোগ্য অপরাধ। এ ছাড়া দৈহিক-মানসিক পীড়ন, যেকোনো ধরনের অশোভন আচরণ, কারো অধিকারে হস্তক্ষেপ বা কর্তব্যকর্ম থেকে বিরত রাখার চেষ্টা বা মতপ্রকাশে বাঁধাদান।তাছাড়া অন্যান্য আরও অপরাধও র্যাগিং হিসেবে গণ্য হয়।
বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা ও দূরদুরান্ত থেকে ভর্তি পরীক্ষা দিতে আসে ভর্তিইচ্ছুকরা।একজন শিক্ষার্থী চার-পাঁচ মাস প্রস্তুতি নেওয়ার পর তার মনোবলটা মজবুত করে ভার্সিটিতে চান্স পাওয়ার জন্য।ভর্তি পরীক্ষা দিতে এসে পরীক্ষার আগে যদি র্যাগিং এর শিকার হয় তার চাঙ্গা মনোভাবটা আর চাঙ্গা থাকেনা।যেসময় মনোবল আরও বাড়ানোর কথা সেসময় র্যাগিং নামক মানসিক নির্যাতন তার স্বপ্ন পূরণের বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়।
অনেকে মনে করে, র্যাগিং মাধ্যমই আত্বসম্পর্ক বৃদ্ধির হাতিয়ার।তা নাহলে সম্পর্ক বাড়ানো যায়না।বিশ্ববিদ্যালয়ে আত্নসম্পর্ক বাড়ানোর জন্য প্রচুর প্রন্থা রয়েছে। প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্পর্ক বৃদ্ধির জন্য চাবিকাঠি হিসেবে কাজ করে সাংস্কৃতিক সংগঠন, রক্তদাতা সংগঠন, কণ্ঠ চর্চার সংগঠন ,বাংলাদেশ স্টাডি ফোরাম, বিজ্ঞানমনস্ক বিভিন্ন সংগঠন,বি.এন.সি.সি, রোভার স্কাউটসহ বিভিন্ন আঞ্চলিক সংগঠন তো রয়েছে।পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা চান্স পায় তারা কোনো না কোনোভাবে মাল্টিটেলেন্ট এর অধিকারী হয়।ক্যাম্পাসে এ সংগঠনগুলোর মাধ্যমে এক জেলা থেকে অন্য জেলার মধ্যে ভাতৃত্ব ও বন্ধনের সম্পর্ক গড়ে উঠে।
শাস্তি, শাস্তির হুমকি, সতর্কবার্তা কিছুই যেন আটকাতে পারছে না র্যাগিং নামক অপসংস্কৃতিকে। প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে নতুন রূপে, নতুন ঢঙ্গে। প্রতিদিন র্যাগিং নামক অশোভন ঘটনায় মানসিক ও শারীরিকভাবে নির্যাতিত হচ্ছে অসংখ্য শিক্ষার্থী। ব্যাহত হচ্ছে তাদের শিক্ষাজীবন; কারও স্থায়ীভাবে, কারও অস্থায়ীভাবে। কিছু নির্যাতনের ঘটনা প্রকাশিত হচ্ছে ভয়ে আর আতঙ্কে, কিছু অপ্রকাশিতই রয়ে যাচ্ছে। ক্রমান্বয়ে এই ব্যাধি ছড়িয়ে পড়ছে দেশের সর্বস্তরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। হাইস্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়, কোনো প্রতিষ্ঠানই বাদ পড়ছে না। কোথাও পরিমিত মাত্রায় আর কোথাও অতিমাত্রায়।
গণমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, সম্প্রতি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিজ্ঞান এন্ড সাইন্স বিভাগের (৪৭তম ব্যাচ) শিক্ষার্থী মিজানুর রহমান র্যাগিং এর শিকার হয়ে তাঁর বাবাকে চিনতে পারছেনা, চিনতে পারছেনা আপন চাচা-খালুদের। র্যাগিং এর মানসিক যন্ত্রাণায় গ্রাস করেছে ছেলেটিকে।ঠিক মতো খাওয়া-দাওয়া করতে পারিনি অনেকদিন।আত্বীয়-স্বজনরাও মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েছিল।তারাও চিন্তা করেনি আদরের সন্তানটি মানসিক আঘাতে জর্জরিত হবে।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে র্যাগিং সংস্কৃতিটা দেশের সবচেয়ে মেধাবীরাই অনুশীলন করে। এটাকে তারা ‘আদব-কায়দা শেখানো’ও ‘সিনিয়র-জুনিয়র সম্পর্কোন্নয়ন’ ইত্যাদি নামে প্রচার করে। এসবের নামে নবীন শিক্ষার্থীদের জোরপূর্বক বড় ভাইদের নাম মুখস্থ রাখা, সবার সম্মুখে চরম অশ্লীল বই পড়তে বাধ্য করা, পেস্ট খেতে বাধ্য করা, রাতে মশার কামড় খাওয়ানোর জন্য বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখা,মুরগী হয়ে বসিয়ে রাখা, প্রকাশ্যে কোনো মেয়েকে প্রেমের প্রস্তাব দিতে বাধ্য করা, শীতের মধ্যে পানিতে নামানো ও ফুটবল খেলতে বাধ্য করা, সিগারেট খেতে বাধ্য করা, ম্যাচের কাঠি দিয়ে রুম ও মাঠের মাপ নেয়া, কোনো আদেশ না মানলে গায়ে হাত তোলা। এছাড়াও কথার মারপ্যাঁচে বিব্রত করা হয়। এসব কি কোনো নিয়মের আওতায় পড়ে?
সম্প্রতি শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্ধনগ্ন করে ছয় শিক্ষার্থীকে র্যাগিং করা হয়। পরে অর্ধনগ্ন ছবিগুলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে আপলোড করতে বাধ্য করা হয় বলে অভিযোগ উঠে।ক্যাম্পাস সূত্রে জানা যায়, চরম হতাশাগ্রস্থ অবস্থায় আছে শাবির ঐ ছয় নবীন শিক্ষার্থীরা। মানসিক ভারসাম্যহীন অবস্থায় নিরবে অতিবাহিত করছে ক্যাম্পাস জীবন।স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে বেগ পেতে হচ্ছে ঐ শিক্ষার্থীদের।সম্প্রতি শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় র্যাগিং নির্মূলে কার্যকর পদক্ষেপ নিয়েছে।জাবিতে র্যাগিং বন্ধে প্রশাসনে থাকা শিক্ষকরাও মানববন্ধনে অংশ নিয়েছে।
প্রতিটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে র্যাগিং এর বিরুদ্ধে কঠোর নীতিমালা প্রনয়ণ করা থাকে। যদি র্যাগিং প্রমাণিত হয়, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে র্যাগিং এর কারণে ছাত্র/ছাত্রী বহিষ্কারের ঘটনা ঘটেছে। তার পাশাপাশি সাধারণ শিক্ষার্থীরাও তাদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন আনলে মানসিক ব্যাধিটা নির্মুল হবে। সচেতনতা বাড়াতে হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্ত-সংগঠনগুলোকে।
শিক্ষার্থী-গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।সংকলনে ; আব্দুল্লাহ আল যোবাইর।
আমরা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।