রহিম আবদুর রহিম :
নবাগত প্রাণকে ভালবাসে না, আদর দেয় না এই রকম প্রাণি পৃথিবীতে বিরল। মানব সভ্যতায় শিশুর প্রতি ভালোবাসা প্রকট। এরপরও শিশুরা অধিকার বঞ্চিত হয়ে আসছে। কারণে- অকারণে, অভাব- অনটনে, ইচ্ছ- অনিচ্ছায় বা সচেতনতার অভাবেই প্রতিটি মানুষের আশে- পাশে, ঘরে- বাইরে, শিক্ষা- দীক্ষায়, চলা- ফেরায়, খেলা- ধুলায় আমাদের শিশুরা তাদের অধিকার পাচ্ছে ন্।া শিশুদের ঘিরে আছে নানা বৈষম্য। প্রতিবছর ১৭ মার্চ জাতীয় শিশু, ২৯ সেপ্টেম্বর জাতীয় শিশু অধিকার এবং ৩ অক্টোবর বিশ্ব শিশু দিবস পালনের মধ্য দিয়ে শিশু জীবনের কল্যাণের প্রচার- প্রচারনার মহৎ উদ্যোগটি বাস্তবতার সাথে কতটাই বা সঙ্গতিপূর্ণ? শিশুর অধিকার সুনিশ্চিত করতে জাতিসংঘ শিশু অধিকার (টঘঈজঈ) ১৯৮৯ সালের নভেম্বর মাসে সর্বসম্মতিক্রমে গৃহিত হয়। সনদে পৃথিবীর ১৯৩টি দেশ স্বাক্ষর করেছে। ১৯৯০ সালে স্বাক্ষর করেছে বাংলাদেশ। আমাদের শিশুরা বরাবরই ভাল ছিলো এবং আছে। পূরণ হচ্ছে না আমাদের শিশুদের অধিকার। জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদের ৪ মূলনীতি বৈষম্যহীনতা, সর্বোত্তম স্বার্থ, বেঁচে থাকা ও বিকাশ এবং শিশুদের অংশগ্রহণ। এক্ষেত্রে চার মূলনীতির সাথে শিশুদের অধিকারের বাস্তবতার চিত্রের ফারাক পর্বতসম। বৈষম্যহীনতায় গোত্র, বর্ণ, লিঙ্গ, ভাষা, ধর্ম, রাজনৈতিক ভিন্নমত, জাতীয়তা কিংবা সামাজিক পরিচয়, শ্রেণি, জম্মসূত্র কিংবা অন্য কোন মর্যাদা নির্বিশেষে প্রতিটি শিশু কোন প্রকার বৈষম্য ছাড়াই এই ঘোষণার সব ধরনের অধিকার ও স্বাধীনতা ভোগ করবে। কিন্তু তা কি, কোন শিশু ভোগ করতে পারছে? একজন শিশু জানে না তার অধিকার নীতিতে কি আছে। যিনি বা যাঁরা জানেন, তাঁরা, তাঁর শিশুর অধিকার কতটুকু বাস্তবায়ন করছে। রাষ্ট্র পরিচালক বা কোন দাতা গোষ্ঠীর পক্ষে কি করে সম্ভব? শিশুর সত্যিকার অধিকার বাস্তবায়ন। একজন শিশু বেড়ে ওঠে তার পারিবারিক গন্ডি বেয়ে। পর্যায়ক্রমে সে পরিচিত হতে থাকে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, প্রকৃতি- পরিবেশের সাথে। এই শিক্ষা, সংস্কৃতি, স্বাস্থ্য- খাদ্য, বস্ত্র- বাসস্থান নিশ্চিত করার দায়িত্বে নিয়োজিত শিশুর অভিভাবকরা, শিশু পরিপূর্ণ অধিকার বাস্তবায়ন করতে পারছে? উত্তর, সোজা সাফটা, না। কারণ কি? উত্তর, বহুবিধ। অপরিকল্পিত পরিবার, অসচেতন সমাজ ব্যবস্থা, প্রকৃতিগত শিক্ষার অভাব। শিশুদের বুঝে উঠতে না পারা। ধর্মান্ধতা, ত্র“টিপূর্ণ শিক্ষা ব্যবস্থা। খাদ্য- বস্ত্র, বাসস্থান সাধ্যতীত বাস্তবায়ন সম্ভব হলেও শিশুর অংশগ্রহণের অধিকার নানা জটিলতায় অবরুদ্ধ। জাতির ভীত, পরিচ্ছন্ন মানব সম্পদ গড়ে তোলার প্রথম সোপান পারিবারিক শিক্ষা। পরিবার থেকে একজন শিশু যা শেখে, তার কোন ক্ষয় নাই। হতে পারে তা সু-শিক্ষা বা কু- শিক্ষা। বাড়ন্ত শিক্ষার মূলভিত্তি নিশ্চিত করে বিদ্যালয় আঙ্গিনা। যে অঙ্গন ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ রাষ্ট্রের মানব সম্পদ গঠনে সর্বোচ্চ ভূমিকা রাখে। অথচ একজন শিশু’র অধিকার এই দুই জায়গাতেই খর্ব হয়।
আমি একজন শিশু সংগঠক এবং শিক্ষক হওয়ায় শিশুদের সাথে কথা বলে তিক্ত অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি। সাজিদ এখন মাস্টার্স’এ লেখাপড়া করছে। ও ক্লাশ থ্রি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত আমার নাট্য গোষ্ঠীতে কাজ করেছে, ও যখন চতুর্থ শ্রেণিতে, ওর বাবা-মা ভাল ফলাফলের জন্য দুই জন শিক্ষক রেখেছেন। একজন ঘুম থেকে ওঠার পরপর তাকে প্রাইভেট পড়ান, অন্যজন পড়ান স্কুল ছুটির পর বিকাল টাইমে। দুই বেলা প্রাইভেট পড়ার কারণে সাজিদ খেলাধুলা করতে পারে না। প্রতি শুক্রবার আমার কাছে তার এই কষ্টের কথা বলতে গিয়ে প্রাইভেট শিক্ষকদের সে একজনকে সেক্টর কমান্ডার , অন্যজনকে কমান্ডার হিসাবে ব্যঙ্গ করেছে। নাসিবুর রহমান নাবিল, ১০ বছরের এই শিশুর সাথে আমার ভাব গড়ে ওঠে আজ থেকে ছয় বছর আগে। অর্থাৎ প্লে শ্রেণি থেকে। ওর শখ সাইকেল চালানো, ক্রিকেট খেলা, রিমোট কন্ট্রোল গাড়ি চালানো। হঠাৎ তার বাবা-মা তাকে ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত করার জন্য তাকে কওমী মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়েছে। দিনমান যে শিশুটি খেলা আর আনন্দের মধ্য দিয়ে পড়ালেখা করেছে সে এখন আবাসিক প্রতিষ্ঠানে বন্দী খাঁচায়, ‘নাজায়েজ খেলাধুলা (আলেমদের ভাষায়) থেকে এখন বহুদুরে অবস্থান করছে’ এতো গেল এক সাজিদ আর এক নাবিলের কথা। এরকম হাজারও সাজিদ, নাবিল আবদ্ধ রয়েছে বাড়ি- বাড়ি, ঘরে- ঘরে। শিক্ষিত পরিবারের বাবা- মারা, তার সন্তানকে খেলার মাঠে যেতে দেয় না, পড়াশোনার ক্ষতি হবে বলে। কেউ কেউ আবার পাড়ার দুরন্ত ছেলেটির সাথে মিশে তার সন্তান নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, বেশি বেশি কথা বলা শিখছে; এমন অভিযোগ এনে সামাজিক শিক্ষা থেকে শিশুকে বঞ্চিত করছে। পড়াশোনার পাশা-পাশি সহপাঠ কার্যক্রম বিতর্ক, নাটক, নাচ- গান নেহায়েত ‘ফালতু’ কাজ এমন দুঃখজনক কথাও শুনে আসছি। এমন কথা যে, শুধু কতিপয় শিক্ষিত বাবা- মারাই বলে আসছে ঠিক তা নয়। ওই শিশুর প্রাইভেট শিক্ষক, এ ধারণা শিশুর বাবা- মাকে ট্যাবলেটের মত খাইয়ে দিচ্ছে। অথচ শরীর গঠন, মেধা বিকাশ, জড়তা কাটানো, সামাজিক বন্ধন গড়ে তুলতে একজন শিশুকে ধরা বাঁধা ছক থেকে বের করে এনে ক্রীড়া, কালচার, ভ্রমণ বিষয়ক শিক্ষার পরিবেশ দেওয়া অনিবার্য, তা ওই শিক্ষক অভিভাবক জানার পরও প্রাইভেট ক্লাশের সময় ঠিক রাখা ও শিশুর তথাকথিত মঙ্গলের লক্ষে বাবা- মা এমনটি বলছে এবং শিশুকে তেমনটি করাতে বাধ্য করছে। শিশুর উন্নয়ন বা মঙ্গল চাপিয়ে দেওয়া কাজে হয় না। শিশুর ইতিবাচক ইচ্ছা পূরণের মধ্য দিয়েই তা সম্ভব। মাধ্যমিক পর্যায়ের শিশু- শিক্ষার্থীরা শ্রেণিকক্ষে অনেকেই শিক্ষকের কাছে প্রশ্ন করার সুযোগই পায় না। প্রশ্ন করলেই নাকি তারা বেয়াদব বনে যায়। অথচ প্রাইভেট পড়লে এই বিশেষণ ইতিবাচক ধারা পায়। আশ্চর্য! একজন শিক্ষার্থী সার্বক্ষণিক সহযোগি হচ্ছে; তার শিক্ষক। অথচ এ কি হচ্ছে শিক্ষালয়ে! শিশুর অধিকার বাস্তবায়নের এই দূর-অবস্থা কে দূর করবে? ‘কুইনিন জ্বর সারাবে, কুইনিন সারাবে কে?’ বয়সের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ শিক্ষা ব্যবস্থার প্রকোষ্টে বন্দি আমাদের কোমলমতি শিশুরা। দুর্বোদ্ধ, বিদেশী ভাষার বইয়ের বস্তা হেফজখানা, কওমী মাদ্রাসা, এতিমখানা ও কিন্ডার গার্টেনের প্লে- নার্সারীর শিশুদের কাঁধে। সারাক্ষণ পড়া- লেখা, সু- নির্ধারিত ইউনিফর্মের আবরণে শিশুর চাহিদা ঢাকা পড়ে আছে। বিচিত্র ধারার, বহু মাত্রার শিশু- শিক্ষা কতটা যুক্তিযুক্ত, শিশু উপযোগী? এ নিয়ে ব্যাপক গবেষণা, ভাবনা, পরিকল্পনা এখনও হয় নি। বৈষম্যহীনতা, শিশুর অংশগ্রহনের অধিকার বাস্তবায়ন আদৌ সম্ভব কি- না? সন্দেহ আছে। বর্তমান সরকার, জাতিসংঘ শিশু সনদের সাথে সামঞ্জস্য রেখে পরিচ্ছন্ন একটি শিশুনীতি প্রণয়ন করেছেন, যা বাস্তবায়িত হলে আমাদের শিশুরা ‘শিশু স্বর্গের ফুটন্ত মানবসম্পদ’ হিসাবে বেড়ে উঠবে। বর্তমান বাংলাদেশ সরকার শিশুদের শারিরীক অবয়ব এবং সুস্থ দেহ ও মনের ভাবী প্রজম্ম গঠনে আয়োজন করছে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছেলে শিশুদের জন্য বঙ্গবন্ধু ও মেয়ে শিশুদের জন্য বঙ্গমাতা গোল্ডকাপ। চালু হওয়ার কথা মাধ্যমিক স্কুল পর্যায়ের ফুটবল টুর্নামেন্ট। খবরটি শিশু সমাজের জন্য আনন্দের বটে। তবে এখানেও চরম বৈষম্য বিরাজ করছে। অনুষ্ঠিত বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা গোল্ডকাপে সরকারি, বে-সরকারি রেজিস্টার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুরা অংশগ্রহণ করতে পারলেও খেলতে পারছেনা মাদ্রাসার এবতেদায়ী, হেফজখানা, কওমী শাখা এবং কিন্ডার গার্টেন নামক প্রতিষ্ঠানের প্রাথমিক পর্যায়ের শিশু- শিক্ষার্থীরা। ধরে নিলাম, মাদ্রাসায় ধর্মীয় গোড়ামী থাকায় প্রতিষ্ঠান প্রধান, তাঁদের শিক্ষার্থীদের খেলায় অংশগ্রহণ করতে দিচ্ছে না, কিন্ডার গার্টেন, উন্নত শিক্ষার নামে তথাকথিত শিক্ষা প্রদানে ব্যস্ত থাকায়, তারাও আগ্রহী নয়। কিন্তু, রাষ্ট্র পরিচালকরা বা দায়িত্বশীলরা কেনো, এক্ষেত্রে তাদের অংশ গ্রহনের পথ উম্মুক্ত রাখে নি বা উন্মুক্ত করার আইনগত প্রক্রিয়া গ্রহণ করছে না। তবে কি ধরে নেয়া যায় না ? এখনও আমরা ধর্মীয় অন্ধত্বে জীনের বাদশার যুগ আমরা পার করছি। জাতীয় শিশুদিবস, জাতীয় শিশু অধিকার দিবস এবং বিশ্ব শিশু দিবস ঘিরে শহর কেন্দ্রীক যে শোভাযাত্রা, প্রতিযোগিতা আলোচনা হচ্ছে, তা কেনো গ্রাম প্রধান দেশের তৃনমূল পর্যায় হচ্ছে না? স্থানীয় সরকারের আওতাভুক্ত ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, মেম্বার এবং স্কুল-কলেজ, এনজিও প্রতিষ্ঠানগুলো কেনো এক্ষেত্রে এগিয়ে আসছেন না? তবে কি এগুলো লোক দেখানো শিশু- সেবা? একজন চেয়ারম্যান, মেম্বার কি চান না তার ইউনিয়নের শিশুরা সু-নাগরিক হয়ে গড়ে উঠুক? কোন উন্নয়ন ধারার লক্ষস্থলে পৌঁছতে হলে, শহরের পাশা-পাশি তৃণমূল পর্যায়ে তার বিস্তার ঘটাতে হয়। পঁচন ধরা সমাজের শৈশব-কৈশোর এখন দুর্গন্ধে নিমজ্জিত। এখনও নির্যাতন-নিপীড়ন চলছে ধর্মীয় শিক্ষার আড়ালে-আবডালে, অন্ধত্ব, কুসংস্কারে ঘিরে আছে পাড়া মহল্লা, আধুনিকতার নেতিবাচক দিকে হাবুডুবু খাচ্ছে শিশু-কিশোররা; অচল হয়ে পড়েছে প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্রীড়া-কালচার। এই দু:খজনক পরিবেশ থেকে জাতিকে পরিচ্ছন্ন পরিবেশ উপহার দিতে হলে; শিশু অধিকার বাস্তবায়ন অনিবার্য। এক্ষেত্রে শুধু সনদ, নীতি, আইন, সরকার এবং দাতাগোষ্ঠীর দ্বারাই তা সম্ভব নয়। প্রয়োজন, সরকারি নির্দেশনা, সামাজিক জাগরণ, রাজনৈতিক প্রতিশ্র“তি, স্থানীয় সরকারের পৃষ্টপোষকতা, নজরদারি সমন্বিত প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন ।
লেখক : শিক্ষক, সাংবাদিক, কলামিস্ট, নাট্যকার ও শিশু সংগঠক
মোবা: ০১৭১৪২৫৪০৬৬
Email: rahimabdurrahim@hotmail.com
আমরা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।