তাজুল ইসলাম পলাশ, চট্টগ্রাম:
দেশের শীর্ষ স্থানীয় দুই শিল্প গ্রুপের মধ্যে জমি নিয়ে যে বিরোধ সৃষ্টি হয়েছে তার মূলে রয়েছেন মোহাম্মদ নুরুল আলম নামের স্থানীয় এক ব্যক্তি। মূলত তার ছলচাতুরি ও প্রতরনার কারনেই সীতাকু- উপজেলার বাড়বকুন্ডে রেলওয়ের ১ দশমিক ৬৪ একর জায়গা নিয়ে পিএইচপি ফ্যামেলি ও কেএসআরএম লিমিটেডের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে দুপক্ষই থানায় লিখিত অভিযোগ করেন। বিরোধপূর্ণ জায়গাটি নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কয়েকবার উভয় শিল্প গ্রুপের মাঝে চরম উত্তেজনা দেখা দেয়।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, আনোয়ার জুট মিল গেইট এলাকায় অবস্থিত রেলের জায়গাটি নিয়ে উভয় গ্রুপ এরইমধ্যে কয়েকবার সংঘর্ষে জড়িয়েছে। পুনরায় সংঘর্ষের আশঙ্কায় এলাকায় ভীতি ছড়িয়ে পড়েছে।
জানা যায়, ১৯৬৪ সালে সরকার রেললাইন সম্প্রসারণের জন্য ওই জায়গা অধিগ্রহণ করে নুরুল আলমের পূর্ব পুরুষদের কাছ থেকে। পরবর্তীতে রেলওয়ের কাছ থেকে এসব জমির লাইসেন্স নেন নুরুল আলমসহ কিছু ব্যক্তি। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৫ সালের ৩০ জুন পিএইচপি ফ্যামেলি নুরুল আলমসহ চার জনের কাছ থেকে এসব জমির ‘দখল স্বত্ত্ব হস্তান্তর নামা’ মূলে কিনে নেন। অন্য তিনজন হলেন মোহাম্মদ জহিরুল আলম, মোহাম্মদ জানে আলম ও মোহাম্মদ জয়নাল আবেদিন প্রকাশ আলাউদ্দীন। পিএইচপি ফ্যামেলির পক্ষে এসব জায়গা কিনেন পরিচালক মোহাম্মদ ইকবাল হোসেন চৌধুরী। দখল স্বত্ত্ব হস্তান্তর মূল্য ধরা হয় ২০ হাজার টাকা।
অন্যদিকে কেএসআরএম লিমিটেড ওই জায়গার ‘দখল স্বত্ত্ব হস্তান্তরের নাদাবী মুক্তিনামা’ দেন মোহাম্মদ নুরুল আলম, মোহাম্মদ জহুরুল আলম, মোহাম্মদ জানে আলম ও জয়নাল আবেদীনের স্ত্রী সুফিয়া বেগমের কাছ থেকে। ২০১৭ সালের ৮ জানুয়ারি সম্পাদিত নাদাবী মুক্তিনামা মূলে কেএসআরএমের পক্ষে এসব জমি নেন পরিচালক মোহাম্মদ সেলিম উদ্দীন। তখন জমির মূল্য বাবদ কেএসআরএম তাদেরকে পরিশোধ করে তিন লাখ টাকা।
ওই নুরুল আলমই রেলওয়ের অধিগ্রহণ করা জমি নিজের নামে বিএস খতিয়ান সৃজন ও জাল জালিয়াতি করে তা পিএইচপির কাছে বিক্রি করেন। পরে আবার একই ব্যক্তি রেলওয়েকে না দাবি দিয়ে তা কেএসআরএমকে পেতে সহায়তা করেন। মূলত তার জাল-জালিয়াতির কারণে দেশের দুই শীর্ষস্থানীয় শিল্পগ্রুপের মধ্যে রেলের এই ভূমি নিয়ে বিরোধের সৃষ্টি হয়েছে। নুরুল আলমদের হস্তান্তরের পরিপ্রেক্ষিতে পিএইচপি ফ্যামেলি ও কেএসআরএম লিমিটেড রেলওয়ের কাছে ওই জমির কৃষি লাইসেন্সের জন্য আবেদন করে। রেলওয়ে পিএইচপি ফ্যামেলি, কেএসআরএম লিমিটেড ও নুরুল আলমকে নিয়ে ত্রিপক্ষীয় শুনানী করে। শুনানী শেষে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ কেএসআরএমের পক্ষে সেলিম উদ্দীনের নামে লাইসেন্স দেয়।
এদিকে পিএইচপি ফ্লোট গ্লাস ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড ও কেএসআরএম স্টিল প্লান্ট এবং বিরোধপূর্ণ জায়গা সরেজমিন পরিদর্শন করে চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয়ে একটি প্রতিবেদন দাখিল করেছেন সীতাকুন্ড উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) মোহাম্মদ কামরুজ্জামান। তিনি বিরোধপূর্ণ ওই জায়গার বিষয়ে রেলওয়ের কাছে মতামত চাওয়ার সুপারিশ করেছেন। তারও আগে ওই জায়গায় কেএসআরএম লিমিটেডের দেয়া কংক্রিটের খুঁটি ও কাঁটা তারের বেড়া অপসারণপূর্বক জবাব দেওয়ার জন্য চিঠি দেয় রেলওয়ের বিভাগীয় ভূ-সম্পত্তি কর্মকর্তা।
বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয়ে দাখিল করা প্রতিবেদনে নুরুল আলমদের লাইসেন্সকৃত ১ দশমিক ৬৪ একর ভূমি পিএইচপি ফ্যামেলির অনুকূলে দখল স্বত্ব হস্তান্তর করার পরও একই ভূমি কেএসআরএম লিমিটেডের কাছে কৃষি লাইসেন্স দেওয়ার জন্য না দাবি বিধি সম্মত হয়নি বলেও উল্লেখ করা হয়।
গত ১০ এপ্রিল কেএসআরএম’র সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন এই নুলল আলম। ওই সময় তিনি সাংবাদিকদের প্রশ্নে বলেছিলেন, ২০১৭ সালে তিনি রেলওয়ের জায়গাটি ইজারা হন্তান্তর মূল্যে কেএসআরএম’র কাছে বিক্রি করেন। রেলওয়ের মধ্যস্থতায় ত্রিপক্ষীয় শুনানীর মাধ্যেমে জায়গাটি কেএসআরএম এর কাছে সে সময় হস্তান্তর করা হয়। এর আগে চট্টগ্রাম রেলওয়ের ইজারা দেয়া ১ দশমিক ৬৪ শতক জায়গা নিয়ে দ্বন্ধে জড়িয়ে পড়ে শীর্ষস্থানীয় শিল্প গ্রুপ পিএইচপি ও কেএসআরএম।
পিএইচপি গ্রুপের ডিজিএম (এস্টেট) আমীর হোসেন বলেন, ১৯৬৪ সালে ওই জমি অধিগ্রহণ হয়েছিল। আরএস খতিয়ান মূলে আলোচ্য জায়গার মালিক ছিলেন নুরুল আলমের পূর্বপুরুষ আবদুল করিমসহ অনেকে। পরবর্তীতে তাদের নামে বিএস খতিয়ানও সৃজন হয়। বিএস খতিয়ানমূলেই বিভিন্ন ওয়ারিশের কাছ থেকে ২০০৫ সালে পিএইচপি গ্রুপ এসব জমি কিনেছে। পরবর্তীতে ১৯৮০ সালে রেলওয়ে থেকে ওই জমি নুরুল আলম লিজ নিলেও চুক্তির মাধ্যমে দখল হস্তান্তর করেন পিএইচপির কাছে।
কেএসআরএম লিমিটেডের ডিজিএম মো. শাখাওয়াত হোসেন বিরোধপূর্ণ ওই জায়গা প্রসঙ্গে বলেন, ১৯৮০ সালে নুরুল আলম ওই জমির কৃষি লাইসেন্স নেন রেলওয়ে থেকে। তিনি ২০১৬ সাল পর্যন্ত কর-খাজনা পরিশোধ করেন। অপারগ হওয়ায় না দাবি মূলে তা কেএসআরএম গ্রুপের কাছে হস্তান্তর করেন নুরুল আলম। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ ত্রিপক্ষীয় শুনানি শেষে ওই জমির কৃষি লাইসেন্স দেয় কেএসআরএমের পক্ষে পরিচালক সেলিম উদ্দিনের নামে। এখন সহকারি কমিশনার কেন নতুন করে রেলওয়ের কাছে এই জমির বিষয়ে মতামত চাওয়ার সুপারিশ করেছেন তা আমাদের বোধগম্য নয়। নুরুল আলম অন্য কোনো গ্রুপ বা ব্যক্তির কাছে এই জমি হস্তান্তর বা বিক্রির করেনি বলেও দাবি করেন তিনি।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে- রেলওয়ের (পূর্বাঞ্চল) ভূ-সম্পদ কর্মকর্তা ইসরাত রেজা বলেন, গত ২৭ মার্চ ২০১৭ ইং তারিখে পিএইচপি গ্রুপ ও কেআরএসএম গ্রুপের প্রতিনিধিদের নিয়ে ত্রিপক্ষীয় যে দীর্ঘ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। বৈঠকে নির্ধারণ পুর্বেও লীজ গ্রহিতা নুরুল আলমের সম্মতিক্রমে এবং কাগজপত্র পর্যালোচনা করে কেএসআরএম’কে জায়গাটি লীজ দেয়া হয়। তাই এটির বর্তমান মালিক কেএসআরএম। তবে পিএইচপিও লীজ নিয়েছে রেল থেকে সেটা অন্য জায়গা। পিএইচপির নামে ৩টি স্থানে জায়গা লীজ দেয়া হয়েছে।
রেলওয়ের চীফ এষ্টেট অফিসার (পূর্ব) মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন বলেন, জায়গাটি নিয়ে বিরোধ হওয়ার কোন অবকাশই নেই। ১ম ইজারা গ্রহীতা নুরুল আলমের পর ২য় ইজারা গ্রহীতা হিসেবে জায়গাটি কেএসআরএম’কে দেয়া হয়েছে। বর্তমানে জায়গাটির প্রকৃত মালিক কেএসআরএম।
তিনি আরো বলেন, উদ্ভুত পরিস্থিতিতে গত ৩রা মার্চ রেলওয়ের ভূসম্পত্তি বিভাগ জায়গাটি পরিদর্শন করে সম্ভাব্য সকল তথ্যাদি সংগ্রহ করে। রেলওয়ের আইনে মিউটেশনের মাধ্যেমে লাইসেন্সি স্বত্ব হস্তান্তর করার বিধান রয়েছে। যেহেতু নুরুল আলম নোটারি পাবলিকের মাধ্যেমে কেএসআরএম’কে লাইসেন্স ও ভূমি ব্যবহারের অধিকার হস্তান্তর করেছেন সেহেতু জমিটির মালিক কেএসআরএম।
রেলের জায়গা নিয়ে দুই শিল্প গ্রুপের বিরোধ
পড়া যাবে: [rt_reading_time] মিনিটে
আমরা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।