শাহেদ মিজান, কুতুপালং থেকে ফিরে:

২০১৭ সালের ২৫ আগষ্টের পর ৯লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসে আশ্রয় নিয়েছে। পুরাতন আছে ৩ লাখের বেশি। সব মিলে উখিয়া উপজেলার কুতুপালং ও বালুখালী এবং টেকনাফে এখন পর্যন্ত প্রায় ১২ লাখেরও অধিক রোহিঙ্গা রয়েছে। নতুন পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের আসার পর থেকে খাদ্য ও বাসস্থানসহ সব ধরণের সুযোগ-সুবিধা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছে।

সূত্র মতে, বাংলাদেশ সরকার, জাতিসংঘের সহযোগী সংস্থা ও আন্তর্জাতিক ও জাতীয় বেসরকারি সংস্থার সমন্বিত উদ্যোগে এই সুযোগ-সুবিধা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়েছে। এতে রোহিঙ্গারা সুন্দরভাবে জীবন যাপন করছে। কিন্তু আসনে ঘনিয়ে এসেছে বর্ষা। বর্ষায় খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা গেলেও ভূমিধস ও বন্যাসহ প্রাকৃতিক ঝুঁকিতে রয়েছে দু’লাখ রোহিঙ্গা। জাতিসংঘ ও বাংলাদেশ সরকারসহ সহযোগি সংস্থাগুলো এখন ঝুঁকি মোকাবেলা ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অত্যধিক প্রচেষ্টা চলছে। তাই এই নিয়ে জোরসে কাজ করছে সরকার ও সংস্থাগুলো।
সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর তথ্য মতে, পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের জন্য প্রয়োজনের তাগিদে উখিয়ার বালুখালী ও কুতুপালং রোহিঙ্গা শিবিরে অনেক পাহাড় কাটা হয়েছে। বৃষ্টিতে পাহাড় কেটে তৈরি বসতিসহ আরো অনেক এলাকায় ভূমিধসের চরম আশঙ্কা রয়েছে।

অন্যদিকে পানি চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়ে অনেক স্থানে বন্যারও আশঙ্কা করা হচ্ছে। এছাড়াও ঘূর্ণিঝড়ে প্রবল বাতাসেও দুর্যোগ সৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে। এতে দু’লাখ রোহিঙ্গা ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এরমধ্যে ‘চরম’ ঝুঁকিতে রয়েছে ২৫ হাজার রোহিঙ্গা। যেখানে ৪০ হাজার রোহিঙ্গা শিশুও চরম ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ৪০ হাজার রোহিঙ্গা সরাসরি ভূমিধস ও বন্যার ঝুঁকির মুখে রয়েছে। এই প্রাকৃতিক বিপর্যয় এড়াতে না পারলে প্রায় ৬৫ হাজার রোহিঙ্গা স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়বে। এছাড়াও ঘূর্ণিঝড়ে সৃষ্ট অতি বাতাসের ঝুঁকিতে অধিকাংশ বসতি।

আসন্ন বর্ষায় ভূমিধ্বস ও বন্যাসহ প্রাকৃতি দুর্যোগ রোধে বর্তমানে নানা উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তার মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টিকে অগ্রধিকার দেয়া হয়েছে। এছাড়াও ভূমিধ্বস ও বন্যা আক্রান্ত হওয়ার অতি আশঙ্কায় থাকা বসতিগুলো পুন:স্থাপন করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে অনেক বেশ কিছু বসতি পুন:স্থাপিত করা হয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ রোহিঙ্গাদের সরিয়ে সম্প্রসারিত কুতুপালং ক্যাম্পের পশ্চিমপাশে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যে নিরাপদে সরিয়ে নেওয়া শুরু হয়েছে।

গত রোববার কুতুপালংয়ে সরেজমিনে এই প্রতিবেদককে ইউএনএইচসিআর কর্মকর্তা কারোলিন গ্লাক জানান, ভূমিধ্বস ও বন্যাসহ অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলার জন্য রোহিঙ্গাদের জন্য প্রথম দরকার সচেতনতা। ইউএনএইচসিআর এই সচেতনতা কর্মসূচী চালাচ্ছে। কারণ দুর্যোগকালীন মুর্হূতে করণীয় সম্পর্কে জানা থাকলে ক্ষয়ক্ষতি অধিকাংশ কমানো যাবে। তাই রোহিঙ্গাদের পাহাড় ধস এবং দুর্যোগ মোকাবেলায় প্রস্তুত করার জন্য সচেতনতা মূলক বিভিন্ন কর্মসূচি চালানো হচ্ছে। জাতিসংঘ ও অন্যান্য সহযোগি সংস্থাগুলোর কর্মীরা বর্তমানে প্রতিটি রোহিঙ্গাতে বসতি গিয়ে এই সম্পর্কিত বিষয়ে সচেতন করছে। একইসাথে নাটক, গানসহ বিভিন্ন উপায়েও সচেতনতা তৈরি করা হচ্ছে। সচেতনতা কর্মসূচির কারণে রোহিঙ্গারা সে বিষয়ে পূর্ণাঙ্গভাবে জানতে পারছে; যা তাদের কোনোভাবেই জানা ছিলো না। গত রোববার সরেজমিন বিভিন্ন রোহিঙ্গার সাথে আলাপকালে তারা এমনটি জানিয়েছে।

আলাপকালে রোহিঙ্গা জানিয়েছেন, ভূমিধ্বস ও বন্যাসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিষয়ে জানার পর তারা আতঙ্কে ভুগছেন। তবে সংস্থাগুলোর নানা কার্যক্রম ও দুর্যোগ মোকাবেলায় অবহিত হয়ে আতঙ্কা অনেকটা কেটে যাচ্ছে।

আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম) কর্মকর্তা শিরীণ আকতার জানান, বন্যার মোকাবেলার অংশ হিসেবে কুতুপাংলয়ে ৯ কিলোমিটার ছরা খনন করা হচ্ছে। এসব ছরায় প্রয়োজনী স্থানে বসানো হচ্ছে টেকসই কালভার্ট। এর ফলে সহজে পানি নিষ্কাশন হয়ে বন্যার আশঙ্কা রোধ করা হচ্ছে। একই সাথে দুর্যোগকালীন মুহূর্তে যোগাযোগ ব্যবস্থা নির্বিগ্ন করার জন্য সব সড়কের উন্নয়ন কাজ করা হচ্ছে। বাতাসের আক্রমণ থেকে রক্ষার বসতির চালায় দেয়া হচ্ছে বালুর বস্তা।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পের সার্বিক কার্যক্রম সমন্বয় করে যাচ্ছে ইন্টারসেক্টর কো-অর্ডিনেশন গ্রুপ (আইএসসিজি)। এই সংস্থার কমিউনিকেশন অফিসার নায়না বোস জানান, বর্ষা মৌসুমে যাতে কোন অবস্থাতে ভূমিধ্বস বা বন্যায় প্রাণহানি না ঘটে, সেজন্য ব্যাপক প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। এখন আগামী বর্ষা মোকাবেলা করাই একমাত্র চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

তিনি আরও বলেন, এর মূল বার্তা হলো বর্ষা মৌসুমে তারা কিভাবে তুলনামূলকভাবে ভাল থাকতে পারে সেই সম্পর্কে ধারণা দেওয়া। কোন একটি বিষয়কে শক্তিশালী হিসেবে বোধগম্য করার জন্য নাটক শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে কাজ করে।

শরণার্থী ত্রাণ ও পুর্ণবাসন কমিশনার আবুল কালাম আজাদ গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, পাহাড় ধসের প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে রোহিঙ্গাদের রক্ষা করার কাজ শুরু হয়ে গেছে। ঝুঁকিপূর্ণ রোহিঙ্গাদের সরিয়ে সম্প্রসারিত কুতুপালং ক্যাম্পের পশ্চিমপাশে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যে নিরাপদে সরিয়ে নেওয়া শুরু হয়েছে।

রোহিঙ্গারা এখনো বুঝেনা পাহাড় ধসের ঝুঁকি কি। এর ফলে নিরাপদে সরিয়ে নেওয়াও কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই প্রয়োজন তাদের মধ্যে ব্যাপক সচেতনতা সৃষ্টি করা।