প্রিয়.কম : সৌদি আরবে নির্যাতনের মুখে দেশে ফেরা কয়েক ডজন নারী গৃহকর্মী তাদের পরিবার দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন। মূলত ‘সামাজিক কলঙ্ক’-এর ভয়ে পরিবারগুলো সৌদি ফেরত এসব নারী গৃহকর্মীদের গ্রহণ করছেন না।

পরিবারের সদস্য, এমনকি সন্তানদের কাছেও আশ্রয় পাচ্ছেন না এসব নারী। নিরুপায় হয়ে অনেকেই আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন।

কর্মক্ষেত্রে মজুরি থেকে বঞ্চিত হওয়া, যৌন ও শারীরিক-মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়ে গত ৬ মাসে অন্তত ১০০০ নারী সৌদি আরব থেকে দেশে ফেরত এসেছেন। এদের মধ্যে ১২১ জনই ফেরত এসেছেন মে মাসে।

এক মাস আগে সৌদি আরব থেকে দেশে ফেরত এসেছেন বিধবা শান্তা রানী। সংসারের আয় বাড়ানোর লক্ষ্যে দুই ছেলে ও এক মেয়ের জননী এ নারী সৌদি আরবে গিয়েছিলেন। কিন্তু দেশে আসার পর তার ছেলেদের আচরণ পরিবর্তন হয়ে যায়। দুই ছেলেই তাদের মাকে অাশ্রয় দিতে অস্বীকৃতি জানায়।

শান্তা বলেন, ‘ছেলেরা আমাকে আমার বাড়িতেই ঢুকতে দিচ্ছে না। তারা বলছে আমি নাকি আর ভালো নারী নই।’

এমনকি তিনি কেন দেশে ফিরে আসলেন, ছেলেরা সেই প্রশ্নও তুলছে বলে দাবি করেন এই নারী।

ছেলেদের কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়ে শান্তা রানী এখন তার কিশোরী মেয়ের সঙ্গে ঢাকায় বসবাস করছেন।

শান্তা রানী বলেন ‘অামার মেয়ে দশম শ্রেণীতে পড়ছে। তার পড়ার খরচ জোগানোর জন্য আমি রিকশাওয়ালাদের জন্য রান্না করি। নিজের কাজের প্রায়শ্চিত্য করছি আমি।’

আরেক সৌদি ফেরত নারী সখিনা। সৌদি আরবে থাকতেই স্বামী তার সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদ করে। স্বামীর অভিযোগ ছিল, সখিনা সৌদি আরবে তার মালিকের সঙ্গে ‘অনৈতিক কাজ’-এ লিপ্ত হয়ে পড়েছেন।

সখিনা বলেন, ‘বারবার বুঝিয়েও আমার স্বামীকে বিশ্বাস করাতে পারিনি। গ্রামের চেয়ারম্যান-মেম্বাররাই আমার স্বামীর পক্ষ নিয়েছে। তারা আমার স্বামীকে পরামর্শ দিয়েছে যাতে আমাকে ডিভোর্স দেয়। আমার মায়ের ক্ষুদ্র আয় দিয়ে আমি আমার দুই সন্তানের মৌলিক চাহিদা মেটানোর চেষ্টা করছি এখন।’

সৌদি ফেরত আরেক নারী গৃহকর্মী সাবিনা শ্বশুর বাড়ি থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়ে এখন বোনের কাছে আশ্রয় নিয়েছেন।

সাবিনা বলেন, ‘গত ১৫ দিন ধরে আমি বোনের বাড়িতে আছি। আমার স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকজন আমাকে গ্রহণ করেনি। আমি ফিরে আসাতে তারা অসম্মানিত বোধ করছে। আমার অক্ষম স্বামী আয় রোজগার করতে পারেন না। তাই পাঁচ মাস আগে পরিবারের খরচ বহনের জন্য আমি সৌদি আরব গিয়েছিলাম।

পাওনা টাকা চাওয়ার কারণে সৌদি আরবে আমার নিয়োগদাতা ও তার পরিবারের সদস্যরা আমার ওপর কতটা নির্মম নির্যাতন চালিয়েছিল, তা আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না।’

সৌদি ফেরত এমন অনেক সাবিনা, শান্তা, সখিনা তাদের পরিবার থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়ে অনিশ্চিত জীবন যাপন করছে।

ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের প্রধান শরীফুল হাসান জানান, তারা পরিবার থেকে প্রত্যাখ্যাত কয়েকজন নারীকে সনাক্ত করেছেন।

শরীফুল বলেন ‘আমরা এমন এক নারীকে সনাক্ত করেছি যিনি বিমানবন্দরে স্বামীর জন্য অপেক্ষা করছিলেন। কিন্তু স্বামী তাকে নিতে আসেনি। আমরা এরপর তার ভাই ও বাবাকে ফোন করি। কিন্তু তারাও তাকে গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানায়। ওই নারী সারারাত বিমানবন্দরে বসে ছিলেন। পরে আমরা তাকে একটি শেল্টার হোমে পাঠিয়েছি।’

নারীদের প্রতি সামাজিক অবজ্ঞার সমালোচনা করে শরীফুল হাসান বলেন, ‘প্রবাসী নারীদেরও দেশের নারীদের মতো পর্যাপ্ত সম্মান দিতে হবে, কারণ তারা পরিবারের আর্থিক অবস্থা উন্নয়নের জন্যই বিদেশ যাচ্ছে।’

সৌদি আরবে বিভিন্ন দেশের প্রবাসী নারী শ্রমিকদের ওপর নির্যাতন নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়েছে। ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপিন্স এসব অভিযোগে সৌদিতে তাদের দেশের নারী শ্রমিক পাঠানোর সংখ্যা কমিয়ে দিয়েছে। এর ফলে সৃষ্ট শূন্যস্থান পূরণের জন্য সৌদি আরব বাংলাদেশ থেকে বেশি সংখ্যাক নারী শ্রমিক নিচ্ছে।

২০১৫ সালে এ সম্পর্কিত চুক্তির পর এ পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে ২ লাখ নারী শ্রমিক সৌদিতে গেছেন।

এরমধ্যে নির্যাতনের মুখে ৪ হাজার নারী দেশে ফেরত এসেছেন। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নারী সৌদি আরবেই বিভিন্ন আশ্রয় শিবিরে আশ্রয় নিয়ে আছেন।

বাংলাদেশ অভিবাসী মহিলা শ্রমিক অ্যাসোসিয়েশন (বিওএমএসএ) বলছে, বেশিরভাগ নারীই সামাজিক কলঙ্কের শিকার হয়। যেসব স্বামী নিজেরাই বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে এবং স্ত্রী সম্পর্কে উদাসীন থাকে, তারা তাদের স্ত্রীর বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ আনে।

কিন্তু এসব নারীদের সামাজিক নিরাপত্তা সবচেয়ে বেশি দরকার বলে মনে করে সংগঠনটি।

(প্রতিবেদনটি ফিনান্সিয়াল এক্সপ্রেস থেকে ভাষান্তর করা হয়েছে)