বিশেষ প্রতিবেদক:
ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী ২৫ জুলাই কক্সবাজার পৌরসভার নির্বাচন। সে লক্ষ্যে মনোনয়ন সংগ্রহ ও জমা এবং বাছাইয়ের কাজ শেষ হয়েছে। এখন চলছে বাছাইয়ে বাতিল হওয়া প্রার্থীদের আপিলের সময়। সে সময় রয়েছে ৩ জুলাই পর্যন্ত। এদিন চাইলে প্রার্থীরা প্রার্থীতা প্রত্যাহারও করতে পারেন। এসব কর্মকান্ড শেষ করে ৪ জুলাই দেয়া হবে প্রতীক বরাদ্দ। এরপর থেকেই শুরু করা যাবে আনুষ্ঠানিক নির্বাচনী প্রচারণা।
নির্বাচনী আইন এমনটি বললেও বাস্তবতা কিন্তু ভিন্ন। কিছু মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থী মনোনয়ন জমা দেয়ার পর থেকেই নিজেদের মতো করে প্রচারণা চালাচ্ছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, সভা-সেমিনার এবং মহল্লার মসজিদে নামাজ আদায়ের পর কুশল বিনিময় ও দাওয়াতসহ নানা পন্থায় নিজের প্রার্থীতা জানান দিচ্ছে। এতে সাথে যাচ্ছে সমর্থক ও স্বজনরা।
নির্বাচন অফিস সংশ্লিষ্টরা এসব বিষয়ে নজরদারি না রাখায় ঘটছে বাকবিতন্ডা ও হত্যার মতো ঘটনা। ২৯ জুন পৌরসভার ৭ নং ওয়ার্ডে এক কাউন্সিলর প্রার্থীর পক্ষে কথা বলতে গিয়ে নির্বাচনী বাকবিতান্ডায় দূর্বৃত্তের ছুরিকাঘাতে খুন হয়েছেন এএইচএম তানভীর আহমেদ (২৬) নামের এক কলেজ শিক্ষার্থী। তিনি কক্সবাজার জেলা ছাত্রদলের প্রশিক্ষণ বিষয়ক সম্পাদক ও কক্সবাজার সরকারি কলেজের গণিত বিভাগের শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী এবং টেকপাড়া প্রতিভা কক্স কোচিং সেন্টারের পরিচালক। আগামী ১০ জুলাই নৌ বাহিনীর অফিসার পদের নিয়োগ পরীক্ষায় তাঁর অংশগ্রহন করার কথা ছিল। হামলায় তার আরেক সহোদর আবু সিনা (৩০)ও আহত হন। হতাহতরা বাঁচামিয়া ঘোনা এলাকার সুলাইমানের ছেলে। তাদের আদি বাড়ি মহেশখালির ধলঘাটায়।
ঘটনার প্রত্যেক্ষদর্শীদের মতে, ৭নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থী ও বর্তমান কাউন্সিলর আশরাফুল হুদা সিদ্দিকী জামশেদ বাঁচামিয়ার ঘোনা জামে মসজিদে নামাজ আদায় শেষে লোকজনের সাথে কুশল বিনিময় করেন। এসময় চায়ের দোকানে বসেছিল তানভীর ও ঘটনার সাথে জড়িত প্রায়ই ২০ জন যুবক। কুশল বিনিময়ের সময় এলাকার ভাঙ্গা রাস্তা ও নালা নর্দমা ঠিক করে দেয়ার জন্য জামশেদকে অনুরোধ করেন ছাত্রদল নেতা তানভীর। এসময় জামশেদ আগামী বাজেটে তা করার কথা বলে দোকান থেকে বের হয়ে একটু সামনে গেলে মিজান নামের এক যুবক জামশেদকে গালমন্দ করে। এনিয়ে কথা কাটাকাটি হয় তানভীরের সাথে মিজানের। একপর্যায়ে তানভীরকে মারধর করতে শুরু করে মিজান ও তার সঙ্গীরা। খবর পেয়ে জামশেদ আবার ফিরে এসে উভয় পক্ষকে শান্ত করে চলে যান। তিনি চলে যাবার পর তানভীরের পরিবারের সাথে আবারো সংঘর্ষে জড়ায় হত্যাকারীরা।
শুক্রবার বাদ জুমা শহরের দক্ষিণ রুমালিয়ারছড়ার বাঁচামিয়ার ঘোনায় সংগঠিত এ নির্বাচনি হত্যাকান্ডের পর পুরো পৌর এলাকায় এক ধরণের চাপা আতংক বিরাজ করছে। তবে, জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা বলেন, হত্যাকান্ডের পর শনিবার থেকে দুজন ম্যাজিস্ট্রেট পুরো পৌর এলাকায় টহলে নেমেছে। সতর্ক করা হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং নানা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রচারণা চালানো প্রার্থীদেরও।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিভিন্ন ওয়ার্ডের ভোটাররা জানান, ৭ বছর পর পৌর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে জেনে সবার মাঝে একটি উৎসবের আমেজ এসেছিল। কিন্তু শুক্রবারের হত্যাকান্ডটির পর থেকে সবার মাঝে একটা আতংক ছড়িয়ে পড়েছে। এখন কেউ কারো পক্ষে কথা বলা দূরে থাক ভোট দিবে যাবে কিনা তা নিয়েও ভাবছে। ৭ নম্বর ওয়ার্ডের ঘটনার পুর্নাবৃত্তি আরো কয়েকটি ওয়ার্ডেও ঘটতে পারে বলে আশংকা করছেন তারা।
ভোটারদের সেই শংকাকে সায় দিয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) কক্সবাজার শাখার সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুর রহমান বলেন, তফসিল ঘোষণার পর থেকে বিভিন্ন এলাকার পরিস্থিতি এবং স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জেনেছি পৌরসভার বেশ কয়েকটি ওয়ার্ডে কাউন্সিলরদের সমর্থকদের মাঝে সংঘাতের আশংকা রয়েছে। এর মাঝে ১২ নম্বর, ১ নম্বর, ৪ নম্বর, ৫ নম্বর, ১১ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ড অন্যতম। এসব ওয়ার্ডে কিছু কিছু কাউন্সিলর প্রার্থী অপরাধ লালনকারি ও নিজেও অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত। মেয়রের ভোট নিয়ে প্রায় সবকটি ওয়ার্ডে অনাকাঙ্খিত ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে। ৪ জুলাই প্রতীক বরাদ্দের পর এসব এলাকায় নজরদারি না বাড়ালে শুক্রবারের ঘটনার পূর্নাবৃত্তি ঘটতে পারে।
কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজ’র সভাপতি আবু মোরশেদ চৌধুরী খোকাও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন আনুষ্ঠানিক প্রচারণা শুরুর আগে নির্বাচনী হত্যায়। তাঁর মতে, প্রার্থীদের আরো সভ্য হওয়া উচিত। সাথে উচিত নির্বাচনী আইন লঙ্ঘন করে প্রচারণা চালানো প্রার্থীদের বিরুদ্ধে নির্বাচন অফিসের নজর রাখা। এখনই যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া না হলে পরে লাগাম টানা সম্ভব হবে না। পর্যটন রাজধানীর পৌরসভা হিসেবে এর পরিবেশ শান্ত ও নিরাপদ রাখা আবশ্যক। তাই অপরাধী ও অপরাধ নিয়ন্ত্রণকারিদের সনাক্ত করে আইনের আওতায় আনা সময়ের দাবি।
পৌর নির্বাচনের রিটার্নিং অফিসার ও কক্সবাজার জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মো. মোজাম্মেল হোসেন বলেছেন, এটি অনাকাঙ্খিত ঘটনা। এরচেয়ে অনাকাঙ্খিত সময়ের আগে কৌশলে নির্বাচনী প্রচারণা চালানো। সিদ্ধান্তছিল ৪ জুলাই প্রতীক বরাদ্দের পর ম্যাজিস্ট্রেট নামানোর। কিন্তু শুক্রবারের ঘটনার পর শনিবার থেকেই দুজন ম্যাজিস্ট্রেট মাঠে নেমেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও নানা অনুষ্টানে কৌশলে প্রচারণা চালানো একাধিক প্রার্থীকে নোটিশ দেয়া হয়েছে।
জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা আরো বলেন, ১২টি ওয়ার্ডে ৩৯টি কেন্দ্র রয়েছে। প্রতীক বরাদ্দের পর পূর্ব ঘটনা পর্যালোচনা করে ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্র সনাক্ত ও এব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। আমরা চাই, সবার সহযোগিতায় একটি সুষ্ট নির্বাচন উপহার দিতে।
কক্সবাজার জেলা পুলিশের মুখপাত্র ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) আফরুজুল হক টুটুল বলেন, শুধু নির্বাচন বলে নয় পর্যটনগরীর শৃংখলপরিবেশ বজায় রাখতে আইনপ্রয়োগকারি সংস্থা সর্বক্ষণ সচেষ্ট রয়েছে। নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনা অনুযায়ী নির্বাচনকালীন নিরাপত্তা ব্যবস্থা সেভাবেই সাজানো হবে।
অপরদিকে, শনিবার বিকেলে কক্সবাজার হাশেমিয়া কামিল মাদ্রাসা মাঠে জানাজা শেষে শুক্রবার নিহত তানভীরের দাফন সম্পন্ন হয়েছে। এতে উপস্থিত হয়ে হত্যাকারিদের ফাঁসির দাবি জানিয়েছেন জেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক ও নৌকা প্রতীকের মেয়র প্রার্থী মুজিবুর রহমান। জানাজায় তানভীরের সহপাঠী, এলাকার সর্বস্তরের জনতা, রাজনৈতিক নেতা-কর্মীসহ শোকাহত প্রায় বিশ হাজার মানুষ অংশ নেন।
কক্সবাজার সদর থানার ওসি ফরিদ উদ্দিন খন্দকার বলেন, তানভীর হত্যার ঘটনায় ১০জনের নাম উল্লেখ করে বেশ কয়েকজনকে অজ্ঞাত দেখিয়ে হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে। নিহতের বড় ভাই আবু সিনা বাদি হয়ে দায়ের করা মামলার ২ নম্বর আসামী আবুল বশর ও ১০ নম্বর আসামী আনজুমান আরা বেগমকে আটক করা হয়েছে।  বাকি আসামীদের ধরতে অভিযান অব্যাহত রেখেছে পুলিশ।