ডেস্ক নিউজ:
সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে চীনের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক সইয়ের প্রক্রিয়া শেষ মুহূর্তে আটকে যায়। এর পর থেকে ফাইলবন্দি প্রকল্পটি। সোনাদিয়ায় না হলেও মিয়ানমারের রাখাইনে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের পথে অনেকটাই এগিয়েছে চীন। সোনাদিয়া থেকে ২৮৯ কিলোমিটার দূরে রাখাইনের কিয়াকপিউতে গভীর সমুদ্রবন্দরটি নির্মাণে চীনা কনসোর্টিয়ামের সঙ্গে মিয়ানমার সরকারের আলোচনা প্রায় চূড়ান্ত। শিগগিরই এ বিষয়ে চুক্তি হবে বলে জানিয়েছে চীনের রাষ্ট্রীয় সংবাদ মাধ্যম সিনহুয়া।
কিয়াকপিউতে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের লক্ষ্যে চায়না ইন্টারন্যাশনাল ট্রাস্ট অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশনের (সিআইটিআইসি) নেতৃত্বে চীনের ছয়টি গ্রুপ অব কোম্পানির কনসোর্টিয়ামের সঙ্গে আলোচনা করছে মিয়ানমার। কিয়াকপিউয়ে দুটি প্রকল্প বাস্তবায়নে আহ্বান করা দরপত্র প্রক্রিয়ায় ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে যোগ্য বিবেচিত হয় সিআইটিআইসির নেতৃত্বাধীন কনসোর্টিয়াম। প্রকল্প দুটির মধ্যে রয়েছে একটি শিল্পপার্ক। অন্যটি গভীর সমুদ্রবন্দর। মূলত কিয়াকপিউ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের অংশ হিসেবে প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। মিয়ানমারের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও সিআইটিআইসি এ বিষয়ে শিগগিরই চুক্তিতে পৌঁছবে বলে আশা করছে উভয়পক্ষ।
মিয়ানমারের বাণিজ্যমন্ত্রী থান মিয়েন্ট সিনহুয়াকে বলেন, চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ প্রকল্পের আওতায় অর্থনৈতিক করিডোরের অংশ হিসেবে কিয়াকপিউয়ের গভীর সমুদ্রবন্দরটি নির্মাণ করা হবে। দুই দেশের জন্যই এটি সমান লাভজনক হবে। এছাড়া সমুদ্রবন্দরটির কল্যাণে উন্নয়ন হবে রাখাইন রাজ্যেরও। স্থানীয়দের জন্য বিপুল কাজের সুযোগ সৃষ্টির পাশাপাশি দেশের সার্বিক উন্নয়নে অবদান রাখবে গভীর সমুদ্রবন্দরটি।
গভীর সমুদ্রবন্দর প্রকল্পের আওতায় রয়েছে মাদেই আইল্যান্ড টার্মিনাল ও ইয়ানবাই আইল্যান্ড টার্মিনাল। এতে জাহাজ নোঙরের সুবিধাসম্পন্ন মোট ১০টি বার্থ থাকবে। শিল্পপার্ক ও গভীর সমুদ্রবন্দরের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনে রাস্তা ও সেতু নির্মাণের কাজও রয়েছে প্রকল্পটির আওতায়। ২০ বছরে মোট চারটি ধাপে গভীর সমুদ্রবন্দরটির নির্মাণকাজ শেষ হবে। নির্মাণ সম্পন্ন হলে বার্ষিক ৭৮ লাখ টন বাল্ক কার্গো ও ৪৯ লাখ টিইইউএস কনটেইনার ধারণ সক্ষমতা নিয়ে কার্যক্রম শুরু করবে গভীর সমুদ্রবন্দরটি।
কক্সবাজারের সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে বাংলাদেশও অনেকটা এগিয়েছিল। ২০০৯ সালে মহাজোট সরকার গঠনের পর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের পরিকল্পনা নেয়। জাপানের একটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান সে সময় এর সম্ভাব্যতা সমীক্ষাও পরিচালনা করে। দেশের প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণকাজ ত্বরান্বিত করতে ২০১২ সালের জানুয়ারিতে সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর কর্তৃপক্ষ আইন, ২০১১-এর খসড়া অনুমোদন করে মন্ত্রিসভা। এরপর প্রকল্পটিকে ফাস্টট্র্যাক মনিটরিংয়ের আওতায় আনা হয়। প্রকল্পটির জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিবের নেতৃত্বে গঠন করা হয় একটি কমিটিও।
গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে চীনের সঙ্গে একটি সমঝোতা স্মারক সইয়ের কথা ছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে তা হয়নি। এর পর থেকে এক প্রকার ফাইলবন্দি হয়ে পড়ে প্রকল্পটি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভূ-রাজনৈতিক কারণে সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণকাজে গতি আসেনি। বাংলাদেশও এক্ষেত্রে দক্ষতার পরিচয় দিতে ব্যর্থ হয়েছে।
সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবীর এ প্রসঙ্গে বণিক বার্তাকে বলেন, ভূ-রাজনৈতিক কোনো প্রভাব আমাদের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক হতে পারে। এ ধরনের প্রতিবন্ধকতা দূর করে সামনে এগোতে হলে আমাদের অভ্যন্তরীণ সিদ্ধান্ত নেয়ার সক্ষমতা প্রয়োজন। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, সবাইকে নিয়ে গভীর সমুদ্রবন্দর প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে চাই আমরা। বিষয়টি সবার কাছে গ্রহণযোগ্যভাবে তুলে ধরার দরকার ছিল। তবে অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, সেটি তুলে ধরতে পারিনি আমরা।
মিয়ানমারে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে চীনের আগ্রহ বরাবরই ছিল বলে জানান সাবেক এ রাষ্ট্রদূত। তিনি বলেন, বাংলাদেশ যখন গভীর সমুদ্রবন্দরের বিষয়ে উদ্যোগ নেয়, সে সময়ও মিয়ানমারের কাছে চীনের প্রস্তাবটি ছিল। অল্প দূরত্বে গভীর সমুদ্রবন্দর থাকলে তার অর্থনৈতিক সম্ভাব্যতার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়েই হয়তো সোনাদিয়া গুরুত্ব পাচ্ছে না।
রাখাইনের কিয়াকপিউতে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে আগ্রহী সিআইটিআইসির নেতৃত্বাধীন কনসোর্টিয়ামের অন্য অংশীদারগুলো হলো— চায়না হারবার ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি, চায়না মার্চেন্টস হোল্ডিংস (ইন্টারন্যাশনাল), টিইডিএ ইনভেস্টমেন্ট হোল্ডিং, ইউনান কনস্ট্রাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং গ্রুপ ও থাইল্যান্ডের চারোয়েন পোকফান্ড গ্রুপ অব কোম্পানিজ। মিয়ানমারের স্থানীয় কোম্পানিগুলোর সঙ্গে যৌথ উদ্যোগের মাধ্যমে প্রকল্প দুটি নির্মাণ ও পরিচালনাকাজ সম্পন্ন করবে সিআইটিআইসি কনসোর্টিয়াম। ২০১৪ সালে মিয়ানমার সরকারের ঘোষিত মিয়ানমার স্পেশাল ইকোনমিক জোন ল’ ফ্রেমওয়ার্কের আওতায় সমুদ্রবন্দরটি নির্মাণ করা হবে।
বিশ্লেষকদের মতে, চলমান রোহিঙ্গা সংকটের মূলেও আছে রাখাইনের কিয়াকপিউ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল। আর এ অর্থনৈতিক অঞ্চলকে ঘিরেই নির্মাণ করা হচ্ছে গভীর সমুদ্রবন্দরটি।
ইকোনমিক রিসার্চ গ্রুপের (ইআরজি) নির্বাহী পরিচালক ড. সাজ্জাদ জহির বলেন, উপমহাদেশের পূর্বাঞ্চলে যে অস্থিরতা তার অন্তর্নিহিত কারণ এ অঞ্চলের সম্পদ। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীও এর শিকার।
গত বছরের ২৫ আগস্ট রাখাইনে সেনা অভিযান শুরু হওয়ার পর নাফ নদী পাড়ি দিয়ে দলে দলে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আসতে থাকে। সেই সময় থেকে নতুন করে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে সাত লাখের মতো রোহিঙ্গা।
আমরা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।