মিনার হাসান:
‘’এই মোর হাতে কোদাল ধরিয়া কঠিন মাটির তলে, গাড়িয়া দিয়াছি মোর সোনামুখ নাওয়ায়ে চোখের জলে’’। বেলা শেষে সূর্য যেমন সব পাঠ চুকিয়ে বিদায় নেয়। তাকে বিদায় নিতে হয়। দিবাকরের অস্ত পথ যেমন কেউ রুখতে পারে না, ঠিক তদ্রুপ মানুষের মৃত্যুও সময় যখন আসন্ন হবে, মৃত্যুর ঘণ্টাধ্বনি যবে বেজে উঠবে তখন কেউ মৃত্যুকে ঠেকাতে পারে না। নির্ধারিত সময় থেকে পূর্ব ও পরে মৃত্যু ঘটাতে সক্ষম হবে না। মোগল সম্রাট শাহজাহানকে প্রশ্ন করা হয়েছিলো দুনিয়ার সবচেয়ে ভারী বস্তু কী? তার উত্তর ছিল- পিতার কাঁধে সন্তানের লাশ! জীবনের পড়ন্ত বেলায় সন্তানের লাশ কাঁধে যিনি নিয়েছেন হয়তো তিনিই বুঝেছেন তার ভার কতটা? পিতা অপেক্ষা করছেন পুত্রের জন্য। পুত্রের লাশের জন্য। কী অপেক্ষা! যে ছেলের আঙুল ধরিয়ে হাঁটা শিখিয়েছিলেন, সেই ছেলের কবরে মাটি দেয়ার অপেক্ষা। পিতার কাঁধে পুত্রের লাশ সর্বদাই সবচেয়ে ভারী; কিন্তু এ অপেক্ষার লাশ বেশিই ভারী এক পিতার জন্য! যে সন্তান নিয়ে পিতামাতার হাজারো স্বপ্ন, নিজের প্রাপ্তিকে তুচ্ছ করে একটু বেশী কিছু দেওয়ার চেষ্ঠা করে ছেলেমেয়েদের, সেই হীরের টুকরোকে নিজে কোদাল ধরে মাটি কুড়ে কবর দেওয়া পিতার জন্য সৃষ্টিকর্তার এক অগ্নি পরিক্ষা। ফেসবুকের নিউজ ফিডে যখন খবরটি দেখি তখন অন্তরটি মোচড় দিয়ে উঠে। বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল। প্রতিদিনের মত কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার চকরিয়া গ্রামার স্কুলের ছাত্র অত্র স্কুলের প্রধান শিক্ষক মাষ্টার রফিকুল ইসলামের পুত্র সাঈদ জাওয়াদ আরভি (১৭) ঘুম থেকে উঠে নাস্তা করে পড়ার টেবিলে বসে ছিলো, কেইবা জানতে এটাই তার শেষ বসা। হয়ত বই, টেবিল, চেয়ার , খাতাগুলো তাকে আটকে রাখতে চেয়ে ছিলো কিন্তু তাদের’ত হাত-পা নেই। তারা চাইনি তাদের প্রিয় মানুষের স্পর্শ হারাতে। পড়ার টেবিলের বইগুলো পড়তে পড়তে আরভী হয়ত বিরক্ত- তাই সে পগবা,গ্রিজম্যান,লুকাকুর মত একজন ফুটবল খেলোয়ার হওয়ার স্বপ্ন পুষে ছিলো মনে মনে, হয়ত অন্য কিছু। কিন্তু অভিমানী ছেলেটি খেলতে গিয়ে আর ফিরে এলোনা। যাকে হাত ধরে হাঁটতে শিখিয়েছে, যাকে পড়ার টেবিল থেকে জীবনের সকল পাঠের জন্য এজন আদর্শবান মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার আপ্রাণ চেষ্টা করছে ,সেই ছেলেটি্র আজ নীতর দেহ। মাষ্টার রফিক তার ছেলে ও চার প্রিয় ছাত্রে মৃত্যুর পরও ছিলেন শান্ত, শিক্ষক মানুষ গড়ার কারীগর তার’ত আর ভেঙ্গে পড়লে চলবেনা। তাহলে তার ছাত্র্দের মাতাপিতাকে শান্তনা দিবে কে? তিনি’ত তার ছাত্রদের বিপদে অবিচল থাকার শিক্ষা দিয়ে ছিলেন। নিজের কাঁধে প্রিয় পুত্রের লাশ বহন করে কবর দিয়ে যেন তিনি শান্ত হলেন। তাই’ত নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন পুত্রের কবরের দিকে। কবির ভাষায়- ‘’সারা দুনিয়ার যত ভাষা আছে কেঁদে ফিরে গেল দুখে’’। এমনি একটি বেদনাদায়ক ঘটনার সাক্ষী হলো কক্সবাজারবাসী। গত ১৪ জুলাই (শনিবার) কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার মাতামুহুরী নদীতে চিরিংগা ব্রীজের নিচে সদ্য জেগে উঠা বালু চরে চকরিয়া গ্রামার স্কুলের একদল ছাত্র ও ক্ষুদে ফটবলার বন্ধুদের সাথে ফুটবল খেলতে যায়। তাদের মধ্যে একদল আর্জেন্টিনা সাপোর্টার ও অপরদল ব্রাজিল সাপোর্টার হয়ে ২২জন শিক্ষার্থী দুই দলে বিভক্ত হয়ে ফুটবল খেলেন। খেলে শেষে বেলা সাড়ে ৩টার দিকে মাতামুহুরী নদীতে গোসল করতে নামে ওই ক্ষুদে ফুটবলার। তৎমধ্যে ৫জন ছাত্র নদীতে গোসল করতে নেমে নিখোঁজ হয়ে যায়।। ঘটনার ৩ঘন্টা পর স্থানীয় লোকজন ও ফায়ার সার্ভিস ডিফেন্স ষ্টেশনের একদল ডুবুরি নদীতে জাল ফেলে নিখোঁজ হওয়া ৫জনকে মৃতবস্থায় উদ্ধার করেন। উদ্ধার হওয়া ছাত্ররা হলেন, চকরিয়া গ্রামার স্কুলের দশম শ্রেণীর ছাত্র ও আনোয়ার শপিং কমপ্লেক্সের মালিক আনোয়ার হোছাইনের দু’পুত্র আমিনুল হোছাইন এমশাদ (১৭) ও তার ছোট ভাই একই স্কুলের ৮ম শ্রেণীর ছাত্র আফতাব হোছাইন মেহেরাব (১৫), একই স্কুলের দশম শ্রেণীর ছাত্র ও মানিকপুর তর্দরূপ ভট্ট্রাচার্য্যের পুত্র তুর্ণ ভট্রাচার্য (১৭), গ্রামার স্কুলের প্রধান শিক্ষক রফিকুল ইসলামের পুত্র ও ১০ম শ্রেণির ছাত্র সাঈদ জাওয়াদ আরভি (১৭) ও চিরিংগা সরকারী হাসপাতাল পাড়ার মোহাম্মদ শওকতের পুত্র ১০ম শ্রেণির ছাত্র ফারহান বিন শওকত (১৭)। ১৫ জুলাই (রবিবার) হাজার হাজার এলাকাবাসী ও সহপাঠীদের উপস্থিতিতে মৃতদের জানাজা সম্পন্ন হয়।

এদিকে বাংলাদেশে বাড়ছে পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুর সংখ্যা। অন্য যে কোনো কারণে শিশু মৃত্যুর চেয়ে পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশে শিশু মৃত্যুর ৪৩ শতাংশই ঘটছে পানিতে ডুবে। দেশে প্রতি ৩০ মিনিটে পানিতে ডুবে একজন শিশু মারা যাচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডাব্লিউএইচও) এর তথ্য মতে, বিশ্বে বছরে ১৭ হাজার শিশু পাড়ি পড়ে মারা যায়। । বাংলাদেশে বিগত পাঁচ বছরে পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুর সংখ্যা এক হাজার ৯২৬। ২০১১ সালে শিশু মৃত্যুর সংখ্যা ৩৬১ জন, ২০১২ সালে ৩০৩ জন, ২০১৩ সালে ৫০২ জন, ২০১৪ সালে ৪৬৪ জন ও ২০১৫ সালে ২৯৬ জন।