ওয়াইফ ইজ টাইগার ?

প্রকাশ: ১০ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ ০৮:৪০ , আপডেট: ১০ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ ১০:০১

পড়া যাবে: [rt_reading_time] মিনিটে



রেজাউল হক হেলাল


মানুষের জীবন দুইবার বদলায়, যখন তাঁর জীবনে নতুন কেউ আসে, আর যখন কেউ তাঁর জীবন থেকে চলে যায়। স্ত্রীর ভুমিকা এখানে বেশি। জীবনের এই প্রান্তে এসে প্রবাসে ইবনে বতুতা কিংবা কবি ওমর খৈয়ামের মতো খেয়ালি হয়ে যাচ্ছি ।অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে। কুচুরি ফেনার মতো ভাসতে ভাসতে বাংলাদেশ থেকে একদিন সৌদি আরবের মরু প্রান্তরে এসে পড়েছি। ইকামা-তানাজুল-কফিল কাহিনীতে নাবিলা হক ও জামিলা হক হারিয়ে- আম ছালা সব গেছে । এখন আমি চিৎকার করছি- ওয়াইফ ইজ টাইগার।

ভারত নেপাল ভুটান পাকিস্তান মালদ্বীপ শ্রীলঙ্কা মরিশাস বাহরাইন ইয়েমেন ইত্যাদি দেশ ঘুরে ভেবেছি আর ছুটতে হবেনা। পারিবারিক দুর্যোগের সামনে বহু মহাপুরুষ ও হেরে গেছে, ২০০৮ সালে সৌদি আরব এসে জীবনকে নতুন ভাবে জানতে পেরেছি।পৃথিবীর নতুন নতুন রুপ দেখে চলেছি। আমার জ্ঞান কত সীমিত, তা অনুভব করতে পেরেছি।কবির ভাষায় ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়। বহু দেশের বহু ভাষার মানুষ একত্রে অন্য রকম পরিবেশে জীবন-জীবিকার যুদ্ধে যোগদান করি। এমন কফিল-ইকামা-তানাজুল কাহিনী আমাকে সর্বহারা করবে, ভাবিনি। শুধু বলি- চলার পথের ক্লান্তি গুলো কি যেন সব হারিয়ে গেলো ।

মৃত্যুর পর মানুষ পরিবার বন্ধু-বান্দব থেকে দূরে, আরেকটি অনন্তকালের জীবনে প্রবেশ করে । সেদেশে স্বর্গ–নরকের বিশাল আয়োজন।পুরস্কার আর শাস্তির মহাসমারোহ । কিন্তু পৃথিবীর এই ছোট খেলাঘরে আমরা যে সংসার সাজাই, এটা আমাদের জন্য লোকাল স্বর্গ।সেই স্বর্গের হুর-গেলমান স্ত্রী সন্তান এরা।এদের সুখের জন্য, উন্নত জীবিকার জন্য দেশান্তর হয়ে প্রবাসে এভাবে মরু সাহারায় এসেছি।চারদিকে সবাই অচেনা মানুষ। তাদের সাথে ভাব জমিয়ে,দক্ষতা এবং পরিশ্রমে যা কিছু আয় হয়, যত্ন করে ব্যাংকে নিয়ে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশে পাঠাই, বছরের পর বছর এই কষ্ট-ত্যাগ, এই জীবিকার সংগ্রাম চলতে থাকে।পরের মেয়েকে স্ত্রী বানিয়ে ঘরে তুলি এবং জীবনভর খেদমত করি,কেননা আমরা মহান সৃষ্টিকর্তার একত্ববাদে বিশ্বাস করি।বাংলাদেশের মানুষ এজন্য পৃথিবীতে অনন্য। অতন্ত আদরের স্ত্রী, যাকে নিয়ে বিদেশ যাপন হয়েছে, সন্তান বড় হয়ে অনার্স ফাইনালে পড়ছে, সেই আদরের স্ত্রী আদরের কলেজ পড়ুয়া সন্তান হত্যা করে পরকিয়ার কারনে,এমন কলঙ্ক জনক বেদনাবিধুর ঘটনা বাংলাদেশে ঘটছে।দুই যুগের পারিবারিক স্বর্গ ভেঙ্গে খান খান করে স্বামীর আমানত, যোগানো অর্থ নিয়ে ছেলে সম প্রেমিকের সাথে উধাও হয়েছে। এসব অনেক প্রবাসির নিত্য হতাশার প্রতিপাদ্য।এমন নির্লজ্জ দুঃখময় আঘাত বুকে চেপে রেখে হাসতে পারার অভিনয় বেদনাদায়ক।তাই প্রশ্ন এখন ওয়াইফ ইজ টাইগার?

হাজার সাল পহেলে কি বাত হায়ে।

প্রাচীন কালে দুই ভাই ছিল দুই রাজ্যের রাজা।হবু চন্দ্র আর গবু চন্দ্র। উভয়ে ছিলেন বউ পাগল। স্ত্রী ছাড়া তাঁরা তাদের রাত কাটেনা।একদা হবু চন্দ্র গবু চন্দ্রের দেশে জরুরি কাজে দলবল নিয়ে পদব্রজে যাত্রা করেন। পথে রাত নামে।তাবু বানিয়ে বাহিনী ঘুমিয়ে পড়ে। রাজার ঘুম আসেনা।আজ পাশে রানী নেই তাই।রাজা সবাইকে ঘুমে রেখে তেজি ঘোড়া নিয়ে প্রাসাদে রানীর কাছে ফিরে যান।রানীর প্রতি রাজার প্রচণ্ড প্রেম।কিন্তু অন্দর মহলে ঢুকে রাজা একি দেখলেন ?যে মেয়েকে রানী বানিয়ে প্রাসাদে সব চেয়ে সন্মানের আসন এবং প্রেম মায়া-মমতা দিয়ে ভরিয়ে দিয়েছেন, সেই রানী প্রাসাদের কর্মচারীর সাথে পরকিয়ায় লিপ্ত। হবু চন্দ্র রাজার মাত্র এক রাতের প্রবাস যাপনে রানীর এই নষ্টামি ? রেগে দুই জনকে তলোয়ার দিয়ে শিরচ্ছেদ করেন।লোকে বলে –সুখে থাকলে ভুতে কিলায়। প্রতারক রানীকে হত্যা করে হবু চন্দ্র রাজা দ্রুত তাঁর বাহিনীর সাথে মিলিত হন।কয়েক দিনের মধ্যে আপন ভাইয়ের রাজ্যে গবু রাজার দরবারে গিয়ে মিলিত হন।ছোট ভাইয়ের মন খারাপ দেখে বড় ভাই বলেন, চল হরিণ শিকারে যাই বিষণ্ণতা কেটে যাবে। বেশ মজা হবে।দুই রাজা একত্রে শিকারে যান। ছোট রাজা রাতে পালিয়ে বড় রাজার স্ত্রী- ভাবীর প্রাসাদে যান। দেখেন বড় রাজার একদিনের শিকারে যাবার সুযোগে বড় রানীও পরকীয়ায় লিপ্ত।তিনি নিরবে শিকার শিবিরে ফিরে আসেন।বিস্তারিত ঘটনা বড় রাজার কাছে বললে বড় রাজা ক্ষেপে উঠেন। বলেন তোর রানী চরিত্রহীনা হতে পারে, তাকে হত্যা করে ঠিক করেছিস। কিন্তু তাই বলে আমার স্ত্রীর নামে বদনাম? করবি ? তোর এতো বড় সাহস ? আমার রানীকে আমি সুখে ভরপুর করে রেখেছি। তাকে দূরে রেখে একরাত চলেনা। রানী আমার প্রেমে পাগলিনী। তুই এসব কি বলিস ভাই ?

ছোট রাজা চ্যলেঞ্জ ছুড়ে বলেন যদি আমি মিথ্যুক হই আমাকে হত্যা করিস। বড় রাজা পরের রাতে লুকিয়ে গিয়ে স্ত্রীকে পরীক্ষা করে দেখেন তাঁর রানী গাদ্দার মহিলা। সেও পরকীয়ায় লিপ্ত।

সে যুগে দুই চারটে হবু চন্দ্র বা গবু চন্দ্র ছিল।আমাদের যুগে ঘরে ঘরে অয়াইফ নামের টাইগার আছেন। কারও বিশ্বাস হবে কারেও বিশ্বাস হবেনা।

দেখুন আমার কোরিয়ান বন্ধুরা কি বলে।

দামাম থেকে প্রায় পনের শত কিলোমিটার দূরে সাগর তীরে পেট্রো রাবিগ। আমাদের পাওয়ার প্লান্টটি লোহিত সাগরের তীরে- এখানে পঁচিশ সদস্যের কোরিয়ান ও জাপানি ইঞ্জিনিয়ার টিমে আমি অফিসিয়াল জব করছি- এডমিন। দিবারাত্রি কাজে ব্যস্ত ।ভোর পাঁচটায় নামাজ এবং নাস্তা সেরে রওয়ানা হই, সন্ধ্যা সাতটার পর কোম্পানির বাসে ক্যাম্পে ফিরে আসি। দুপুরের খাবার কর্মক্ষেত্রে মরুভুমির পরিবেশে খেয়ে থাকি। আমাদের ফুড সাপ্লায়ার সিনিয়র লাঞ্চ প্যাকেটে নাম লিখে রেখে যায়।সাধারণ শ্রমিক প্লাস্টিক বিছিয়ে দুপুরের উত্তপ্ত বালু কিংবা ওয়ার্কশপে ভিক্ষিপ্তভাবে ভোজন সারেন। মরুভূমির প্রচণ্ড তাপ সয়ে সয়ে ক্ষয়ে ক্ষয়ে নিভৃত সাগর তীরে একদল বিদেশীর সাথে সংগ্রামে লিপ্ত আছি। কখনো বেতন পাই, কখনো তাল বাহানা করে দেরি করে অথবা ব্যাংকের যে হিসাব নম্বরে টাকা নাই, সেই হিসাব নং এর চেক দিয়ে কোরিয়ান ম্যানেজার পালিয়ে যায়।এভাবে প্রতারিত হয়ে সুখে দুখে প্রবাসে কালাতিপাত করছি।

আমার কলিগ মিঃ বেক, মিঃ জাং, মিঃ ওহ, মিঃ উইন, লি, জিম, কিম, হং, হাং। দিনের বার ঘন্টা তাদের সাথে কাটাতে হয়।তাছাড়া ভারত-পাকিস্তান-নেপাল-বাংলাদেশের তিনশত শ্রমিক এবং দুই জন ইঞ্জিনিয়ার- প্রত্যেকে আমার সাথে- অর্থাৎ এডমিন সেকশনের সাথে যুক্ত । ফিলিপাইনের একজন অফিস সহকারী আছেন।
কর্মক্ষেত্রে পারিবারিক গল্পের সময় নেই। তবুও ইন্টারটেন্তম্যানট যে চলেনা, এমন নয়; ৫৬ বছর বয়স্ক মিঃ বেক কোরিয়ান ভাষায় ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ার, সামান্য ভেজা ভেজা ইংরেজি বলেন। দুপুরে বিরতির ফাঁকে বা খাবার টেবিলে গল্পের ফ্লোর পাতি।পৃথিবীর নানা দেশের নানান জাতের মানুষের কৃষ্টি-কালচার, চিন্তা চেতনা ট্র্যাডিশন সভ্যতা ইত্যাদি জানতে ভাল লাগে। বাংলাদেশ থেকে পাঠানো উম্মেহানির হাতে তৈরি আমের মোরব্বা খেতে খেতে বিদেশী কলিগদের সাথে গল্পের অবতারনা করি । মিস্টার হান এসে ফ্লোর নেন। সাউথ কোরিয়ার উলসান জেলায় তার বাড়ি। ৫৮ বছর বয়সে পর পর চারজন স্ত্রী তাঁকে তালাক দিয়ে অন্যত্র চলে গেছে। ৮ জন ছেলে-মেয়ে, নানা বাড়ি, বেবি কেয়ার হোমস বা ছাত্রাবাসে থাকে।জারজ সন্তানকে কোরিয়া সরকার লাভ চাইল্ড খেতাব দিয়ে জিনা-ব্যবিচারকে উৎসাহিত করে থাকে।মিঃ হানকে বাবা হিসাবে সন্তানেরা তেমন পাত্তা দেয়না, রিসপ্যাক্ট করেনা, শুধু টাকা চায় টাকা। এই প্ল্যান্টে মিঃ হান একা অন্তত ২/৩ জন বাংলাদেশীর পরিশ্রম করে।আমি উম্মে হানির ভালোবাসার তারিফ করতেই মিঃ হান ক্ষেপে ওঠেন। বলেন, মিঃ রেজা’স আইডিয়া ইজ রং, ওয়াইফ ইজ লাইক ড্রাকুলা, টাইগার । আমি বলি- নো নো, আই ডোন্ট বিলিভ। কলিগ মিঃ বেক মিঃ হানকে সমর্থন করে বলেন- হান স্পিক রাইট। ওয়াইফ ইজ টাইগার ইন সাউথ কোরিয়া। হোয়াট এবাউট বাংলাদেশী লেডি ? লাইক টাইগার অর ক্যাট ?


কবি রেজাউল হক হেলাল , গ্লোবাল বাংলা টিভি ।