মোহিব্বুল মোক্তাদীর তানিম :


গত সপ্তাহে নিজের এলাকা কিশোরগঞ্জের এক অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ বলেন,“সকল রাজনৈতিক দল থেকে সৎ, চরিত্রবান ও যোগ্য ব্যক্তিদের মনোনয়ন দেওয়া উচিৎ। অসৎ ব্যক্তিরা নির্বাচিত হলে দেশের কোনো উন্নয়ন হবে না। যারা টিআর-কাবিখার টাকা, গম, চাল মেরে খায়; সে যদি আমার ছেলেও হয়, তাদের ভোট দেবেন না।” রাষ্ট্রপতি একথা বলার সময় তার ছেলে স্থানীয় সংসদ সদস্য রেজওয়ান আহাম্মদ তৌফিকও অনুষ্ঠানে ছিলেন।

বর্তমান প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্রপতির এই বক্তব্য বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। নির্বাচনের কয়েক মাস মাত্র বাকি। রথি-মহারথি, বলবান-ক্ষমতাবান সবাই মনোনয়ন দৌড়ে ঝাপিয়ে পড়েছেন পুরো দেশজুড়েই। স্ব-স্ব দলের মনোনয়ন পাওয়ার জন্য বাহারি বিলবোর্ড, ফেস্টুন, ডিজিটাল প্রচারণা, ক্ষেত্রবিশেষে উন্মাদনা- পুরোদমে শুরু হয়ে গিয়েছে।

কক্সবাজারের চারটি সংসদীয় আসনের জন্য যথারীতি এই দৌড় শুরু হয়ে গিয়েছে এবং চলমান। পরিস্থিতি বিবেচনায় সরকারি দলের মনোনয়নের জন্য ঘোড়-দৌড় ব্যাপক হলেও সময়ের আবর্তনে এ প্রতিদ্বন্ধিতা বিরোধী দলে শীঘ্রই সংক্রামিত হবে- অনুধাবনযোগ্য।

সাম্প্রতিক সময়ে আমরা কি এমন কোন সাংসদ পেয়েছি যিনি বাস্তবিক অর্থে কক্সবাজারের মৌলিক সমস্যাগুলিকে চিহ্নিত করেছেন কিংবা নির্বাচনী এলাকা নিয়ে নিজেদের স্বপ্নের কৌশলগত রেখাপাত করেছেন। রাজনৈতিক স্তুতির পাশাপাশি মৌলিকত্ব নিয়ে নিজেদের স্বকীয় চিন্তাশক্তিকে উন্মোচিত করতে পেরেছেন কি কোন সাংসদ। অবার সম্ভাবনার কক্সবাজারকে উন্মোচিত ও আলোকিত করতে আমাদের আশু প্রয়োজন মেধাবী, জনপ্রিয় রাজনীতিবিদ সাংসদ।

কক্সবাজার এখন শুধুই পর্যটনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেয়। ভূ-রাজনীতি, বানিজ্য, সমুদ্র্যচুক্তি, বাস্তুচ্যুত শরনার্থী’সহ নানাবিধ কারণে কক্সবাজার আন্তর্জাতিক ভাবে আলোচিত একটি নাম বর্তমানে। কক্সবাজারের সমস্যা, সম্ভাবনাকে আপেক্ষিক ও বাস্তবিকভাবে ফুটিয়ে বস্তুনিষ্ঠতার দিকে এগিয়ে নিতে হলে আইনপ্রণেতাদের বিশেষ ভূমিকা রাখা অত্যাবশ্যক।

প্রথমেই আলোকপাত করা যাক- কক্সবাজারের আন্তর্জাতিক গুরুত্ব প্রসংগ। গত বছর হতে কক্সবাজার আন্তর্জাতিকভাবে আলোচিত একটি নাম রোহিঙ্গা ইস্যুকে কেন্দ্র করে। দশ লক্ষাধিক বাস্তুচ্যুত মায়ানমারের নাগরিককে আশ্রয় দিয়ে বর্তমান সরকার মহৎ কাজ করেছে- কিন্তু এর প্রভাব কক্সবাজার শহরে ও অত্র এলাকায় কিভাবে পড়ছে কিংবা পড়তে পারে নিকট ভবিষ্যতে- তার সুনিব্যস্ত বিশ্লেষণ তুলে ধরার মত সাংসদ দরকার আমাদের। রোহিঙ্গা ইস্যুকে কেন্দ্র করে এনজিও গুলিতে স্থানীয়দের কর্মসংস্থানের বাধ্য-বাধ্যকতা নিয়ে কথা বলার মত দৃঢ় ও বলিষ্ঠ স্থানীয় সাংসদের প্রয়োজনীয়তা উপলদ্ধি করছে স্থানীয় জনসাধারণ।

গত মাসে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (এনইসি) বৈঠকে দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদি ডেল্টা প্ল্যান-২১০০ অনুমোদন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ব-দ্বীপ পরিকল্পনা বা ডেল্টা প্ল্যান-২১০০ বাংলাদেশ সরকারের একটি অনন্য ও সুদূরপ্রসারী উদ্যোগ। এই পরিকল্পনায় কক্সবাজারকে উপকূলীয় অঞ্চলে রাখা হয়েছে যা প্রাকৃতিকভাবে সবচেয়ে ঝুঁকি প্রবণ এলাকা। ষোলটি জেলার সঙ্গে কক্সবাজারের চ্যালেঞ্জগুলি হচ্ছে ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস, বন্যা, লবণাক্ততা, জলাবদ্ধতা, নদী ও উপকূলীয় এলাকার ভাঙন, স্বাদু পানির প্রাপ্যতা, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাওয়া এবং পরিবেশের অবনমন। হবু সাংসদকে ডেল্টা-প্ল্যান ২১০০ বাস্তবায়নের যৌক্তিকতা বুঝে এর সুফল কক্সবাজারে বাস্তবায়নযোগ্য করাতে হবে।

ব্লু-ইকোনমি বা সমুদ্র অর্থনীতির গুরুত্ব দিন দিন বাড়ছে। মৎস্য সম্পদ, খনিজ আহরণ, সামুদ্র্যিক পরিবহন, ম্যানগ্রুভ বনাঞ্চল, পর্যটন সম্ভাবনার অর্থনৈতিক, সামাজিক কৌশল নির্ধারণ করাটা এতদাঞ্ছলের আইনপ্রণেতাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। দেশের অন্যতম বৃহৎ বিদ্যুৎ প্রকল্প হচ্ছে এই জেলাতে, এসব বড় প্রকল্পের আওতার মধ্যে স্থানীয়দের কর্মসংস্থান সহ বিবিধ সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিতকরণের যৌক্তিকতা তুলে ধরতে হবে।

লবণ শিল্প কিংবা রাবার বাগানের বানিজ্যিক সম্ভাবনাকে নতুনভাবে আলোকপাত করা দরকার। ভাবী সাংসদদের ভাবতে হবে এর পরিকল্পনাগুলি। ব্যাপক সম্ভাবনা থাকা সত্বেও কক্সবাজারের শ্যুটকি, লবণকে আন্তর্জাতিক মানের পণ্যে রূপান্তরিত করা এখনো সম্ভব হয়নি।

স্থানীয় সরকারের ব্যাপক উন্নয়নমূলক কর্মকান্ড থাকলেও অনেক এলাকায় প্রত্যাশিত উন্নয়ন হচ্ছেনা বলে – অভিযোগ রয়েছে। উদাহরণস্বরুপ বলা যেতে পারে, রামু গর্জনিয়ায় বাকখালি নদীর উপর সেতু। প্রায় দেড় দশক আগে নির্মিত এই সেতু প্রায় অকেজো হয়ে গেলেও স্থানীয় সাংসদ এই খাতে প্রত্যাশিত প্রকল্প বরাদ্দ আদায় করতে সক্ষম হয়নি বলে জনশ্রুতি আছে।

কক্সবাজারে চলমান উন্নয়ন প্রকল্পে স্থানীয় লোকজনকে সংশ্লিষ্ট করার মাধ্যমে বেকারত্ব হার কমানোর দৃশ্যমান পরিকল্পনা অনুধাবন করানোর ক্ষমতা থাকতে হবে হবু সাংসদের।

বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা গেছে- বাংলাদেশের কক্সবাজার জেলার মানুষের জীবনযাত্রার ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়বে। এর কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, এই জেলা সমুদ্রপৃষ্ঠের খুব কাছাকাছি। সেখানে বিপুল পরিমাণে অবকাঠামোও গড়ে তোলা হয়েছে। কিন্তু সেখানকার স্থানীয় বাসিন্দাদের বেশির ভাগই দরিদ্র। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কক্সবাজার জেলার আর্থিক ক্ষতি ও জীবনযাত্রার মান কমে যাওয়ার আশংকা রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কক্সবাজারের ক্ষয়ক্ষতির বিষয়ে সরকারের নজর আনার দায়িত্ব নেওয়ার মত মানসিক, পেশাগত দক্ষতা দেখাতে হবে ভাবী সাংসদবৃন্দকে।

ঈদগাহকে উপজেলাতে রুপান্তরিত করা কিংবা রামুকে পৌরসভার অনুমোদন নেওয়ার মত সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার ছক আঁকার মত মেধাবী, প্রজ্ঞাবান সাংসদ অনেকের প্রাণের দাবি।

মাদক পুরো কক্সবাজার জুড়েই কালসাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকার মাদকের বিরুদ্ধে রীতিমত যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। এই এলাকার সাংসদদের মাদকের বিরুদ্ধে আরো নিষ্ঠাবান হতে হবে। সাংসদের পরিকল্পনাতে মাদকমুক্ত জনপদ গড়ার আহবান থাকতে হবে এবং তাদের কর্মীবাহিনীকে এর বাইরে রাখার প্রত্যয় দেখাতে হবে।

সর্বোপরি সাংসদকে মাথায় রাখতে হবে তিনি একজন আইন প্রণেতা। স্থানীয় সরকার পরিষদ চেয়ারম্যান বা সদস্যের সংগে দায়িত্বগত পার্থক্য অনুধাবন তার করতে হবে। রাষ্ট্রের সামর্থ্য শুধু তার নীতি, প্রতিষ্ঠান এবং পদ্ধতির উপর নির্ভর করে না। নীতি যারা প্রণয়ন বা রূপায়ণ করেন, প্রতিষ্ঠান যারা পরিচালনা করেন এবং পদ্ধতি যারা অনুসরণ করেন, তাদের আচরণের উপরেও নির্ভর করে।

পত্রিকান্তরে- কক্সবাজার জেলার সাংসদের আচরণগত বিভিন্ন প্রতিক্রিয়া আমাদের নজরে এসেছে। ভাবী সাংসদকে বুঝতে হবে, জনগণ বলবান সাংসদ চায়না, তারা চাই বিবেকবান সাংসদ।

সর্বোপরি আমরা কক্সবাজার আলোকিত করার মত নিষ্টাবান, মেধাবী সাংসদ প্রত্যাশা করি। আশা করব, হবু প্রার্থীরা তাদের নির্বাচন পূর্ব বক্তব্য কিংবা অংগীকারে উপরিউক্ত ইস্যুগুলি সু-আলোকপাত করবেন।