মহসীন শেখ, ভেলোর (তামিলনাড়ু), চেন্নাই, ভারত থেকে।
ভেলোর সিটির বাসস্ট্যান্ডের পশ্চিম পাশেই মহিশোরের বাঘ খ্যাত টিু সুলতানের দুর্গ। ভেলোর ফোর্ট। মেইন বাজার কিংবা সিএমসি হাসপাতাল থেকে হেঁটে মাত্র পনের মিনিটের পথ। আগে জানতাম না হায়দার আলী ও টিপু সুলতানের স্মৃতিবিজড়িত জনপদ মহীশূর রাজ্য যে এই কর্ণাটক ও তামিলনাড়ুর মধ্যে তা সিএমসি হসপিটালে চিকিৎসা নিতে এখানে এসে বুঝলাম। যেখানে আজও কালের স্বাক্ষী হিসেবে রয়েছে সুলতান পরিবারের রক্তাক্ত ইতিহাস।
আমি যে লজে উঠেছি তার ‘সোলাই’। লজে একজন স্টাফের সাথে কথা বলে জানলাম, ভেল’ অর্থ বলা হয়ে থাকে স্পেয়ার বা যুদ্ধাস্ত্র। ‘অর’ মানে জায়গা। এই হলো সংক্ষেপে শহরটির নামের অর্থ। তার মতে, ভেল অর্থ সূর্যের উত্তাপ আর অর মানে জায়গা। তার অভিমত মোটেও মিথ্যা নয়। কারণ এখানে অতিমাত্রায় গরম।
প্রথমেই বলে নেওয়া জরুরি, ইতিহাস মতে- ভেলোর দুর্গ মূলত স্থাপন করেছেন বিজয়নগর সাম্রাজের রাজা বিজয়নগর। টিপু সুলতানের মূল প্রাসাদ বেঙ্গালুরুর মহীশুরে। বর্তমানে সেই গ্রামের নাম শ্রীরঙ্গপত্তনম। দক্ষিণ ভারতের কর্ণাটক রাজ্যের মান্ডিয়া জেলায় অবস্থিত এটি।
ভারতের দক্ষিণাঞ্চলের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রদেশ এই তামিলনাডু। তামিলনাডু রাজ্যের প্রধান রাজধানী হচ্ছে চেন্নাই। চেন্নাইয়ের পূর্ব নাম মাদ্রাজ। মাদ্রাজ নামটি পরিবর্তিত হয়ে এখন চেন্নাই নাম ধারণ করেছে। একসময় চিকিৎসার জন্য আসা বাংলাদেশের মানুষ যে মাদ্রাজের কথাই বলতো। ভেলোর হচ্ছে তামিলনাড়ু রাজ্যের একটা জেলা। চেন্নাই শহর থেকে ১৪৫ কিলোমিটার ও ব্যাঙ্গালোর শহর থেকে ২১১ কিলোমিটার দূরে ভেলোর। এই ভেলোর শহরেই অবস্থিত মুহীশুরের বাঘ টিপু সুলতানের দূর্গ। ভেলোর সিএমসি হাসপাতালে যারা চিকিৎসা করাতে আসেন তারা একবার না একবার টিপু সুলতানের দূর্গে যাবেনই। এই দূর্গ সমন্ধে জানতে ইন্টারনেট গেঁটে যা জানতে পারলাম তা সত্যিই বিস্ময়কর।
ভেলোরের শহরাঞ্চল খুব একটা বড় নয়। সিএমসি হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা নেওয়ার উদ্দেশে (সাধারণত এজন্যই যান বাংলাদেশিরা) গিয়ে থাকলে সায়দাপেট বাজার পর্যন্ত পা ফেলুন।
এই দুর্গের সবকিছুই পাথর দিয়ে বানানো। এর নির্মাণশৈলী বিস্মিত করার মতো। সব মিলিয়ে অনন্য একটি স্থাপত্য। বিভিন্ন করিডোর আর দুর্গের ছাদেও চাইলে যাওয়া যায়। এত সুরক্ষিত ও শক্তিশালী দুর্গ বা প্রাসাদ আর দেখিনি! ভেতরে প্রবেশ করতে হলে সেতু পেরিয়ে যেতে হয়। কারণ চারদিকে পরিখা (শত্রুপক্ষের আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য প্রতিরক্ষামূলক সুড়ঙ্গ বা লেক)। এরপরই চোখে পড়বে নিরাপত্তায় নিয়োজিত প্রহরীদের মূর্তি।
শুধু বাইরের সৌন্দর্যই নয়, দুর্গের ভেতরে আছে অসাধারণ একটি জাদুঘর। এতে রয়েছে ৯০০-১৪০০ বছর আগের ব্রোঞ্জের দেব-দেবীর অনেক মূর্তি-ভাস্কর্য। সেই সময়ের প্রাণীদের অবয়ব দেখে চোখ কপালে উঠে যেতে পারে! বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক মিশ্রণ দিয়ে কাচের জারে রেখে দেওয়া হয়েছে জন্তু-জানোয়ার।
ভারতীয়দের মধ্যে দেশপ্রেম বা স্বদেশিদের জন্য আলাদা একটা টান আছে। অনেক জায়গায় এর প্রমাণ পাবেন। বিশেষ করে যখন কোথাও ফি দিতে হবে। জাদুঘরেও এটি লক্ষ্য করেছি। এর প্রবেশমূল্য ভারতীয়দের জন্য ১০ রুপি আর বিদেশিদের বেলায় ১০০ রুপি! আপনার গায়ের রঙ যদি ভারতীয়দের মতো হয় আর হিন্দিটাও মোটামুটি জানা থাকলে হয়তো ১০ রুপিতেই ঢুকতে পারবেন। তবে অপ্রীতিকর পরিস্থিতি এড়াতে ১০০ রুপির টিকিট কেনাই ভালো।
জাদুঘরের আরও অনেক কিছু দর্শনীয়। এর মধ্যে অন্যতম খ্যাপাটে দেশপ্রেমিক টিপু সুলতানের ব্যবহৃত যুদ্ধাস্ত্র! রণক্ষেত্রে তিনি কতটা প্রতাপশালী ছিলেন, সেটা বোঝা যায় এখানে। প্রজাদের প্রতি তার প্রেম আর বাঘপ্রীতির নানান উদাহরণও আছে। তিনি যে তলোয়ার ব্যবহার করতেন, তার গায়েও ছিল ডোরা দাগ, হাতলে ছিল খোদাই করা বাঘের মূর্তি। তার ব্যবহৃত রুমালও ছিল বাঘের মতো ডোরাকাটা। এমনকি রাজ্যের সমস্ত সৈনিকের পোশাকে থাকতো বাঘের ছবি। সৈন্যদের ব্যবহার্য তলোয়ার, বল্লম, বন্দুকগুলোর নল, কুদো, হ্যামারও এই খোদাই থেকে বাদ যেতো না।
দ্যা সোর্ড অব টিপু সুলতান অথবা শের-ই-মহিশোর বলা মহিশোরের বাঘের ইতিহাসের বিষয়ে কম বেশি সকলেরই মনে আছে। বাংলাদেশে আমরা ছোটবেলায় বিটিভির কল্যাণে এই সিরিজটি দেখেছিলাম। হ্যা এবার সেই টিপু সুলতানের দূর্গে আজ প্রবেশ করলাম। যেখানে স্ব পরিবারে টিপু সুলতানকে বন্ধি করে হত্যা করা হয়েছিল।
টিপু সুলতান ছিলেন ব্রিটিশ ভারতের মহীশূর রাজ্যের শাসনকর্তা। তিনি একজন বীর যোদ্ধা ছিলেন। ইংরেজদের বিরুদ্ধে তিনি বীরত্ব সহকারে যুদ্ধ করেন। তিনি তাঁর শৌর্যবীর্যের কারণে শের-ই-মহীশূর (মহীশূরের বাঘ) নামে পরিচিত ছিলেন। ভারতের স্বাধীনতামাকীতার জন্য ভারতের বীরপুত্র বলা হয়।
যদিওবা এই দূর্গের কোথাও সহজে দেখা মিলেনা টিপু সুলতান পরিবারের রক্তাক্ত ইতিহাসের কথা।
ইতিহাস মতে, রাজা বিজয়নগর ষোড়শ শতকে জলঘেরা দুর্ভেদ্য দুর্গ গড়ে তোলেন ভেলোরে। এর মধ্যে টিপু সুলতানের নাম আসার কারণ, ১৭৯৯ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময় টিপু সুলতান নিহত হওয়ার পর তার পরিবারকে এখানেই বন্দি করে রাখা হয়। তখন দুর্গে ছড়িয়ে পড়ে বিয়োগান্তক আবহ। তার জীবনের শেষ সময়ের টানাপোড়েনের সঙ্গে এই দুর্গ যুক্ত।
দক্ষিণ ভারতের মহীশূর রাজ্যের শাসক ছিলেন টিপু সুলতান৷ পিতা হায়দার আলী মহীশূর রাজ্যের সেনাপতি ছিলেন৷ শ্রীরঙ্গপত্তনম গ্রামে কাবেরী নদীর একটি ব-দ্বীপে নির্মিত একটি দূর্গ থেকে রাজ্য শাসন করতেন৷ বর্তমানে শ্রীরঙ্গপত্তনম গ্রাম দক্ষিণ ভারতের কর্ণটক রাজ্যের মান্ডিয়া জেলার অন্তর্গত৷ ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর সঙ্গে যুদ্ধে ১৭৯৯ খ্রিস্টাব্দে নিহত হন টিপু সুলতান। টিপুর এক সেনাপতি মীর সাদিক বিশ্বাসঘাতকতা করে ব্রিটিশদের সঙ্গে হাত মেলান৷
যুদ্ধে পরাজিত ও নিহত হবার পর টিপুর রাজপ্রাসাদের সব সদস্যকে ইংরেজরা বন্ধী করে নিয়ে আসেন ভেলোর শহরে। শহরের উপকন্ঠে নির্মিত দুর্গে নারী, শিশু সহ তাদের সবাইকে বন্ধী করে রাখা হয়। পরবর্তিতে এখানে তাদের হত্যা করে দুর্গের অনতিদুরেই একটি কবর স্থানে পর্যায়ক্রমে তাদের সবাইকে সমাহিত করা হয়।
ভারতের প্রাচীন ভেলোর শহরের এই দুর্গ সেখানকার ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলো। ১৭৮০ সালে সুলতান হায়দার আলী ইংরেজ শাসকদের বিতাড়ন অভিযানের অংশ হিসেবে ভেলোর দুর্গ দখল করেন। তবে, তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র টিপু সুলতান পিতার ইংরেজ বিতাড়ন যুদ্ধ পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার সময় ১৭৯৯ সালে এক যুদ্ধে প্রাণ হারান।
মাত্র ১৫ বছরের কিশোর! আজকের যুগ হলে নবম শ্রেনীর পাঠ্যবই নিয়ে ব্যাস্ত থাকতেন। অথচ তখন তিনি যুদ্ধের ময়দানে। হ্যা তিনি মুহীশুরের বাঘ টিপু সুলতান। পিতা হায়দার আলী নিজের যোগ্যতাবলে সেনাপতি থেকে মহীশুর তথা আজকের কর্নাটকের শাষক হন। ১৯৬৫ সালে মালাবার অভিযানে মাত্র ১৫ বছরের কিশোরপুত্র টিপু সুলতানের সাহস আর রণকৌশল দেখে তাজ্জব হয়ে যান পিতা হায়দার আলী। তারপর জীবনের পুরোটা সময় কেটেছে যুদ্ধের ময়দানে। একদিকে মারাঠা শক্তি, অন্যদিকে নিজাম। তারচেয়ে ও বড় শত্রু ইংরেজ। পিতা পুত্র মিলেই একের পর এক হামলা চালিয়েছেন ইংরেজদের উপর। ১৭৮২ সালে যুদ্ধে আহত পিতা যখন মৃত্যু সয্যায় তখনও টিপু সুলতান ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ময়দানে। পিতাকে শেষবারের মত একনজর দেখতেও পারেন নি!
১৭৫৭ সালে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ উদ্দোল্লার পতনের পর ইংরেজরা যখন একের পর এক রাজ্য দখল নিতে শুরু করে। দুর্বল রাজ্য প্রধানরা ইংরেজ আক্রমনে খড়কুটোর মত ভেসে যেতে লাগলো। তখন প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তোলেন ব্যাঘ্র খ্যাত মহীশুরের টিপু সুলতান। কিন্তুু শেষ রক্ষা হয় নি। ১৭৯৯ সালে চতুর্থ ও শেষ মহীশুর যুদ্ধে ইংরেজদের কাছে পরাজিত টিপু সুলতানকে গুলি করে হত্যা করা হয়। টিপু সুলতানের এ পরাজয়ের পর পুরো দক্ষিন ভারত ইংরেজদের করায়ত্ব হয়।
বাঘ আর টিপু সুলতান যেন একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ। তার আমলে রাজ্যের পতাকায় কানাড়ি ভাষায় লেখা থাকতো ” বাঘ ই ইশ্বর “। তিনি বলতেন আমি শেয়ালের মত হাজার বছর বাচতে চাই না, বাঘের মত এক মুহুর্ত বাচতে চাই “। তার সিংহাসন, রাজ প্রাসাদ সবখানে বাঘের মাথার মুর্তি শোভা পেতো। পোষাক পরতেন বাঘের মত ডোরাকাটা। রাজ্যের সৈন্যদের পোষাক ও ছিলো ডোরাকাটা। তলোয়ারের হাতল সহ সব যুদ্ধাস্ত্রে থাকতো বাঘের মোটিফ। এমনকি তিনি নিজেই প্রাসাদে বাঘ পালতেন, তার শোবার ঘরের সামনের খাচায় ও ছিলো দুটো বাঘ। টিপু নামের অর্থ ও বাঘ। অার ইংরেজদের কাছে তিনি ছিলেন বাঘের ন্যায় মুর্তিমান আতংক। ফলে টিপু সুলতানের আজন্ম শত্রু ইংরেজরাই তাকে “মহীশুরের বাঘ” খেতাবে ভুষিত করেছিলো। টিপু সুলতানের ছিলো ৪ স্ত্রী, ১৫ পুত্র, ৮ কন্যা। সবাইকে ভেলরের এই দূর্গে হত্যা করা হয়। এখনো দুর্গের দেয়ালে উঠলে দর্শনার্থীরা অনুভব করতে পারে সেই সব বন্ধী নারী পুরুষের অার্তচিৎকার। দুর্গের দেয়ালের প্রতি কোনায় কোনায় সুলতান আর সুলতানাদের স্বপ্নের অপমৃত্যুর স্পষ্ট ছায়া দেখতে পাওয়া যায়।
লেখক,
নির্বাহী সম্পাদক
দৈনিক সকালের কক্সবাজার।
ও
সংবাদ অনুবাদক
বাংলাদেশ বেতার, কক্সবাজার।
মোবাইল : +৮৮ ০১৮১৯-০৭০৫১৩
আমরা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।