বাংলা ট্রিবিউন:
রাজনীতি থেকে অবসরে চলে গেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমান। অন্তত দেড় থেকে দুই মাস আগে নিজের হাতে লেখা পদত্যাগপত্র দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের কাছে দিয়েছেন সাবেক এই সেনাপ্রধান। বুধবার (৬ নভেম্বর) বাংলা ট্রিবিউনকে মাহবুবুর রহমান নিজেই রাজনীতি থেকে অবসরে যাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
বিগত কয়েক বছরে বিএনপির সিনিয়র নেতাদের মধ্যে ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরী, ইনাম আহমেদ চৌধুরীর পর গতকাল মঙ্গলবার (৫ নভেম্বর) বিএনপি ছাড়েন আরেক ভাইস চেয়ারম্যান এম মোরশেদ খান। মাহবুবুর রহমানের পদত্যাগের মধ্য দিয়ে বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরামের কেউ প্রথমবারের মতো দল ছাড়লেন।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির একাধিক সূত্র জানায়, মাহবুবুর রহমানের পদত্যাগের পেছনে কারণ দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সরাসরি বিরোধিতা করা। গত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর তিনি একাধিক অনুষ্ঠানে দলের চেয়ারম্যান নিয়ে মন্তব্য করেন। এরপরও সাবেক এই সেনা কর্মকর্তা স্থায়ী কমিটির বৈঠকে অংশ নিতেন। গত আড়াই মাস ধরে বৈঠকে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকেন তিনি।
গত জানুয়ারিতে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে মাহবুবুর রহমান অভিযোগ করেন, একাদশ নির্বাচনে গিয়ে বিএনপি ভুল করেছে। যদি দলের নেতৃত্ব দিতে হয়, তারেক রহমানকে দেশে আসতে হবে। দেশে এসেই তাকে নেতৃত্ব দিতে হবে। বিদেশ থেকে দলের নেতৃত্ব দেওয়া সম্ভব নয়।
জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিয়ে দলীয় ফোরামে বিভক্তি ছিল। তবে দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান দুজনই নির্বাচনের বিষয়ে একমত ছিলেন। দলীয় ফোরামে অনেক রকম আলোচনা হয়েছে।
রাজনীতি থেকে অবসরের বিষয়ে মাহবুবুর রহমানের সঙ্গে বাংলা ট্রিবিউনের বিস্তারিত কথা হয়। তিনি বলেন, ‘কথাটা ঠিক, আমি রাজনীতি করি না। রাজনীতি থেকে সরে এসেছি। আমি রিজাইন করেছি দল থেকে। দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ও প্রাথমিক সদস্যপদ প্রত্যাহার করে নিয়েছি। দেড় মাস থেকে দুই মাস আগে।’
কী কারণে অবসর, এমন প্রশ্নের জবাবে লে. জে. (অব.) মাহবুব বলেন, ‘কারণ হচ্ছে আমি বয়স্ক মানুষ। সামনের ডিসেম্বরে ৮০ বছর পূর্ণ হবে। রাজনীতিতে কনট্রিবিউট করার মতো আমার কিছু নেই।’
সেনাবাহিনী থেকে অবসর গ্রহণের পর বিএনপির রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হন মাহবুবুর রহমান। ২০০১ সালে অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির মনোনয়নে দিনাজপুর-২ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে একই আসন থেকে নির্বাচন করে আওয়ামী লীগের প্রার্থী খালিদ মাহমুদ চৌধুরীর কাছে পরাজিত হন।
রাজনীতি থেকে পদত্যাগের আরও কিছু কারণ উল্লেখ করেন মাহবুবুর রহমান। তিনি বলেন, ‘আমি রাজনীতি নিয়ে বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছি। বাংলাদেশে রাজনীতি নেই। এখানে কোনও আদর্শও নেই। এখানে রাজনীতির নামে একটা এক্সপ্লয়টেশন চলছে। একটা তোষামোদ, ধাপ্পাবাজি ও মিথ্যাচারিতা চলছে।’
অবসরের চিঠি কোথায়, কার কাছে দিয়েছেন, এমন প্রশ্নের জবাবে মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘বেগম জিয়ার কাছে তো পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। আমি চিঠি দিয়েছি মহাসচিব বরাবর।’
চিঠি দেওয়ার পর দলের প্রতিক্রিয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘দল থেকে কিছু বলা হয়নি। আমার যেটা অব্লিগেশন; আমি ফ্রি অব দ্য অব্লিগেশনস।’
এ বিষয়ে মন্তব্য জানতে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও বিএনপি মহাসচিবকে পাওয়া যায়নি। পরে বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে যোগাযোগ করা হয় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘এ বিষয়টি মহাসচিব বলতে পারেন। কারণ, বিষয়টি আমাদের নলেজেই আসেনি। স্থায়ী কমিটির বৈঠকে তো বিষয়টি উত্থাপিত হয়নি।’
কিন্তু চিঠি দেওয়ার বিষয়টি মাহবুবুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে নিশ্চিত করেছেন বলে জানালে খন্দকার মোশাররফ বলেন, ‘তিনি রিজাইন করে থাকলে এটা তিনি নিজেই কেন পাবলিক করলেন না? এই তো সেদিন, সিলেটের কয়েকজন নেতা পদত্যাগপত্র দিয়েছেন মহাসচিবের কাছে। সেটি গৃহীত হয়নি। মাহবুবুর রহমান যদি পদত্যাগপত্র দিয়ে থাকেন, তাহলে মহাসচিব জানবেন। গ্রহণ করতে হলে তো স্থায়ী কমিটিতে উঠবে। চিঠি পেলেই তো এজেন্ডা হবে না।’
বাংলা ট্রিবিউনের সঙ্গে আলাপকালে মাহবুবুর রহমান অবশ্য সেরকমই শঙ্কা প্রকাশ করেন। তার মন্তব্য, ‘মহাসচিব কিছু বলেননি, তার সঙ্গে বিস্তারিত কথাও বলিনি। জাস্ট চিঠি দিয়েছি। চিঠি পেয়েছেন কিনা, তাও জানি না। আমি গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে চিঠি দিয়েছি। আমি নিজেই দিয়েছি। কথাও বলেছি। হাতে লেখা চিঠি দিয়েছি। কোনও কপি রাখিনি।’
গতকাল মঙ্গলবার এম মোরশেদ খান তার পদত্যাগপত্রে উল্লেখ করেন, রাজনীতির অঙ্গনে তার পদচারণা দীর্ঘকালের। কিন্তু দেশের রাজনীতি ও দলের অগ্রগতিতে নতুন কিছু সংযোজন করার মতো সঙ্গতি নেই। তাই ব্যক্তিগত কারণে তিনি সক্রিয় রাজনীতি থেকে অবসরে যাচ্ছেন।
যদিও বিএনপির দায়িত্বশীল সূত্রগুলো বলছে ভিন্ন কথা। তাদের পর্যবেক্ষণ, মোরশেদ খান দলে গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছিলেন। দলের সম্ভাব্যতা যাচাই করে তিনি কোনও সম্ভাবনা দেখতে পাননি। বয়সের সামর্থ্যের পাশাপাশি নিজের ব্যবসায়িক লাভ-ক্ষতির জায়গা থেকে তিনি অবসরের চিন্তা করতে পারেন।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার মনে করেন, মোরশেদ খানের পদত্যাগের পেছনে তিনি যে কারণ দেখিয়েছেন, তা দৃশ্যত কারণ। এর নেপথে অন্য কারণ আছে।
সাবেক এই স্পিকার বলেন, ‘দেশের অবস্থা সম্পর্কে আঁচ করতে পারেন। আওয়ামী লীগের মধ্যেও অস্থিরতা, এখন বিএনপির মধ্যে অস্থিরতা সৃষ্টি করতে চায় একটি মহল।’ এর অংশ হিসেবেই এসব পদত্যাগ বলে দাবি করেন তিনি।
জমির উদ্দিন সরকার বলেন, ‘মোরশেদ খান যেসব কথা বলেছেন, এগুলো বলার কথা। দলের প্রতি তার যথেষ্ঠ শ্রদ্ধা আছে। দলের প্রতি আমাদের পার্টির যারা আছেন, সবারই শ্রদ্ধা আছে। তারপর কেউ কেউ কিছু স্টেটমেন্ট দিচ্ছে। দেশের অবস্থা কী, আপনারা বুঝতে পারছেন না।’
১/১১ সময় বিএনপির সংস্কারবাদীদের একজন ছিলেন মাহবুবুর রহমান। এর জেরে দলের সাধারণ নেতাকর্মীরা তাকে মানিক মিয়া এভিনিউতে ধাওয়া দিয়েছিলেন। অভিযোগ আছে, কয়েকজন কর্মী তার গায়েও হাত দেয়। যদিও পরে ডেকে এনে তাকে দলে পদ দেন খালেদা জিয়া।
২০১৯ সালে বইমেলায় লেখক মহিউদ্দিনের ‘এক-এগারো বাংলাদেশ ২০০৭-২০০৮’ নামে একটি বই প্রকাশিত হয়। সেই বইয়ে মাহবুবুর রহমানের একটি সাক্ষাৎকার আছে। সেখানে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সম্পর্কে মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘১/১১-এর পরে বিএনপিতে ইনিশিয়ালি আমার একটু অসুবিধা হয়েছিল। যা-ই হোক, দল আন্ডারস্টুড মাই পজিশন। দল মানে খালেদা জিয়া। তারেক স্টিল নট হ্যাপি মাই পজিশন।’
এই সাক্ষাৎকারে তারেক রহমানকে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব করা প্রসঙ্গে মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘গ্র্যাজুয়াল মুভ করা হলে এক জিনিস। কিন্তু একেবারে সিনিয়র জয়েন্ট সেক্রেটারি? এটা একটা ব্লানডার!’
আমরা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।