আলমগীর মানিক, রাঙামাটি
দেশের অভ্যন্তরীণ উন্মুক্ত জলাশয়ের মধ্যে প্রাকৃতিক সম্পদ ও সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ সর্ববৃহৎ এবং দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় কৃত্রিমভাবে তৈরি লেকগুলোর মধ্যে অন্যতম রাঙামাটির কাপ্তাই হ্রদ। ৬৮,৮০০ হেক্টর আয়তনের এ লেকটি মূলত জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য তৈরি হলেও মৎস্য উৎপাদন, কৃষিজ উৎপাদন, জলপথে যাতায়াত, ফলজ ও বনজ দ্রব্য দুর্গম পথে পরিবহন, জেলে, ব্যবসায়ী ও স্থানীয় জনসাধারণের আর্থসামাজিক উন্নয়ন ও জীবন-জীবিকা থেকে শুরু করে মৎস্য সেক্টরে কাপ্তাই লেক গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে আসছে। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে কম বৃষ্টিপাত, লেকের সঙ্গে সংযুক্ত নদীগুলোর নাব্যতা হ্রাস, লেকের পানির গভীরতা কমে যাওয়া এবং রুই জাতীয় মাছের প্রধান চারটি প্রজননস্থল (কাসালং চ্যানেল, মাইনিমুখ; বরকল চ্যানেল, জগন্নাথছড়ি; চেংগী চ্যানেল, নানিয়ারচর; রিংকং চ্যানেল, বিলাইছড়ি) নষ্ট হয়ে যাওয়া, নিষিদ্ধ জাল ব্যবহার, প্রজনন মৌসুমে পোনা মাছ ও মা মাছ নিধন, শুষ্ক মৌসুমে অধিক মাছ আহরণ, মনুষ্য সৃষ্ট চাপ এবং প্রবাহমান পানি থেকে স্থির পানিতে পরিবর্তনের কারণে কাপ্তাই লেক থেকে কিছু দেশীয় প্রজাতির মাছ ইতিমধ্যেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে এবং হ্রদের জীববৈচিত্র্য ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছে।
বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন কর্পোরেশন কর্তৃক কাপ্তাই হ্রদে নিয়মিত কার্পজাতীয় মাছের পোনা ছাড়া হলেও দিনদিন তার উৎপাদন কমে যাওয়ার পাশাপাশি ছোট মাছের পরিমাণ ব্যাপক হারে বেড়ে যাওয়ায় হ্রদে কার্পজাতীয় মাছের উৎপাদন ৮৫ শতাংশ থেকে কমে বর্তমানে ৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে বলেও সংস্থাটির এক গবেষণায় উঠে এসেছে। হ্রদে ছোট মাছের আধিক্য থাকলে সেখানে খাদ্য সংকটে কার্পজাতীয় মাছের বৃদ্ধি কম হয়। তাই কাপ্তাই হ্রদের ছোট মাছের সংখ্যা দ্রুত কমানোর নির্দেশও দিয়েছে সংশ্লিষ্ট্য মৎস্য সম্পদ মন্ত্রণালয়।
এমতাবস্থায় দেশীয় মৎস্য প্রজাতির এক বৈচিত্র্যময় ও সমৃদ্ধশীল জলভান্ডার এই হ্রদের বিলুপ্ত প্রজাতির চিতল, রুই, মহাশোলসহ গভীর পানিতে থাকা মাছগুলোর প্রজনন বাড়াতে কাপ্তাই হ্রদের অভয়াশ্রমগুলোকে নতুন করে সংস্কার করে সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়র কর্পোরেশন বিএফডিসি রাঙামাটি কেন্দ্র কর্তৃকপক্ষ। কাপ্তাই হ্রদের ৭টি অভয়াশ্রমকে মাছের নিরাপদ আশ্রয়স্থল ও প্রজনন ক্ষেত্র হিসেবে গড়ে তুলতে ইতিমধ্যেই এসব অভয়াশ্রমগুলোতে সার্বক্ষনিক নজরদারির পাশাপাশি বাঁশ ও গাছের গুড়ি ফেলা শুরু করা হয়েছে।
এতে করে বিলুপ্ত হতে যাওয়া বিভিন্ন দেশীয় প্রজাতির মাছের নিরাপদ প্রজনন নিশ্চিত হবে মন্তব্য করে বিএফডিসি রাঙামাটি কেন্দ্রের ব্যবস্থাপক নৌবাহিনীর কর্মকর্তা তৌহিদুল ইসলাম জানিয়েছেন, কাপ্তাই হ্রদের বিশাল এলাকাকে পূর্নাঙ্গ নজরদারিতে রাখা বেশ কষ্টসাধ্য ব্যাপার। সেই বিষয়টি মাথায় রেখে ইতিমধ্যেই কাপ্তাই মূল তিনটি পয়েন্ট কাচালং নদীর মোহনা, ডিসি বাংলো ও বিএফডিসি অফিস সম্মুখের অভয়াশ্রমগুলোতে প্রাথমিক পর্যায়ে বাঁশের ঘেরাও দিয়ে মধ্যখানে গাছের ডালপালা ও গুড়ি ফেলা শুরু করেছি। এতে করে মাছের নিরাপদ আবাসস্থল গড়ে উঠার পাশাপাশি সঠিক সময়ে এবং নিয়মতান্ত্রিকভাবে মৎস্য প্রজনন হবে। এছাড়াও ইতিমধ্যেই কাপ্তাই হ্রদের সর্বত্রই হ্রদের তলদেশ থেকে যেকোন ধরনের গাছের গুরি কাটা ও উপড়ে ফেলায় নিষেধাজ্ঞা জারি করে দেওয়া হয়েছে।
ঢাকা থেকে রাঙামাটির মৎস্য ব্যবসায় বিনিয়োগ করা কয়েকজন ব্যবসায়ি ও স্থানীয় সংশ্লিষ্ট স্টেক হোল্ডাররা জানিয়েছেন, সার্বিক ব্যবস্থাপনায় প্রয়োজনীয় জনবল ও ইকুইপমেন্ট বৃদ্ধির মাধ্যমে আরো জোরালো কার্যক্রম গ্রহণের পাশাপাশি মাছ অবৈধ মৎস্য শিকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর নজরদারি নিশ্চিত করা, হ্রদে জেলের সংখ্যা আর বৃদ্ধি না করা, ইঞ্জিনচালিত নৌযান বৃদ্ধিরোধ করাসহ মাছের অভয়াশ্রম ও প্রজনন কেন্দ্রসমূহকে সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করাসহ,বিএফডিসির নিজস্ব হ্যাচারিতে উৎপাদিত রেনুর মাধ্যমে নির্দিষ্ট আকারের পোনা কাপ্তাই হ্রদে অবমুক্ত করতে পারলে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ এই হ্রদটিকে আমিষের ভান্ডারে পরিণত করা স্বল্পতম সময়েই সম্ভবপর হবে এবং কাপ্তাই হ্রদ শীঘ্রই পূর্ন যৌবন ফিরে পাবে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন স্থানীয়রা।
মাছের উৎপাদন বাড়াতে কাপ্তাই হ্রদে ফেলা হচ্ছে গাছের গুড়ি
পড়া যাবে: [rt_reading_time] মিনিটে
আমরা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।