মোঃ ইলিয়াছ মিয়াঃ
আজ ১৯ আগস্ট, বিশ্ব মানবিকতা দিবস। সারা বিশ্বে মানবিক কর্মকান্ডের কর্মীদের সম্মান জানানোর লক্ষ্যে জাতিসংঘ এই দিবসটি পালন শুরু করে। জাতিসংঘ কো-অর্ডিনেশন অফিস এটি সারাবিশ্বে জরুরী সহায়তায় যুক্ত সেবাকর্মী বিশেষতঃ যারা সেবাকালীন মৃত্যুবরণ করে, নিহত বা আহত হয় তাদের স্মরণে পালন করে। কালক্রমে আজ সারাবিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশ এটি পালন করছে।

বাংলাদেশে ২০১৭ সালে রোহিঙ্গাদের সর্বশেষ আগমনের পর বর্তমানে তাদের সেবায় কাজ করছে হাজারো মানবিকতা কর্মী। ১২ লাখের কাছাকাছি রোহিঙ্গা শরণার্থীরা দীর্ঘ নিপীড়নের পর ২৫ আগস্ট, ২০১৭ তারিখে বাংলাদেশে সর্বশেষ অনুপ্রবেশ করে। ষাটের দশক থেকে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে এ অঞ্চলে মাথাগোঁজার ঠাই খুঁজেছে তারা বারবার।

বলা হয়ে থাকে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা সারাবিশ্বে সবচেয়ে নিপীড়িত জনগোষ্ঠী। মিয়ানমার সরকারের উগ্রজাতীয়তাবাদী চিন্তা ও বিশ্ব বাণিজ্য সম্প্রসারণের চায়না নীতির বলি হয়েছে আত্মপরিচয় সংকটে ভুগা এই জনগোষ্ঠী।

বর্তমানে ১২ লাখ রোহিঙ্গার জন্য কাজ করছে দেশি-বিদেশি অনেক মানবিক কর্মী। রোহিঙ্গাঢল যখন সীমান্ত অতিক্রম করেছিল তখন বাংলাদেশে তৈরি হয়েছিল এক অপূর্ব সাড়া। মানুষ যার যা ছিল তা দিয়ে এই মানুষগুলোকে সহযোগিতা করেছিল। নিজেদের খাবার, থাকার জায়গা, কাপড় দিয়ে উখিয়া-টেকনাফের মানুষ তাদের সহযোগিতা করেছে। এই অঞ্চলের মানুষগুলোর ঋণ শোধ করার নয়। সেদিন যদি তারা বেঁকে বসত তাহলে কি হত বলা মুশকিল।

তাদের সাথে সারা বাংলাদেশ থেকে যে সাড়া মিলেছে তা স্মরণযোগ্য। মানুষ গাড়িতে গাড়িতে ত্রাণ নিয়ে হাজির হয়েছে। তারা মানবিক কর্মী হিসেবে প্রথম শ্রেণীর।

বর্তমানে ৩০ টির কাছাকাছি ক্যাম্পে কোনমতে এই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বসবাস করছে। দেশী বিদেশী ১৩০ টিরমত জাতিসংঘ এজেন্সী ও এনজিও কাজ করছে।

নানা সেক্টর, দল, ক্লাস্টারে বিভক্ত হয়ে সুসমন্বয়ের মাধ্যমে তারা কাজ করছেন। সরকারের প্রশাসন, নাগরিক সমাজ, আন্তর্জাতিক গোষ্ঠী, জাতিসংঘসহ সকলে ভাল কাজ করছে।

মানবিক কর্মীরা এই বিষয়ে ফার্স্ট রেসপন্ডার হিসেবে সর্বাগ্রে মাঠপর্যায়ে কাজ করছে। অশিক্ষিত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সাথে তারা প্রতিনিয়ত ওঠা বসা করছে। অনেকে তাদের আচরণিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে হা-হুতাশ করেন। তাদের মনে রাখতে হবে এই জনগোষ্ঠী বিগত সময় শিক্ষা, সংস্কৃতি ও আধুনিক মনমানসিকতা গড়ে তুলতে পারিনি।

তাদের কাছ থেকে নূন্যতম সুন্দর আচরণ পেলে আশ্চর্য হওয়ার কিছু থাকবেনা। আজকের পৃথিবীতে সভ্য জাতির লোকেরাই সবচেয়ে বেশি অন্যের অধিকার হরণ করছে। তথাকথিত সভ্যরা যুদ্ধ, সংঘাত বাধিয়ে লুটেপুটে বিভিন্ন দেশের অর্থনীতি শেষ করে দিচ্ছে।

অনেক মানবিক কর্মী শুধুমাত্র বেশি অর্থের লোভে শরনার্থী ক্যাম্পে কাজ করছে। তারা ক্যাম্পে সুবিধাভোগী জনগোষ্ঠীর প্রতি ঘৃণাভরে থাকায়। ক্যাম্প থেকে বের হলে নিজের তথাকথিত সভ্যতা দেখানোর জন্য এককাঠি সরেস আচরণে ব্রতী হন।

তাদের আর নিপীড়ক তথাকথিত সভ্যদের কোন পার্থক্য নেই।কেউ ম্যাক্রো লেভেলে কেউবা মাইক্রো লেভেলে শোষণ করছে। এই যা তফাৎ।

তাদের মনে রাখতে হবে আমরা মানবিক কর্মী হয়েছি একটি নিপীড়িত জনগোষ্ঠীকে সেবা ও শুশ্রূষার মাধ্যমে তাদের প্রত্যাবাসনের আগে পর্যন্ত টিকিয়ে রাখা। তাদের মনে আশা জাগানো এই বলে যে তারা একদিন তাদের নিজ দেশে ফেরত যেতে পারবে।

মানবিক কর্মীদের আচরণ বিষয়ে জাতিসংঘ নির্ধারিত মান অনুশীলন করা প্রয়োজন। এই বিষয়ে সারাবিশ্বে গ্রহণযোগ্য স্পিয়ার স্ট্যান্ডার্ড মেনে চলা দরকার। এতে সেবার মান, সেবাগ্রাহক ও সেবাদাতার মধ্যকার সম্পর্ক মধুর হতে পারে। যা যেকোন জনগোষ্ঠীর নিপীড়িত মনে আশার আলো ফুটাতে পারে যা তাদের সভ্য হওয়ার আকাঙ্খাকে তীব্র করবে।

সেবার আদর্শ মানদণ্ডের সাথে সহায়তায় প্রেরিত ত্রাণ, অর্থ, লজিস্টিক সাপোর্ট এর কার্যকর ব্যবহার ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। মানুষের দানের টাকায় ভোগ-বিলাসে মত্ত হওয়া যাবে না। এ বিষয়ে যতক্ষণ না প্রয়োজনীয় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত না হবে ততক্ষণ মানবিক কর্মী ও মানবতার সংজ্ঞার আবেদন পরিপূর্ণ হবে না।

রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জন্য গত ৩ বছরে যে সহায়তা এসেছে, অভিযোগ আছে তা যথাযথ খাতে ব্যবহার হয়নি। আমরা নাগরিক দায়বদ্ধতা থেকে যদি এসব বিষয়ে সোচ্চার না হয় তাহলে এ বিষয়ে কোনদিন সমাধান আসবে না।

রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর আগমনের কারণে বাংলাদেশের অনেক ক্ষতি হয়েছে। পরিবেশগত সংকট, জনসংখ্যাগত অনুপাত, জীববৈচিত্র্য ধ্বংস, অবকাঠামোর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে প্রভূত। এসব ক্ষয়ক্ষতি কোনদিন পূরণ করা সম্ভব হবে না। তারপরেও মানুষ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিবেশীয় উপাদান হিসেবে মানুষের বেঁচে থাকাকে প্রাধান্য দিতে হবে। সেক্ষেত্রে কত কম ক্ষতি করে পরিবেশ ও ইকোলজিকাল ভারসাম্য ঠিক রাখা যায় সেদিকে নজর দিতে হবে।

স্থানীয় সংকটে স্থানীয় জনগোষ্ঠী, স্থানীয় সরকার ও স্থানীয় নাগরিক বা প্রতিষ্ঠান সবচেয়ে বেশি বুঝে। রোহিঙ্গা ব্যবস্থাপনায় তাই স্থানীয় সক্ষমতাকে কাজে লাগানো উচিত।

এ অঞ্চলে যেসব স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, ক্লাব রয়েছে তাদেরকে এ সুযোগে কাজে লাগানো উচিত। রোহিঙ্গা ব্যবস্থাপনার ভেতরে-বাহিরে তারা সবচেয়ে ভাল ভূমিকা রাখতে পারত। স্থানীয় সংকট সমাধানে স্থানীয় সক্ষমতার ব্যবহার একটি আন্তর্জাতিক পদ্ধতি।

কক্সবাজার অঞ্চলে গড়ে ওঠা সংগঠনগুলোর সাথে আন্তর্জাতিক দাতাগোষ্ঠী ও সেবা সংগঠনের সমন্বয় ও কর্মবভক্তি বদলে দিতে পারে এই অঞ্চলের সংকটকে। একইসাথে আন্তর্জাতিক আলোচনা রোহিঙ্গা সংকটের স্থায়ী সমাধানের পাশাপাশি সংকটকে সুযোগে বদলে দিতে পারে।

লেখকঃ
প্রধান নির্বাহী
সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্ট, হিউম্যান রাইটস এন্ড ডেভেলপমেন্ট ফোরাম (সিইএইচআরডিএফ)।