মকবুল আহমেদ:
জন্ম: মোশতাক আহমদ জন্মগ্রহণ করেন ৮ জানুয়ারি ১৯৪০ সালে রামু সদরের মন্ডলপাড়ার পৈতৃক নিবাসে। তাঁর পিতার নাম রশিদ আহমদ, মাতার নাম মুনীরা বেগম। বাবা রশিদ আহমদের এক ভাই ও চার বোনের যৌথ একান্নবর্তী পরিবারে মোশতাক আহমদের জন্ম। রশিদ আহমদ বিএ পাস করে কক্সবাজারস্থ সেন্ট্রাল কোঅপারেটিভ ব্যাংকের ম্যানেজার হিসেবে কাজ করেছিলেন। এক সময় তিনি রামু খিজারী উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতাও করেন। মোশতাক আহমদরা ছিলেন ৫ ভাই।

শিক্ষাদীক্ষা: মোশতাক আহমদের প্রাথমিক শিক্ষার হাতেখড়ি রামু সদরের মন্ডলপাড়ার বাড়ির পাশের মক্তবে। পরে খিজারী উচ্চ বিদ্যালয় সংলগ্ন সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় হতে তিনি ৫ম শ্রেণী সমাপ্ত করেন। ৬ষ্ঠ শ্রেণী থেকে দশম শ্রেণী পড়াশোনা করেন রামু সদরে অবস্থিত প্রাচীন বিদ্যাপীঠ রামু খিজারী উচ্চ বিদ্যালয়ে। এরপর চট্রগ্রাম কলেজ হতে আই এ পড়া শেষ করে তিনি ভর্তি হন বিএ অনার্স পড়তে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে। সেখান থেকে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে মাস্টার্স পড়া শেষ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় তিনি সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের আবাসিক ছাত্র ছিলেন এবং হলে থেকে পড়াশোনা করেন। মোশতাক আহমদের বিশ্ববিদ্যালয়ের তখনকার ছাত্র জীবনের অনেক বন্ধু বাংলাদেশের অনেক কৃতি ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে একই রুমে চারজন করে থাকতেন। তাঁর রুমমেট ছিলেন ড. মুহম্মদ ইউনূস, চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি ও ইতিহাসের অধ্যাপক ড. আলমগীর মো: সিরাজউদ্দিন, চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. এখলাসউদ্দিন আহমদ প্রমুখ। বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর ঘনিষ্ট বন্ধুদের মধ্যে ছিলেন লেখক-কবি ও সাবেক সচিব এবং সাবেক বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক মঞ্জুরে মওলা, কবি ও সাবেক সচিব মোফাজ্জল করিম, রাজনীতিবিদ কাজী জাফর আহমদ, রাশেদ খান মেনন, মতিয়া চৌধুরী, জাস্টিস আমিরুল কবির চৌধুরী, জাস্টিস এম আজিজ (বরিশাল) বিবাহ ও সন্তান-সন্ততি: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত অবস্থায় অনার্স (৩য় বর্ষে) ফাইনাল ইয়ারে থাকতেই ১৯৬৬ সালে রামু উপজেলার জোয়ারিয়ানালা নিবাসী জনাব ওয়াছিউর রহমান কন্ট্রাক্টরের কন্যা রাশেদা বেগমের সাথে মোশতাক আহমদের বিয়ে হয়। তখন ওয়াছিউর রহমান কন্ট্রাক্টর ঢাকায় বাসা নিয়ে বসবাস করতেন। মোশতাক আহমদের ৫ কন্যা ও ১ ছেলে।

কর্মজীবনে প্রবেশ: বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়া শেষ করে মোশতাক আহমদ ১৯৬৩ সালে সাতকানিয়া কলেজে ইংরেজি বিষয়ে লেকচারার পদে যোগদান করেন। সাতকানিয়া কলেজে চাকুরী করাকালীন শিক্ষকদের মধ্যে একমাত্র যাঁর নাম মনে পড়ে তিনি হলেন ফিজিক্সের শিক্ষক বোয়াল খালী নিবাসী অসিত লালার কথা। তিনি কক্সবাজারে ওকালতি করতে আসা এডভোকেট চন্দ্রলালার ভাইপো ছিলেন।
উল্লেখ যে, স্বাধীন পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার পর উচ্চ শিক্ষিত বাঙালির ভবিতব্য স্কুল কলেজে শিক্ষকতা ছাড়া পাকিস্তান রাষ্ট্রে তখনও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃজন হয় নি। যা কিছু চাকুরী সৃজন হলেও তাও বাঙালিদের ভাগ্যে জুটতো কম।

মোশতাক আহমদ যখন সাতকানিয়া কলেজে যোগ দেন তখন কক্সবাজার অঞ্চলের প্রায় ২০০ জন ছাত্র সাতকানিয়া কলেজে লেখাপড়া করছিলেন। উল্লেখ্য যে তখনও কক্সবাজার মহকুমা অঞ্চলে কোনো কলেজ প্রতিষ্ঠা হয় নি। তখন এ অঞ্চলের অধিকাংশ ছাত্ররা পড়তে যেতেন সাতকানিয়া কলেজে কিংবা কাননগোপাড়াস্থ স্যার আশুতোষ কলেজে।

মোশতাক আহমদের ভাষ্য মতে, কলেজে যোগদানের মাস-দুয়েক পর মহেশখালীর আওয়ামী লীগ নেতা মরহুম আবদুল্লাহ খানের ছেলে শহীদুল্লাহ-র সাথে সাতকানীয়া কলেজের কিছু স্থানীয় ছাত্রের বিরোধ ও মারামারির ঘটনার জের ধরে কক্সবাজার অঞ্চলের ছাত্রদের পক্ষ নিয়ে মোশতাক আহমদ চাকুরী থেকে ইস্তফা দেন এবং ছাত্রদের সংগঠিত করে দলেবলে এসে কক্সবাজার এলাকায় একটি কলেজ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগে শরিক হন। তখন ১৯৬৩ সাল। কক্সবাজার কলেজ প্রতিষ্ঠার একেবারে সূচনা লগ্নে স্বল্প সংখ্যক ছাত্র ভর্তি নিয়ে যখন কলেজ শুরু হতে যাচ্ছিল তখন মোশতাক আহমদ সাতকানিয়া কলেজ থেকে একদল ছাত্র নিয়ে এসে যোগ দেয়ায় কক্সবাজার কলেজ প্রতিষ্ঠা লগ্নে প্রাণের সঞ্চার হলো। মোশতাক আহমদও কলেজের শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়ে নতুন কলেজ প্রতিষ্ঠার কর্মযজ্ঞে নেতৃত্ব দিতে তৎপর হলেন। মোশতাক আহমদ বলেন, তখন নতুন কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ পান ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরের জনাব শামসুল হক। কলেজ প্রতিষ্ঠা লগ্নে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন জানে আলম চৌধুরী, শমশের উদ্দিন আহমদ, শাহাবুদ্দিন চৌধুরী, মমতাজউদ্দিন আহমদ প্রমুখ।

মোশতাক আহমদ বলেন, কক্সবাজার কলেজ প্রতিষ্ঠায় যাঁরা উদ্যোগী ভূমিকা পালন করেন তাঁরা হলেন স আ ম শামসুল হুদা চৌধুরী, এডভোকেট ফিরোজ আহমদ চৌধুরী, এডভোকেট জ্যোতিশ্বর চক্রবর্তী এবং কক্সবাজার মহকুমার তত্কালীন প্রশাসক প্রভৃতি। মোশতাক আহমদ বলেন, কক্সবাজার কলেজের শুরুতে প্রথম ক্লাস শুরু হয় কক্সবাজার উচ্চ বিদ্যালয়ের শ্রেণী কক্ষে। পরে বর্তমান কলেজ স্থলে স্থান নির্বাচন করা হলে সেখানেই মূল কলেজ ভবন নির্মানের কাজ শুরু হয়। উক্ত সরকারী জায়গাটি কক্সবাজার মহকুমা প্রশাসন কক্সবাজার কলেজের নামে একোয়ার্ড করে নেন।

কক্সবাজার কলেজ প্রতিষ্ঠা লগ্নে সাতকানিয়া কলেজ থেকে একদল ছাত্র নিয়ে যখন মোশতাক আহমদ এসে যোগ দেন এবং কলেজের নানা কাজে নেতৃত্ব দেন তখন তাঁকে আশ্বস্ত করা হয়েছিল মোশতাক আহমদ কক্সবাজার কলেজের অধ্যক্ষ হবেন। পরে বাস্তবে দেখা গেল অধ্যক্ষ করে আনা হলো কক্সবাজারের একজনকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে। এতে মোশতাক আহমদ অভিমান করে এক পর্যায়ে ১৯৬৪ সালে কক্সবাজার ছেড়ে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে (তখনও প্রাইভেট কলেজ) লেকচারার হিসেবে যোগদান করতে চলে যান। কিন্ত সেখানে বেশিদিন রইলেন না। ১৯৬৪ সালের শেষের দিকে কক্সবাজার কলেজের মোশতাক আহমদের প্রাক্তন সহকর্মীরা আবার তাঁকে কক্সবাজার কলেজে নিয়ে আসেন।

কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে থাকতেই তিনি সরকারী কলেজের চাকুরির জন্য পি. এস. সি. (পাবলিক সার্ভিস কমিশন) পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন। পি এস সি পরীক্ষায় কৃতকার্য হলে সরকারীভাবে তাঁকে প্রথম নিয়োগ দেন ঢাকা কলেজে ইংরেজি বিষয়ে পড়ানোর লেকচারার পদে। সরকারী কলেজে নিয়োগ পেয়ে তিনি ১৯৬৫ সালের ৭ই ফেব্রুয়ারি কক্সবাজার কলেজ ছেড়ে ঢাকা কলেজে চলে যান। ঢাকা কলেজে ৬ মাস চাকুরী করার পর তাঁকে বদলী করা হয় চটৃগ্রাম কলেজে। চট্রগ্রাম কলেজে ৬মাস চাকুরির পর বদলী করলে তিনি চলে যান সিলেট সরকারী কলেজে। সিলেট সরকারী কলেজে মাত্র ৩ মাস চাকরী করার পর মোশতাক আহমদ বদলী হয়ে চলে আসেন ১৯৬৬ সালে চট্রগ্রাম সরকারী কমার্স কলেজে।

চট্রগ্রাম সরকারী কমার্স কলেজে তিনি ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত চাকুরী করেন। বিভিন্ন কলেজে চাকুরি করে করে মোশতাক আহমদের মন যেন থিতু হয়ে বসতে চাইছে না কোথাও। চট্রগ্রাম সরকারী কমার্স কলেজে থাককালীন মাঝখানে ১৯৬৮ সালে তিনি পাকিস্তান এয়ার ফোর্স (পি এ এফ)-এ চাকুরির জন্য উদ্যোগী হন। কলেজ ছেড়ে তিনি ফ্লাইট লেপ্টেনেন্ট র‌্যাংকের পদে পাকিস্তান এয়ার ফোর্স (পি এ এফ)-এ যোগদান করতে মোশতাক আহমদ পশ্চিম পাকিস্তান চলে যান।

পশ্চিম পাকিস্তানে প্রশিক্ষণ শেষ করে চাকুরির ৩ মাসের মধ্যেই তাঁর মন আবার উড়ু-উড়ু অবস্থা। এ নতুন চাকুরীতে মন না বসার প্রধান কারন মোশতাক আহমদের ভাষায়- বিশেষ করে বাঙালির প্রতি পশ্চিম পাকিস্থানীদের কটু চোখে দেখা এবং চলতে-ফিরতে বাঙালিদেরকে হেয় প্রতিপন্ন করার প্রবণতা। এর ফলে তিনি পশ্চিম পাকিস্থান থেকে চাকরী ছেড়ে চলে আসার সিদ্ধান্ত নেন। চাকুরী ছেড়ে দিতে তাঁকে কর্তৃপক্ষকে রাজী করাতে হয়েছিল। বিশেষ করে এয়ার মার্শাল নূর খানকে কনভিন্সড করাতে পেরেছিলেন তিনি। এ কাজে মোশতাক আহমদকে সহায়তা করেন ফরিদপুরের বাঙালি স্কোয়ড্রন লিডার রহমত আলী।

পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ফিরে এসে তিনি আবার চট্রগ্রাম কমার্স কলেজে তাঁর পুরোনো শিক্ষকতার চাকুরীতে যোগ দেন। সেখানে থাকতে ১৯৬৯ সালে তিনি প্রফেসর পদে পদোন্নতি লাভ করেন এবং সিলেট সরকারী কলেজে বদলী হন। তখন ৬৯-এর পাকিস্তানের সামরিক শাসন বিরোধী বাঙালির স্বাধিকারের দাবিতে আন্দোলন তুঙ্গে।

এরপর ১৯৭১ সালের বাঙালির ঐতিহাসিক মুক্তিযুদ্ধের বছর। তার আগেই তিনি রামু চলে আসেন।

নানা কলেজের শিক্ষকতার জীবনে মোশতাক আহমদের বহু ছাত্রছাত্রী দেশ-বিদেশের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে আছেন। অনেকেই দেশে-বিদেশে পেশাগত জীবনে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন। প্রফেসর মোশতাক আহমদের ছাত্রদের মধ্যে পেশাগত জীবনে উচ্চাসনে আসীন হয়েছে এমন যাঁদের কথা তাঁর মনে আছে তাঁরা হলেন- চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারজন ভাইস চেন্সলর- যথাক্রমে আবদুল মান্নান, ড. বদিউল আলম, আনোয়রুল আজিম এবং এ জে নূরন্নবী প্রভৃতি। তাঁর ছাত্রদের মধ্যে আরো যাঁরা কৃতিত্ব অর্জন করেছেন তাঁরা হলেন- প্রাক্তন সচিব আলী ইমাম মজুমদার, কক্সবাজর কলেজের সাবেক প্রধান শিক্ষক সালাউদ্দিন, অধ্যক্ষ হাবিবুল্লাহ, লে. জে. হারুন, সাবেক ডিসি পুলিন বিহারী দেব এবং মেজর লতিফুর রহমান প্রমুখ।

রামুতে সংগ্রাম কমিটি গঠন: ২৫শে মার্চের পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর নৃশংস অক্রমন ও নাশকতা শুরু হলে সকল প্রগতিশীল বাঙালি এক অনিশ্চিত ভবিষ্যত ও আতংকের মধ্যে নিমজ্জিত হন। পাকিস্তানী হানাদারদের আক্রমনের টার্গেট মুক্তিযুদ্ধের সকল সংগঠক ও সহায়ক ব্যক্তি আর সকল নিরীহ হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন। মোশতাক আহমদও রামুতে তখন এক অনিশ্চিত অতংকে সময় কাটান। মে মাসের প্রথম সপ্তাহে পাকিস্তানী বাহিনী স্থানীয় রাজাকারদের ইন্ধনে মোশতাক আহমদের রামু সদরের হাইটুপি এলাকার বাড়িটি পুড়িয়ে দেয়। উল্লেখ্য যে, মোশতাক আহমদ সিলেট সরকারী কলেজে চাকুরী করার সময়ে তার শ্বশুরের আগ্রহে ও পৃষ্ঠপোষকতায় ১৯৬৮ সালে ৬২ শতক জমির ভিটাসহ রামুর রাখাইন জমিদার ফাতে চৌধুরীর মালিকানাধীন উক্ত বাড়িটি মোশতাক আহমদ ক্রয় করেন। তখনও মোশতাক আহমদের পিতা রশিদ আহমদ জীবিত এবং পরিবারের অন্যান্যদের সাথে তিনি মন্ডলপাড়ার পৈতৃক বাড়িতে বসবাস করছেন। মোশতাক আহমদের পিতা রশিদ আহমদ মারা যান ৫ই এপ্রিল ১৯৭৫ সাল।

১৯৬৮ সাল থেকেই সস্ত্রীক মোশতাক আহমদ হাইটুপির ক্রয় করা বাড়িতে বসবাস শুরু করেন। ২৫ শে মার্চের পর সারা দেশে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর তান্ডব শুরু হলে এপ্রিলের শেষের দিকে মোশতাক আহমদ স্ত্রী সন্তানাদিকে নিজের বাড়ি থেকে সরিয়ে তোতুকখালী গ্রামের স্ত্রীর মাতুলালয়ে রেখে আসেন।

প্রশ্ন উঠতে পারে, মোশতাক আহমদ সক্রিয় আওয়ামী লীগ নেতা বা অন্য কোনো দলের বড় কোনো নেতা না হওয়া সত্ত্বেও হানাদার বাহিনী ও রাজাকারদের তিনি কোপানলে পড়লেন কেন? তাঁর বাড়ি কেন পুড়িয়ে দিল? ছাত্র জীবনে বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি ছাত্র ইউনিয়নের সমর্থক ছিলেন। পেশাগত জীবনে এসে মোশতাক আহমদ রাজনীতির সাথে বড় একটা সংশ্রব রাখেন নি। ৭ই মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পরপর সারা বাংলাদেশে আওয়ামীলীগ ও মুক্তিযুদ্ধে অন্যান্য সহযোগী দলগুলো বা ব্যক্তিদের সমন্বয়ে থানায় থানায় সংগ্রাম কমিটি গঠন শুরু হয়ে যায়। ৭ই মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণে সেই সংগ্রাম কমিটি গঠনের নির্দেশ ছিল। রামুতেও ৭ই মার্চের পর একটি সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। সেই সংগ্রাম কমিটির সদস্য ছিলেন অধ্যক্ষ ওসমান সরোয়ার আলম চৌধুরী এমপি, প্রফেসর মোশতাক আহমদ, রামু খিজারী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হারবাং নিবাসী আখতার আহমদ এবং রামু খিজারী উচ্চ বিদালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক জ্ঞানেন্দ্র বডুয়া প্রমুখ। এঁদের নেতৃত্বেই রামুতে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে প্রচারণা ও সংগঠিত করার কাজ চালানো হয়। মোশতাক আহমদ জানান, রাজনৈতিক বিবেচনায় রামুতে শুধু ওসমান সরোয়ার আলম চৌধুরীর বাড়ি এবং মোশতাক আহমদের বাড়ি হানাদার বাহিনী ও রাজাকারেরা পুড়িয়ে দেয়।

উল্লেখ্য যে, পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকারেরা পূর্ব পাকিস্তানের সকল হিন্দুর বাড়ি গ্রামের-পর-গ্রাম পুড়িয়ে ছাই করে দিলেও রাখাইন ও বাঙালি বড়ুয়াদের বাড়ি তারা পোড়ায় নি। কারন তখন চীন পাকিস্তানের পক্ষের একটি মিত্র রাষ্ট্র ছিল। চীন যদিও কোনো ধর্ম পরিচয়ের রাষ্ট্র ছিল না, তাদের পরিচয় ছিল কমিউনিস্ট রাষ্ট্র তথাপি ঐতিহ্যগত বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী হিসেবে চীনের প্রভাবে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের লোকেরা পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী কর্তৃক আক্রান্ত হয় নি।

বার্মায় শরণার্থী জীবন: আগেই উল্লেখ করা হয়েছে পাকিস্তানী বাহিনী স্থানীয় রাজাকারদের ইন্ধনে মোশতাক আহমদের রামু সদরের হাইটুপি এলাকার বাড়িটি পুড়িয়ে দেয়। মে মাসের প্রথম সপ্তাহে হানাদার বাহিনীর আক্রমনের সন্দেহে ও আতংকে মোশতাক আহমদ বার্মায় পাড়ি জমাবার জন্য রামু ছেড়ে যান। বার্মা যাবার পথে তিনি যখন সোনাইছড়ি পর্যন্ত পৌছান তখন হানাদার বাহিনী ও রাজাকারেরা তার বাড়িতে আগুন লাগায়। মোশতাক আহমদ বলেন, ‘ আমি সোনাইছড়ি থেকেই বাড়ির আগুনের লেলিহান শিখা দেখতে পাই’।

বার্মার শরণার্থী জীবনের প্রথম দিক মোশতাক আহমদকে নানা স্থানে বসবাস করতে হয়। মোশতাক আহমদ বলেন, বার্মায় পাড়ি দিয়ে মে মাসের প্রথম সপ্তাহে তিনি প্রথমে পৌঁছান ফকিরা বাজার এলাকায়। সেখান থেকে চলে যান সাহেব বাজার। সাহেব বাজারে ৩ মাস অবস্থানের পর চলে যান বলী বাজার নামক স্থানে। সেখানে ৩ সপ্তাহ থাকার পর ঢেকিবনিয়া নামক স্থানে চলে যান। ঢেকিবনিয়ায় নিজেদের উদ্যোগে ঘর নির্মান করে বসবাস শুরু করেন শরণার্থীরা। দেশে ফিরে আসার আগ পর্যন্ত মোশতাক আহমদ ও তাঁর সঙ্গীরা ঢেকিবনিয়ায় বসবাস করেন। বার্মায় শরণার্থী হয়ে বাস করার সময় লোক মারফত দেশের বাড়িঘরের খবর পেতেন মোশতাক আহমদ। বিশেষ করে তাঁর শ্বশুর ওয়াছিউর রহমান কন্ট্রাক্টর জামাই-র জন্য চাল-ডাল মুরগী পাঠাতেন এবং খোঁজ-খবর রাখতেন। মোশতাক আহমদ শ্বশুর ওয়াছিউর রহমানের খুবই প্রিয়ভাজন জামাতা ছিলেন।

বার্মার শরণার্থী জীবনে যাঁরা মোশতাক আহমদের সঙ্গী ছিলেন এবং যাদের কথা তাঁর মনে আছে মনে আছে তাঁরা হলেন-এডভোকেট নূর আহমদ, ওসমান সরোয়ার আলম চৌধুরী, ক্যাপটেন হারুন (যিনি কালুর ঘাটে পাকিস্থানী হানাদার বাহিনীর সাথে সম্মুখযুদ্ধে আহত হন এবং পরে দুলাহাজরা মালুমঘাট খ্রিস্টান হাসপাতালে চিকিৎসা নেন), জেলা আওয়ামী লীগ নেতা আফসার কামাল চৌধুরী, আওয়ামী লীগের তরুণ নেতা মোজাম্মেল হক, খুরুশকুলের আওয়ামী লীগ নেতা মনিরুল হক চৌধুরী এবং খুরুশকুলের তৎকালীন চেয়ারম্যান হৃদয় বাবু প্রমুখ।

বার্মায় যে সকল এলাকায় মোশতাক আহমদ ও সঙ্গীরা ছিলেন তা ছিল বাঙালি বংশদ্ভোত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠি অধ্যুষিত অনগ্রসর এলাকা। স্থানীয়রা বাঙালি শরণার্থীদের প্রতি তেমন সদয় ছিলেন না। অধিকাংশ রোহিঙ্গা মুসলিম জনগণ পাকিস্তানের সমর্থক ছিলেন।
শরণার্থী জীবনের অবসান এবং দেশে ফেরা: ১৬ই ডিসেম্বরের পাকস্তানী সৈন্যদের আত্মসমর্পনের পূর্বেই কক্সবাজার এলাকা মুক্তিযোদ্ধাদের অনুকূলে চলে আসে। ডিসেম্বরের ৪ তারিখের দিকে বার্মা থেকে মোশতাক আহমদ ও তাঁর অন্যান্য সঙ্গীরা এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সশস্ত্র মুক্তি যোদ্ধারা উখিয়ার পালং উচ্চ বিদ্যালয়ে এসে ঘাঁটি গাড়েন এবং ওখানে অবস্থান নেন। পালং উচ্চ বিদ্যালয় থেকে সশস্ত্র যোদ্ধদের নেতা ক্যাপটেন সোবহানের (বাড়ি মরিচ্যা) নেতৃত্বে ১২ ডিসেম্বর একটি দল কক্সবাজার পাবলিক ইন্স্টিটিউট ও লাইব্রেরি ময়দানে (বর্তমানে দৌলত ময়দান) এসে মানচিত্র অংকিত বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। সেই দলে মোশতাক আহমদও ছিলেন বলেন তিনি জানান। রামু ফিরে মোশতাক আহমদ পৈতৃক বাড়িতে উঠেন। ১৯৭৩ সালের দিকে হাইটুপির পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী কর্তৃক পুড়িয়ে দেয়া বাড়িটি পুন:নির্মান করেন।

১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানী সশস্ত্র বাহিনীর পতন ও পরাজয়ের পর বাঙালির স্বাধীনতা যুদ্ধের অবসানে বার্মার শরণার্থী জীবন থেকে ফিরে এসে মোশতাক আহমদ আর কলেজের শিক্ষকতার চাকুরীতে ফিরে যান নি। নতুন স্বাধীন দেশে ফিরে এসে মুক্তিযোদ্ধা ও আর সকল মানুষের মধ্যে এক নতুন আশা ও নতুন উন্মদনার জন্ম নেয়। পাকিস্তানী অবাঙালি শাসকশ্রেণীর হাতে নিপীড়ন ও অপমান সইতে-সইতে আশাহত জীবনের অবসানে এক নতুন স্বপ্ন দেখতে শুরু করলো বাঙালিরা। সেই স্বপ্নের ঘোরে অনেকের মতো মোশতাক আহমদও তাঁর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিলেন। পা রাখলেন রাজনীতির নতুন ময়দানে এবং যোগ দিলেন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিতে (ন্যাপ-অধ্যাপক মোজাফ্ফর)। তখন কক্সবাজার জেলায় নতুন স্বাধীন বাংলাদেশের ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সাংগঠনিক শক্তি-সামর্থ্য খুব কম বলা যাবে না। রাজনৈতিক সচেতন মধ্যবিত্ত শিক্ষিত তরুণ সমাজের অনেকেই ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির নেতা ও সমর্থক। তারা সামাজিক সাম্য ও সামাজিক ন্যায় বিচারের প্রত্যাশী এবং তা তারা রাষ্ট্রের সংবিধানে এবং সমাজে প্রতিষ্ঠা দেখতে চায়।

প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ: নতুন বাংলাদেশে ১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রামু-উখিয়া-টেকনাফ কনস্টিটিউন্সিতে মোশতাক আহমদ সিদ্ধান্ত নিলেন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) থেকেই পার্লামেন্ট নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ওসমান সরোয়ার আলম চৌধুরীর প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দাঁড়াবেন। আরো একজন প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন ভাসানী ন্যাপের তরুণ প্রার্থী অধ্যাপক মফিদুল আলম। মোশতাক আহমদ নির্বাচনে জয়ী হতে পারলেন না, জয়ী হলেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী ওসমান সরোয়ার আলম চৌধুরী। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ন্যাপ ও কমিউনিস্ট পার্টির নেতা কর্মীরা মোশতাক আহমদের পক্ষে কর্মী হিসেবে কাজ করেন। তাঁদের মধ্যে যাঁদের নাম তিনি মনে করতে পরেছেন তাঁরা হলেন- মোহাম্মদ ইদ্রিস (হোটেল কল্লোলের মালিক), কক্সবাজার রুবা আর্ট প্রেসের মালিক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী (মগনাম বাড়ি), নূর বখ্স (মহেশখালীর সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান), দিলীপ দাশ (কমিউনিস্ট পার্টির জেলা সভাপতি, মহেশখালী বাড়ি) ছাত্র ইউনিয়ন নেতা রাখাল, সুভাষ প্রভৃতি এবং আরো অনেকে। তখন মোশতাক আহমদ ন্যাপের কক্সবাজার জেলা কমিটির সহ-সভাপতি ছিলেন।

আবার শিক্ষকতায় ফিরে আসা এবং মস্কো গমন: ১৯৭৩-এর পার্লামেন্ট নির্বাচনের পর কিছুদিন চুপচাপ কাটিয়ে ১৯৭৪ সালের মার্চ মাসে পটিয়ার হুলাইন ছালেহ-নূর কলেজে অধ্যক্ষ্ হিসেবে যোগদান করেন প্রফেসর মোশতাক আহমদ। হুলাইন ছালেহ-নূর কলেজে তিনি মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ছিলেন। ন্যাশনাল আ্ওয়ামী পার্টির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব উদ্যোগ গ্রহণ করে সারা দেশের কিছু বাছাই করা নেতাদেরকে সোভিয়েত ইউনিয়নে রাজনৈতিক বিষয়ে প্রশিক্ষণে ও পড়াশোনার জন্য পাঠাবে। ছালেহ-নূর কলেজে অধ্যক্ষ থাকা অবস্থায় মোশতাক আহমদকে সেই প্রশিক্ষণ টিমে অংশগ্রহণ করার জন্য মনোনীত করা হয়। মোশতাক আহমদ তাতে সাড়া দিয়ে রাজনৈতিক প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য কলেজ থেকে মস্কো চলে গেলেন। প্রশিক্ষণের মেয়াদ ছিল ৬ই জানুয়ারি থেকে ২৫শে জুলাই ১৯৭৫ সাল এবং প্রশিক্ষণের বিষয় ছিল মার্কসবাদ-লেনিনবাদ ও সমাজের রাজনৈতিক-অর্থনীতি। মোশতাক আহমদ বলেন, যাঁরা প্রশিক্ষণার্থীর দলে ছিলেন তাঁরা সারা বাংলাদেশের ২৫জন রাজনৈতিক ব্যক্তি । দলনেতা ছিলেন গৌর গোপাল সাহা, টাঙাইলের ন্যাপ নেতা। তখন বৃহত্তর চট্রগ্রাম থেকে তিনজনকে মনোনীত করা হয়। তাঁরা হলেন- প্রফেসর মোশতাক আহমদ, বখতেয়ার নূর সিদ্দিকী (বাঁশখালী) ও আবদুল হামিদ (গাছবাড়িয়া, চন্দনাইশ)।

মস্কোর ইন্টারন্যাশনাল লেনিন ইনস্টিটিউটে ৬মাসের রাজনৈতিক প্রশিক্ষণ শেষে ১৯৭৫ সালের জুলাই মাসে মোশতাক আহমদ বাংলাদেশে ফিরে আসেন। প্রশিক্ষণ গ্রহণকারী মস্কো ফেরত দল ঢাকায় ফিরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে সাক্ষাত করেন এবং বঙ্গবন্ধু তাদেরকে ভবিষ্যতের রাজনৈতিক নির্দেশনা প্রদান করেন। দুঃখের বিষয় এর কিছুদিন না যেতেই ১৫ই আগস্ট দেশের বিরুদ্ধে চক্রান্তকারীদের হাতে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হন।

১৫ আগস্টের বিয়োগাত্মক ঘটনার পর প্রফেসর মোশতাক আহমদ রাজনীতির মাঠ থেকে সরে গিয়ে কিছুদিন আত্মগোপনে থাকেন। রামুর উখিয়ার ঘোনা নামক স্থানের জয়নালের বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে কিছুদিন কাটান বলে মোশতাক আহমদ জানান। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর মেজর জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে দেশে সামরিক শাসন জারী থাকে।

সামরিক শাসনের কাল ও জীবনের নতুন দিগন্ত: দেশে সামরিক শাসনের উদ্ভবের ফলে ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজের মধ্যে একটা টানাপোড়েন সৃষ্টি হয় এবং সমাজে এক নতুন প্রতিকুল পরিস্থিতর উদ্ভব হয়। এর ফলে মোশতাক আহমদের শিক্ষকতার ও রাজনৈতিক জীবনেরও পট-পরিবর্তন ঘটে। তিনি রামুতে বসবাস করতে লাগলেন এবং শুরু করলেন ট্রান্সপোর্ট ব্যবসা। পত্তন করলেন রামু -কক্সবাজার বাস সার্ভিস। তিনিও মালিক হলেন ৩/৪টি বাসের। দেশে সামরিক শাসন কি করে একজন শিক্ষক ও রাজনৈতিক সৃষ্টিশীল ব্যক্তিকে বাস মালিকে এবং বাস ব্যবসার তদারকীতে অবনমিত করতে পারে মোশতাক আহমদ তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। সামরিক শাসন একই সাথে সারা দেশে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতির অধ:পতন ঘটায়।

রামু কলেজের প্রতিষ্ঠা: বাংলাদেশে জেনারেল এরশাদের শাসনামলে থানাকে উপজেলায় রূপান্তরিত করার পর প্রায় প্রতি উপজেলায় কলেজ প্রতিষ্ঠার হিড়িক পড়ে যায়। সেই সময় কক্সবাজার জেলার প্রায় সকল উপজেলায় কলেজ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ শুরু হলে রামু উপজেলাতেও রামু কলেজ প্রতিষ্ঠায় মোশতাক আহমদ ও স্থানীয় নেতৃত্ব উদ্যাগী হন। কলেজ প্রতিষ্ঠায় মোশতাক আহমদের সাথে আর যাঁরা সারথি হন মোশতাক আহমদের বয়ানে তাঁরা হলেন- ওসমান সরোয়ার আলম চৌধুরী, সৈয়দ আলম চৌধুরী, ফজল কবির কোম্পানী, শ্রীনাথ ধর, রমিজ আহমদ, ইঞ্জিনিয়ার মনোয়ার আহমদ, মোজাফ্ফর আহমদ কোম্পানী, তৎকালীন উপজেলা চেয়ারম্যান আবুল মনসুর আহমদ, তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী অফিসার আবদুল হাকিম মন্ডল প্রমুখ।

রামু কলেজের প্রতিষ্ঠা লগ্ন (১৯৮৯) থেকেই মোশতাক আহমদ কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং কলেজকে সুসংহত করে গড়ে তুলেন। তিনি এটানা ১৬ বছর অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করার পর ২০০৫ সালে অবসর গ্রহণ করেন।
লেখালেখি: রামু কলেজে অধ্যক্ষের পদে আসীন হবার পর তাঁর জীবনে আবার সৃষ্টিশীল সুস্থিরতা ফিরে আসে এবং তিনি পুনরায় পড়াশোনায় মনোনিবেশ করেন। ১৯৯০ সালে কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের সার্বিক ব্যবস্থাপনায় কক্সবাজার ফাউন্ডেশন কর্তৃক ‘ কক্সবাজারের ইতিহাস’ গ্রন্থটি প্রকাশিত হলে প্রফেসর মোশতাক আহমদের উপর ভার পড়ে তার পুনর্লিখন ও অনুবাদ করে ইংরেজি ভার্সন তৈরি করার। জেলা প্রশাসক এনামুল কবিরের আমলে তিনি কক্সবাজারের ইতিহাস গ্রন্থটির পুনর্লিখন ও ইংরেজি অনুবাদ করেন Glimpses of Cox’s Bazar নামে। কক্সবাজারের ডিসি এনামূল কবিরের অনুরোধে মোশতাক আহমদ এ কাজের দায়িত্ব নেন বলে তিনি জানান।

রামু কলেজের দৈনন্দিন কাজের অবসরে তিনি আধুনিক বাংলা কবিতার প্রভাবশালী কবি জীবনানন্দ পাঠে মনোনিবেশ করেন। তিনি জীবনানন্দ দাশের নির্বাচিত কবিতার ইংরেজি অনুবাদ করেন Gleanings of Jibanananda Das নামে এবং কক্সবাজারের সাহিত্য একাডেমী গ্রন্থটি প্রকাশ করে। বইটি সারাদেশে বিদগ্ধ জীবনানন্দ পাঠকদের কাছে সমাদৃত হয়।

বরিশালে নিবাসী আবু ফারুক খান পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্মকর্তা হয়ে আসেন কক্সবাজারে এবং তিনি কাব্য চর্চা করতেন। প্রফেসর মোশতাক আহমদের সাথে এই কর্মকর্তার হৃদ্যতা গড়ে উঠে। এক সময় আবু ফারুক খানের কবিতার বই ‘আত্মক্ষরণ’ অনুবাদ করেন ‘I Bleed’ নামে। এরপরে অনুবাদ করেন কক্সবাজারে জন্ম গ্রহণ করা কবি শাহেদ সাদ উল্লাহ-র কবিতা গ্রন্থ ‘ যেতে যেতে পাতাল সড়ক’ ইংরেজি ‘Voyage to Destiny’ নামে।

কলেজ থেকে অবসর গ্রহণের পর বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনের পৃষ্ঠপোষকতায় এবং কক্সবাজার বেতারে নানা বিষয়ে কথিকা লেখা ও তা পাঠ করে সময় কাটিয়েছেন। মৃত্যুর আগের বছরখানেক প্রফেসর মোশতাক আহমদ ঘরের বাইরে তেমন যাওয়া-আসা করতে পারেন নি। রামুর হাইটুপি পাড়ার ৭১ সালে পুড়ে যাওয়া এবং পরবর্তীতে পুননির্মিত গাছ-গাছালির ছায়া আবৃত সেই বাড়িতে দিনরাত্রির পুরো সময় কাটান। শারীরিক সচলতা শিথিল হলেও মানসিক শক্তি ও সক্রিয়তা তাঁর কখনও নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে নি। গত নভেম্বরে তাঁর সাথে আমি তিনবার সাক্ষাত করি এবং তাঁর জীবনের নানা বিষয়ে কথা বলি। মৃত্যুর আগের কয়েক মাস তিনি বাংলা শব্দ নিয়ে চর্চা করতেন এবং আমাকে প্রায় প্রতিদিন সকাল বেলায় দুই-একটা ফোন করে জানতে চাইতেন বিশেষ কোনো শব্দের বিকল্প শব্দ। তিনি শব্দ নিয়ে কিসের একটা খেলা খেলতেন। মৃত্যুর তিন দিন আগেও তিনি আমাকে ফোন করেন সতেজ কন্ঠে।
আগামী ৮ই জানুয়ারি আমরা তাঁর জন্মের ৮০ বছর পূর্তি পালন করতে পারবো বলে আশা পোষণ করেছিলাম। কক্সবাজার সাহিত্য একাডেমীর উদ্যোগে এ অনুষ্ঠান করার জন্য আমি গত সপ্তাহ-দেড়েক পূর্বে কক্সবাজার সাহিত্য একাডেমীর সভাপতি বন্ধুবর মুহম্মদ নূরুল ইসলামকে প্রস্তাব দিয়েও রেখেছিলাম। তিনিও সম্মত হন। তার আগেই ১লা ডিসেম্বরের মধ্য রাতে তিনি চির বিদায় নিলেন। নানা বাঁক নেওয়া দীর্ঘ জীবনের নানা বর্ণের যাপিত জীবনের অভিজ্ঞতার আলোকে জীবনের সারকথা বলার জন্য প্রফেসর মোশতাক আহমদকে তাঁর হাইটুপীর বাসভবনে গত নভেম্বর মাসের কোনো এক সন্ধ্যায় আমি অনুরোধ করেছিলেম। তার উত্তরে চার্লস ডারউইনের সিদ্ধান্তই মোশতাক আহমদ পুনর্ব্যক্ত করে বলেন “Survival of the fittest” যোগ্যতমরাই টিকে থাকে।

• প্রফেসর মোশতাক আহমদের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে এ লেখা রচিত। তারিখ: ৩ ডিসেম্বর ২০২০ খ্রি.