মোহাম্মদ মঞ্জুরুল ইসলাম


শিক্ষা, সংস্কৃতি, যোগাযোগ ব্যবস্থায় অনুন্নত এক জনপদের নাম পদুয়া। রাঙ্গুনিয়া উপজেলার পনেরটি ইউনিয়নের মধ্যে পদুয়া ইউনিয়ন দশম। অবহেলিত এ জনপদের নাগরিক সমাজ ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন নিয়ে ছাত্রাবস্থা থেকেই যিনি সর্বদা ভাবতেন তিনি হলেন আলহাজ্ব জেয়াব উদ্দিন ও আলহাজ্ব আমির খাতুন এর একমাত্র সুযোগ্য সন্তান আলহাজ্ব মুহাম্মদ নূরুচ্ছফা। অধম্য মেধা ও তীক্ষè সমাজ ভাবনায় শিক্ষা, সংস্কৃতি ও রাজনীতি সচেতন সজ্জন ব্যক্তিতে পরিণত হন তিনি। তাঁর লালিত স্বপ্ন বাস্তবায়নে শিক্ষকতা পেশায় যোগ দেন। প্রতিষ্ঠা করেন বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। জমি ও অর্থ সহায়তা দিয়েছেন অসংখ্য স্কুল, কলেজ ও মাদরাসা প্রতিষ্ঠায়। আজ (২৪ ডিসেম্বর ২০২০) এ গুণী ব্যক্তির ১০ম মৃত্যুবার্ষিকী।
মুহাম্মদ নূরুচ্ছফা ছাত্রাবস্থা থেকে তিনি এলাকার মানুষের অভাব-অনটন, দুঃখ-কষ্ট ও শিক্ষা অর্জন ইত্যাদি বিষয়ে খুবই ভাবতেন। গ্রামে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে এলাকায় মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান না থাকায় মায়ের স্নেহমায়া ত্যাগ করে অশ্রুসজল নয়নে পড়ালেখা করতে চলে যান বোয়ালখালী উপজেলার শাকপুরা হাই স্কুলে। এই স্কুলে তখন পড়ালেখা করতেন বাল্যকালের সাথী বাবু চন্দ্র শেখর দাশ। বিকেল বেলায় তাঁরা দু’জনে গল্প করতেন আর অশ্রুসজল নয়নে ভাবতেন গ্রামের কথা। শাকপুরা হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক তাঁকে খুব ¯েœহ করতেন। ফলে তিনি শাকপুরা হাই স্কুল থেকে বদলি হয়ে রাঙ্গুনিয়া হাই স্কুলে যোগদান করলে সাথে করে তাঁকেও নিয়ে আসেন। ১৯৫১ সালে শিলক বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে কৃতিত্বের সাথে মেট্রিকুলেশন পাশ করেন। এ সময় পদুয়া ইউনিয়নের মানুষের এগিয়ে যাওয়ার পথ খুব কঠিন হলেও তাঁর লক্ষ্য ও পথচলা ছিল অগ্রবর্তী। ভর্তি হন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের অন্যতম ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম কলেজে। চট্টগ্রাম কলেজে অধ্যয়নকালীন তাঁর সহপাঠী (রুমমেট) ছিলেন রাঙ্গুনিয়ার আর এক কৃতিপুরুষ বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. মাহমুদ শাহ ্ কোরেশী, পটিয়ার কৃতিপুরুষ প্রাক্তন মন্ত্রী নুরুল ইসলাম এমপি।
তিনি ছিলেন একজন ভাষা সৈনিক। ১৯৫২ সালের মহান ভাষা আন্দোলনে দেশ যখন উত্তাল, তখন তিনি চট্টগ্রাম কলেজে নেতৃত্ব দানকারীদের অনুপ্রাণিত করে চট্টগ্রামে ভাষা আন্দোলনকে বেগবান করেন।
ইতোমধ্যে পিতার ইন্তেকাল হলে তাঁর পড়ালেখায় ছেদ পরে। তিনি নিজ গ্রামে এসে শিক্ষা বিস্তার ও সমাজসেবায় আত্মনিয়োগ করেন। বিনাবেতনে শিক্ষকতা শুরু করেন পদুয়া এম ই স্কুলে। তিনি এ স্কুলের ছাত্রও ছিলেন। এরপর বিনাবেতনে শিক্ষকতা করেন সারাশিয়া স্কুল ও মদিনাতুল উলুম দাখিল মাদ্রাসায়। এছাড়াও এলাকার ছাত্রদের বিনাবেতনে নিজ বাড়িতে পড়ালেখা করাতেন। আজ তাঁর অনেক ছাত্র স্ব-স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। তাঁর মেট্রিকুলেশন নির্বাচনী পরীক্ষায় নিজের ‘জীবনের লক্ষ্য’ রচনায় লিখেছিলেন, “আমি পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল হতে চাই না, গ্রামে একটি হাই স্কুল প্রতিষ্ঠা আমার জীবনের অন্যতম লক্ষ্য।”
১৯৬০ সালে তিনি ১০নং পদুয়া ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। জীবনের অন্যতম লক্ষ্য ও স্বপ্ন পূরণের সুবর্ণ সুযোগ হাতে ধরা দিল। হাইস্কুল প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হয়। ১৯৬১ সালে পদুয়া জুনিয়র হাইস্কুলকে হাই স্কুলে উন্নীতকরণে যে পরিমাণ জমি প্রয়োজন (২ একর বা ৫ কানি) ছিল, তা তিনি দান করে হাই স্কুল প্রতিষ্ঠায় অসাধারণ অবদান রাখেন। চেয়ারম্যান থাকাবস্থায় এলাকাবাসীদের সাথে নিয়ে বিদ্যালয়ের স্বীকৃতি লাভের জন্য তিনি মেধা, ক্ষমতা ও অর্থ ব্যয় করেন। ফলশ্রুতিতে ১৯৬৫ সালে উত্তর পদুয়া স্কুল পূর্ণাঙ্গ হাইস্কুলের মর্যাদা লাভ করে। অনেকে তাঁকে নিজ নামে বিদ্যালয়ের নামকরণের প্রস্তাব করলেও তিনি বিনয়ের সাথে প্রত্যাখ্যান করে নির্লোভ ও উঁচুমনের পরিচয় দেন। এসময় তিনি নারিশ্চা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় ও খুরুশিয়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। দক্ষিণ রাঙ্গুনিয়ায় ইসলামী শিক্ষার মাধ্যমিক বা উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল না। ১৯৬৮ সালে হজ্ব পালন করে দেশে এসে পদুয়ায় ইসলামী শিক্ষার কথা ভাবেন। এক পর্যায়ে রাঙ্গুনিয়া নুরুল উলূম ফাযিল মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা তাঁর পীর হযরত আলহাজ্ব নূরুচ্ছফা নঈমী (রাহ্.)-এর শরণাপন্ন হন। পীরের দোয়া ও পরামর্শে ধর্মপ্রাণ এলাকাবাসীর সহযোগিতা নিয়ে ১৯৭০ সালে উত্তর পদুয়া মদিনাতুল উলূম দাখিল মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন।
১৯৬৩ সালে রাঙ্গুনিয়ার বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ রাঙ্গুনিয়ায় একটি কলেজ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করে তৎকালীন ১০টি ইউনিয়নের চেয়ারম্যানদের নিজ নিজ ইউনিয়ন থেকে অর্থ এবং ছাত্র দিয়ে সহযোগিতা করার আহবান জানানো হলে তিনি বিশিষ্ট ব্যক্তিদের এ উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে নিজে এবং অন্যদের কাছ থেকে অর্থ ও যথেষ্ট সংখ্যক ছাত্র দিয়ে রাঙ্গুনিয়া কলেজ প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। দক্ষিণ রাঙ্গুনিয়া পদুয়া ডিগ্রী কলেজ যখন চরম অর্থনৈতিক ও ছাত্র-ছাত্রী সংকটে পতিত হয়, তখন তিনি কলেজের সংকট নিরসনে নিয়ম অনুযায়ী অর্থ দান করে এ কলেজে আজীবন দাতা সদস্য হন এবং অনেককে দাতা সদস্য হতে উৎসাহিত করেন। এ কলেজের ছাত্র-ছাত্রী সংকট নিরসনে তিনি এলাকার প্রতিটি মানুষকে ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি করাতে অনুরোধ করেন। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক এ কলেজের পরীক্ষাকেন্দ্র বাতিল করা হলে, তিনি ঢাকায় গিয়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা আলহাজ্ব সালাহ্উদ্দিন কাদের চৌধুরীকে বিষয়টি অবহিত করেন এবং কলেজে পরীক্ষাকেন্দ্র পুনস্থাপনের ব্যবস্থা করেন।
চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়ে তিনি রাঙ্গুনিয়াব্যাপী ব্যাপক পরিচিতি লাভ করায় পূর্বেকার পরিচিতি মাস্টার নূরুচ্ছফা অনেকটা হারিয়ে যান। উত্তর রাঙ্গুনিয়ার রাজানগর ইউনিয়নের কৃতি সন্তান অনারারী ম্যাজিস্ট্রেট আবুল কাশেম ১৯৭৮ সালে বিএনপি’র এক সভায় যোগদান উপলক্ষে তাঁর বাড়িতে আতিথেয়তা গ্রহণ করেন। একপর্যায়ে তিনি সকলের কাছে জানতে চান, “এ এলাকায় তিনজন নূরুচ্ছফার কথা জানি। একজন আলহাজ্ব মুহাম্মদ নূরুচ্ছফা (প্রাক্তন চেয়ারম্যান), আরেকজন বর্তমান চেয়ারম্যান নূরুচ্ছফা তালুকদার এবং অন্যজন এডভোকেট নূরুচ্ছফা তালুকদার। আমি ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের সময় মাস্টার নূরুচ্ছফা কে আমার সাথে পেয়েছিলাম। ছেলেটি খুবই উদ্দমী, মেধাবী ও সাহসী ছিল। জানি না এখন কোথায়? তবে বাড়িটা এখানে কাছাকাছি কোথাও হবে। তিনি মাস্টার নূরুচ্ছফা সম্পর্কে উপস্থিত সকলের কাছে জানতে চান। এসময় সেখানে সমবেতদের সাথে উপস্থিত ছিলেন মাস্টার হিসেবে পরিচিত মুহাম্মদ নূরুচ্ছফা চেয়ারম্যান। পরিচয় পাওয়ার সাথে সাথে অনারারী ম্যাজিস্ট্রেট আবুল কাশেম তাঁকে বুকে ঝড়িয়ে ধরেন এবং বলেন আমি অনেকদিন থেকে আপনাকে মনে মনে খোঁজ করছিলাম। আপনি চেয়ারম্যান নূরুচ্ছফা হওয়াতে মাস্টার নূরুচ্ছফাকে খুঁজে পাচ্ছিলাম না।”
চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়ে পদুয়া ইউনিয়ন পরিষদ ভবন নির্মাণ করার মধ্য দিয়ে তাঁর মহানুভবতা, সাংগঠনিক দক্ষতা ও রুচিবোধের পরিচয় ফুঠে উঠে। ইউনিয়নের বিচার ও প্রশাসনিক কার্যক্রম তিনি এ কার্যালয়ে সম্পন্ন করতেন। আজো এ পরিষদ ভবন কালের সাক্ষী হয়ে তাঁর স্মৃতি বহন করছে।
১৯৭৮ সালে রাঙ্গুনিয়া থানায় জাগদল এবং পরবর্তীতে বিএনপি প্রতিষ্ঠায় যে ক’জন নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাদের মধ্যে আলহাজ্ব মুহাম্মদ নূরুচ্ছফা অন্যতম। তিনি রাঙ্গুনিয়া থানা বিএনপির প্রথম কমিটির সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। এ কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছিলেন অনারারী ম্যাজিস্ট্রেট আবুল কাশেম।
জনহিতকর কর্মে অবদানের স্বীকৃতিতে ২০০৯ সালের ১০ ডিসেম্বর বিশ্ব মানবাধিকার দিবসে বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা রাঙ্গুনিয়া উপজেলা শাখা তাঁকে ‘মানবাধিকার পুরস্কার’ (সম্মাননা ও সনদ) প্রদান করে। ১৯৩১ সালের ২ জানুয়ারি রাঙ্গুনিয়া উপজেলার পদুয়া গ্রামের ধর্মপরায়ন সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন আলহাজ্ব মুহাম্মদ নুরুচ্ছফা। ১৯৫২ সালের অক্টোবরে (২১ আশ্বিন ১৩৫৯ বঙ্গাব্দ, মঙ্গলবার) তাঁর পিতা আলহাজ্ব জেয়াব উদ্দিন পবিত্র হজ্ব পালনকালে মদিনা শরীফে ইন্তেকাল করেন এবং পবিত্র জান্নাতুলবাক্বীতে শায়িত আছেন। ১৯৬৮ সালের ২৬ জানুয়ারি মাতা আলহাজ্ব আমির খাতুন পবিত্র হজ্ব পালনকালে মক্কা শরীফে ইন্তেকাল করেন এবং পবিত্র জান্নাতুল মাওয়াতে শায়িত আছেন। ২০১০ সালের ২৪ ডিসেম্বর বার্ধক্যজনিত রোগে তিনি ইন্তেকাল করেন।

লেখক: কলামিস্ট