সৌরভ শর্মা
ভালোবেসে পালিয়ে বিয়ে করেছি স্নিগ্ধাকে। দুজনের কারো অবশ্য এতে মত ছিলোনা। বাবা-মাকে বলেছিলাম স্নিগ্ধার কথা।তারা স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন, ঢাকা শহরে নিজস্ব ফ্ল্যাট নেই এমন পরিবারের মেয়েকে তারা কখনো ঘরে তুলবেননা।
স্নিগ্ধাও তার বাবাকে বলেছিলো আমার কথা। তিনি এক নিশ্বাসে বলে দিলেন,সরকারি চাকুরীজীবির হাতেই তিনি মেয়েকে তুলে দিবেন। কোনো ব্যবসায়ীর হাতে বেঁচে থাকতে মেয়েকে তুলে দিববেননা। সব বাবারাই মেয়ের ভবিষ্যৎ চিন্তা করে। এক্ষেত্রে স্নিগ্ধার বাবার কথায় যথেষ্ট যুক্তি ছিলো।
শুক্রবারের বিকেল বেলা। রমনার পার্কের বেঞ্চিতে বসে আসি দুজন। বাদাম খেতে খেতে ভাবতে লাগলাম। কীভাবে দুই পরিবারকে রাজি করানো যায়। দুজনের মাথায় যত সুবুদ্ধি কুবুদ্ধি আছে সব খাটালাম। দেখলাম এ সূর্যের আলোয় ভাত রান্না করার মত ব্যাপার। সেদিনই সিদ্ধান্ত নিলাম। পালিয়ে বিয়ে করবো।
শনিবার দুজনে বেরিয়ে পড়লাম। সাথে ছিলো আমার জমানো হাজার বিশেক টাকা। আর মায়ের বানানো আমার বউয়ের জন্য কিছু গহনা। স্নিগ্ধাকে স্পষ্ট বারণ করলাম,শুধু নিজের কাপড়-চোপড় ছাড়া যাতে আর কিছু না নেয়।
সিলেটের বাসে উঠে পড়লাম দুজনে। ততক্ষণে পৃথিবীতে রাত নেমে এসেছে। আমার কাঁধে মাথাটা এলিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে স্নিগ্ধা। নিশ্চয়ই গতরাতে টেনশানে ঘুমায়নি। আহা!পরম শান্তির ঘুম।
তাকে আজ পরীর মত দেখাচ্ছে। মনে হচ্ছে আকাশ থেকে এক টুকরো চাঁদ আমার পাশে বসে আছে। আমার খুব ইচ্ছে করছে তাকে ডেকে তুলি। আর জিজ্ঞেস করি,তুমি এতো সুন্দর কেনো?
নয়টার দিকে এক স্টেশনে বাস থামলো। যাত্রা বিরতি।অচেনা স্টেশন। স্নিগ্ধা এখনো ঘুমাচ্ছে।তার ফোনও আমার হাতে। ভাবলাম,আগে বাথরুম থেকে আসি। তারপর তাকে ডেকে তুলব। একসাথে ডিনার করব।মেয়েটি আরেকটু ঘুমাক।
বাথরুম সেরে গাড়ির দিকে যাচ্ছি। এমন সময় এক বৃদ্ধ বলল,বাবা,আমাকে একটু বাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দাও। সামনেই আমার বাড়ি। আজ টর্চ আনতে ভুলে গেছি। আমি তাকে জানালাম আমি এখানকার কিছু চিনিনা। সিলেট যাচ্ছি। বাসে আমার বউ আছে।
বৃদ্ধ লোকটি অনুরোধ করতে থাকলো।শেষমেষ আমিও রাজি হলাম। ভাবলাম, গাড়ি ছাড়তে এখনো ঢের দেরী। বাড়িতো কাছেই। যাই একটা ভালো কাজ করে আসি।
পিচের রোড ছেড়ে আমরা মাটির রোডে হাঁটতে লাগলাম। ইতিমধ্যে হয়তো কয়েক কিলোমিটার পার করে এসেছি। তিনি আগে আগে হাঁটছেন। আমি পিছে পিছে।ওনাকে জিজ্ঞেস করতে লাগলাম, আর কতদূর? উনি বললেন,সামনের বাঁশঝাড় পেরোলেই বাড়ি।
বাঁশঝাড়ের কাছে আসতেই একদল লোক আমার উপর ঝাপিয়ে পড়ল।বৃদ্ধ লোকটির গলার স্বর পাল্টেছে। জোর গলায় বলল,হারামজাদার মোবাইল নে আগে।আমি দিতে আপত্তি জানালাম। সাথে সাথে একজন আমার মাথায় জোরে আঘাত করে। আমি বেহুশ হয়ে যাই।
চোখ খুলতেই নিজেকে আবিষ্কার করলাম হাসপাতালের বেডে।প্রচণ্ড শরীর ব্যথা। স্নিগ্ধার কথা মনে পড়তেই মাথা চক্কর দিয়ে উঠল।মনে হচ্ছে আমি আবার জ্ঞান হারাবো। কোনভাবে হাসপাতাল থেকে বেরুলাম। মাথায় কাজ করছিলো না।
কৌশলে তার বাড়িতে খবর নিলাম।জানলাম সে বাড়িতে যায়নি। সিদ্ধান্ত নিলাম সিলেট যাবো। তন্নতন্ন করে খুঁজে দেখবো তাকে। যদি না পাই আমিও কোনোদিন বাড়ি ফিরবোনা। সুইসাইড করবো।
হাতে এক কানাকড়িও নেই।বাধ্য হয়ে ডেলিভারি বয়ের কাজ করতে লাগলাম।দিনে কাজ করি। রাতে স্নিগ্ধাকে খোঁজতে বেরুই। খোঁজতে খোঁজতে একসময় ক্লান্ত হয়ে পড়ি। পা যখন আর চলেনা তখন শরীর এলিয়ে দিই।কখনো পার্কের বেঞ্চিতে,কখনো নরম ঘাসে।
দেখতে দেখতে একবছর হয়ে গেলো।চরম হতাশা ঘিরে ধরলো আমায়।বেঁচে আছি অথচ মনে হচ্ছে আমি বেঁচে নেই। এ জীবন আমার নয়।মনে হচ্ছে কোনো বন্ধুর কাছ থেকে ধার করে নিঃশ্বাস নিচ্ছি।
পরিত্রাণের উপায় হিসেবে বেচে নিলাম মদ আর পতিতালয়।আমার কাছে পতিতালয়কে মনে হচ্ছে স্বর্গ। আর পতিতাদের মনে হচ্ছে স্বর্গের ফুল।যে ফুলের সুবাস মূহুর্তেই ভুলিয়ে দেয় জীবনের সমস্ত অমীমাংসিত অংক।
এক স্বর্গ আমার বেশিদিন ভালো লাগেনা। দীর্ঘক্ষণ এক ফুলের সুবাস আমার কাছে বিষাক্ত মনে হয়।মনে হয় আমি স্নিগ্ধার ভালোবাসায় অন্যজনকে প্রবেশাধিকার দিচ্ছি। শরীরের বিনিময়ে বিক্রি করছি ভালোবাসা।
আজ রবিবার। স্নিগ্ধার জন্মদিন। বাসা থেকে প্ল্যান করে বের হয়েছি। প্রথমে যে ভিক্ষুক সামনে আসবে তাকে ৫০০ টাকা দিবো। তারপর নতুন এক স্বর্গে যাবো। সারারাত গল্প করবো। তার পাওনার চেয়ে হাজার দুয়েক টাকা বাড়িয়ে দিবো।
প্রথম কাজ সেরে দ্বিতীয় কাজ সারাতে যাচ্ছি। মন কোনোভাবে সায় দিচ্ছেনা। তারপরও গেলাম। কারণ এ শহরে আমার কোনো বন্ধু নেই। পতিতারাই আমার বন্ধু। আমার দুঃখ বন্ধুদের সাথে ভাগ করতে যাই। আজও যাচ্ছি। দোষের কী!
ঢোকা দিতেই দরজা খুলে দিলো এক মহিলা। ঘোমটায় তার মুখ ঢাকা। তবে আমার কেনো জানি মনে হচ্ছে, তার চেহারায় কষ্টের চাপ। মলিন মুখে বসে আছে সে।
খোঁপায় বেলী ফুলের মালা ঝুলছে ।ফুলের প্রাণ থাকলে হয়তো চিৎকার করে বলে উঠতো,এই মেয়ে, আমি তোমার খোঁপায় থাকবোনা। আমি হাসিখুশি মেয়েদের খোঁপায় থাকার জন্যে জন্মেছি। তোমার খোঁপায় না। হাসো,নয়তো চললাম।
আমাকে দেখে কী জানি বলতে গিয়েও আর বললোনা। এককোণে বসে রইল। আমি তাকে বললাম, আজ সারারাত যদি আপনার সাথে গল্প করি কোনো সমস্যা হবে?তিনি মাথা নেড়ে জানালেন কোনো সমস্যা নেই।
আমি তাকে আমার আর স্নিগ্ধার সমস্ত কথা বললাম। এও জানালাম আজ তার জন্মদিন। কথা বলতে বলতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি তা নিজেও জানিনা।
সকালে ঘুম থেকে উঠে সোজা বাসায় চলে আসলাম। গাড়িভাড়া দিতে গিয়ে পকেটে হাত দিয়েই দেখি একটি ছোট্ট চিরকুট।
তাতে লেখা,
“আমিই তোমার একসময়ের স্নিগ্ধা। আজ আর তোমার নেই। প্রতিরাতেই একেক জনের হয়ে যাই।”
আমরা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।