শাহাব উদ্দিন সাগর:
সাহসী পদক্ষেপ নেয়ার শপথে বলিয়ান হয়ে এক বছর আগে যাত্রা শুরু করেছিল সাপ্তাহিক নবযুগ। সময়টা খারাপ ছিল শুরুতেই। বিশ্ব অর্থনীতির দ্বিতীয় প্রধান শক্তি চীন তখন বিপর্যস্ত। লকডাউন শুরু হয়ে গেছে। যুক্তরাষ্ট্রসহ গোটা বিশ্ব তখনই ধাক্কা না খেলেও কয়েক মাসের মধ্যেই কার্যত গোটা বিশ্ব স্তব্ধ হয়ে পড়ে। এক পর্যায়ে শুরু হয়ে এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রই সবচেয়ে বড় ক্ষতিগ্রস্ত দেশ। কিন্তু সাপ্তাহিক নবযুগ এই বিপর্যয়ের মধ্যেও থেমে যায়নি, অব্যাহত রেখেছে সাহসী পদক্ষেপ।
মহামারিতে যখন প্রতিষ্ঠিত পত্রিকাগুলো কাজ বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়েছে, বন্ধ রেখেছে প্রকাশনা, তখন সদ্য প্রতিষ্ঠিত পত্রিকা হয়েও সাপ্তাহিক নবযুগ দমে যায়নি। ঝুঁকি নিয়েই অব্যাহত রেখেছে প্রকাশনা। প্রবাসের সঙ্গে দেশের সংযোগের সেøাগান দিয়ে পথচলা শুরু করেছিল নবযুগ। মহামারিও তাতে বাধ সাধতে পারেনি। সংকট ছিল নানা ধরনের। আগে থেকেই নিউইয়র্কের বাংলা সংবাপত্রগুলো কঠিন সময় পার করছিল। এর মধ্যে করোনা এসে পড়ায়, এগুলোকে মোকাবিলা করে পত্রিকাকে পাঠকপ্রিয় করে তোলা ও বিজ্ঞাপনের বাজার ধরাটা ছিল অত্যন্ত দুরুহ কাজ। কিন্তু কঠিন জেনেও আমরা যেমন যাত্রা শুরু করি, তেমনি কোনো বাধাই আমাদের খবর পৌঁছে দেয়ার ব্রত থেকে সরিয়ে দিতে পারেনি।
পাঠকের সঙ্গে থাকা, প্রবাসের সঙ্গে দেশের সংযোগ ঘটিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি পূরণ সম্ভব হয়েছে সংবাদকর্মীদের নিরলস শ্রম এবং পাঠক, বিজ্ঞাপনদাতা ও শুভানুধ্যায়ীদের কল্যাণেই। স্বল্প সময়ের মধ্যেই নবযুগের খবর ফেসবুক পেজে পাঠক লাইক ও শেয়ার করে জানান দিয়েছেন তাদের ভালোবাসা ও পাঠকপ্রিয়তাকে। যা সত্যিই ছিল প্রত্যাশার বাইরে। কার্যত লকডাউনে নিউইয়র্কের পাঠকপ্রিয়তার শীর্ষ বাংলা পত্রিকার জায়গা দখল করে নিয়েছে সাপ্তাহিক নবযুগ এবং এখনো সেই অগ্রযাত্রা অব্যাহত রয়েছে।
সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রে সততা ও নিষ্ঠার সমন্বয়ে বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রকাশ, সাহসী ভূমিকাগ্রহণ, অপশক্তিকে উপেক্ষা করা, প্রবাসীদের অধিকার নিয়ে কাজ করা এবং দেশের স্বার্থের পাশে দাঁড়ানো- প্রতিটি ক্ষেত্রেই প্রতিশ্রুতি মোতাবেক সাপ্তাহিক নবযুগ পাঠকের আস্থাভাজন থাকতে সক্ষম হয়েছে। তেমনি অশুভ শক্তির কাছে ভীতিকর হিসেবে হাজির হয়েছে নবযুগ। যুক্তরাষ্ট্রে বৈরি রাজনীতির ডামাডোলে সাপ্তাহিক নবযুগ অভিবাসীদের অধিকার ও ন্যায়বিচারের পক্ষে দাঁড়িয়ে সত্যকে তুলে ধরেছে। বাংলাদেশ থেকে অর্থপাচার ও দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠার প্রচারণায় সাপ্তাহিক নবযুগ ছিল সদা সোচ্চার।
গেল এক বছরে নবযুগ চেষ্টা করেছে প্রবাসে নতুন নতুন লেখক সৃষ্টির। এছাড়া যেসব লেখকরা শুরুর দিন থেকে নবযুগের সঙ্গে ছিলেন তাদেরকে শেষ পর্যন্ত সাথে রাখতে। এতে নবযুগ শতভাগ সফল হয়েছে। নবযুগ যেমন পুরনো এবং অভিজ্ঞ লেখক/কবিদের যথাযথ মূল্যায়ন করেছে তেমনি নতুন লেখক/কবিদের জন্য লেখালেখির অবারিত সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে।
পাঠক আর কমিউনিটির মানুষের ভালোবাসাই ‘নবযুগ’র প্রাণ। কমিউনিটির মানুষ ‘নবযুগ’কে ভালোবেসেছে বলেই নবযুগ টিকে থাকতে পেরেছে এবং এই করোনাকালেও কার্যপরধি বিস্তৃত করে চলেছে। কমিউনিটির অনেকেই করোনাকালে নবযুগ পড়তে পেরে মন্তব্য করেছেন, ‘দু:সময়ে নবযুগ কমিউনিটির অক্সিজেন হিসেবে কাজ করছে’। এ ধরনের মন্তব্য আমাদের সামনে এগিয়ে যাওয়ার সাহস জোগায়। আমাদের সমস্যা ছিল অনেক, কিন্তু স্বকীয়তা বিক্রি করে ‘নবযুগ’ বিজ্ঞাপনের বাজার ধরার চেষ্টা করেনি, ভবিষ্যতেও করবে না। চাকচিক্যকে প্রাধান্য না দিয়ে প্রবাস প্রজন্মের ভালো-মন্দকে সামনে এনে সংবাদ প্রকাশের নবতর ভাষা নির্মাণের লক্ষ্যে কাজ করে চলেছি আমরা। নবযুগ চেষ্টা করেছে, নিউইয়র্ক বা যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ করে অভিবাসী তথা বাংলাদেশিদের জানার, সতর্ক হওয়ার, সচেতন হওয়ার, তথ্য সমৃদ্ধ হওয়ার খবরগুলো পাঠকের সামনে উপস্থাপনের জন্য। করোনাকালীন যেমন সক্রিয় ছিল নবযুগ, ঠিক তেমনিভাবে মার্কিন নির্বাচন ২০২০ এর আদ্যোপান্থ পাঠকদের কাছে পৌঁছে দিয়েছে দায়িত্বশীলতার সঙ্গে।
সংবাদকর্মী ও অন্যান্য যারা পত্রিকা প্রকাশের সঙ্গে কাজ করেন, যারা লেখালেখি করেন, যারা পত্রিকা পৌঁছে দেন, যার নিয়মিত বিজ্ঞাপন দিয়েছেন মহামারির মধ্যে তাদের প্রচেষ্টার কথা স্মরণ রাখবে নবযুগ। সংবাদকর্মী, লেখক, সহযোগী, বিজ্ঞাপনদাতা ও পাঠকরা নবযুগের প্রতি আস্থা এবং বিশ্বাস রাখায় তাদের প্রতি অফুরন্ত ভালোবাসা। আমরা অনুভব করেছি, মহামারির তীব্রতা কমলে, টিকা সুলভ হলে এক বছর পূর্তি উদযাপনের। কিন্তু কমিউনিটির অনেকেই এখনো শোক কাটিয়ে উঠতে পারেননি। অনেকে নতুন করে আক্রান্ত হচ্ছেন, অনেকে স্বজন হারাচ্ছেন বা সেই শঙ্কায় রয়েছেন। এ অবস্থায় আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি বর্ষপূর্তির উদযাপন উৎসব আপাতত না করার। আমরা আশা করছি, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে নবযুগ একটি ঝাঁকজমক ও ব্যতিক্রমি উৎসব আয়োজন করে কমিউনিটিকে তাক লাগিয়ে দেবে। ১ম বর্ষপূর্তিতে নবযুগ’র কভার পেইজে নিয়মিত লেখকদের লেখা দিয়ে সাজানো হয়েছে, এটি যেমন ব্যতিক্রম তেমনি নিয়মিত লেখকদের সম্মান ও মর্যাদা বাড়ানোর একটি চেষ্টামাত্র। যা নবযুগ সব সময় অব্যাহত রাখবে।
সাপ্তাহিক নবযুগ একটি ‘ঐতিহাসিক পত্রিকা’র নাম। এটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯২০ সালে। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম এবং রাজনীতিবিদ কমরেড মুজফ্ফর আহমদ’র যুগ্ম সম্পাদনায়। এটি ১৯২০ সালের ১২ জুলাই সান্ধ্য পত্রিকা হিসেবে যাত্রা শুরু করে। এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন শের-ই-বাংলা এ. কে. ফজলুক হক। তিনি নিজ অর্থে এই পত্রিকা প্রকাশ করেন। ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী অনেক কবিতা ছাপা হলে এক পর্যায়ে ব্রিটিশ সরকার এ পত্রিকার জামানত বাজেয়াপ্ত করার পর এটি বন্ধ হয়ে যায়। শের-ই-বাংলা এ. কে. ফজলুল হকের চেষ্টায় ‘নবযুগ’ আবার প্রকাশিত হয়। পরে ফজলুল হকের সঙ্গে মতবিরোধের কারণে নজরুল ও মুজফ্ফর আহমদ সম্পাদকের পদ থেকে পদত্যাগ করলে পত্রিকাটি আবার বন্ধ হয়ে যায়।
১৯৪২ সালে শেরে-ই- বাংলা এ কে ফজলুল হক বাংলার প্রধানমন্ত্রী হলে তাঁর উদ্যোগে এবং কবি নজরুলের সম্পাদনায় পুনরায় ‘নবযুগ’ প্রকাশিত হয়। এ সময় কাজী নজরুল ইসলাম দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হলে খুলনার আহমদ আলী সম্পাদনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। দু’বছর পত্রিকাটি চালু থাকার পর চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়।
আমরা ‘নবযুগ’ নামটি বেছে নিয়েছিলাম; একটি শতককে কেন্দ্র করে। ‘নবযুগ’ প্রকাশিত হয়েছিল ১৯২০ সালে। ২০২০ সালে আমরা নিউইয়র্ক থেকে ‘নবযুগ‘ প্রকাশ করার মাধ্যমে ইতিহাসের অংশ হয়েছি।
বর্ষপূর্তিতে এসে ‘সাপ্তাহিক নবযুগ’ সুখে-দুঃখে কমিউনিটির সঙ্গে পথ চলার প্রত্যয় পুনর্ব্যক্ত করছে। যত খারাপ পরিস্থিতিই আসুক, আমরা কমিউনিটির পাশে থাকব। মহামারির মধ্যে সাপ্তাহিক নবযুগ সেই দায়িত্ব নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করে গেছে। আগামী দিনগুলোতেও গণমানুষের মুখপত্র হিসেবেই কথা বলতে চাই আমরা। আজকের এই দিনে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি নবযুগ এর ঢাকার চিঠির নিয়মিত লেখক খ্যাতিমান সাংবাদিক প্রয়াত হুমায়ুন সাদেক চৌধুরীকে। ‘সাপ্তাহিক নবযুগ’ সঙ্গে রাখুন- এগিয়ে থাকুন। সবাইকে নতুন বছরের শুভেচ্ছা- হ্যাপি নিউ ইয়ার-২০২১।
নবযুগ কমিউনিটিতে জাগিয়েছে নতুন প্রাণ
সুখে-দুঃখে একসঙ্গে পথ চলার প্রত্যয়
পড়া যাবে: [rt_reading_time] মিনিটে
আমরা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।