আনম রফিকুর রশীদ
সেকালের কীর্তিমানদের জ্ঞান চর্চা ও আড্ডাস্থল বিউটি বোর্ডিং, একালের জ্ঞান অনিসন্ধিৎসুদের তীর্থস্থান।
মেয়াদোত্তীর্ণ জরাজীর্ণ ভবনটি এখনো টিকে আছে তার সোনালি সময়ের জ্যোতি নিয়ে।
স্টুডেন্ট, গবেষক ও পর্যটকদের ভিড় দ্বিতীয় তলায়। উপরে নিচে মিডিয়ার কলাকুশলীর নজরকাড়া শুটিং। রেস্টুরেন্টে কম দামে স্বাস্থ্যকর খাবার, জমজমাট কাস্টমার।
পুস্তক প্রকাশনা ও বিক্রির বিপুল সমাহার ঢাকার বাংলাবাজার। এখানে শ্রীশ দাস লেনের জমিদার সুধীর চন্দ্র দাসের বাড়িতে ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পূর্বে সোনার বাংলা পত্রিকার অফিস ছিল। সে সুবাদে লেখক-সাংবাদিকদের দীপ্ত পদচারণা ছিল। আধুনিক নাগরিক কবি শামসুর রাহমানের হাতে খড়ি এই পত্রিকায়। পরবর্তীতে পত্রিকার অফিসটি কলকাতায় স্থানান্তরিত হলে ১৯৪৯ সালে প্রহ্লাদ চন্দ্র সাহা ও নলিনী মোহন সাহা ভাতৃদ্বয় বাড়িটি ভাড়া নিয়ে বোর্ডিংয়ে রূপান্তর ও নামকরণ করেন নলিনী মোহান সাহার মেয়ে প্রিয়দর্শিনী বিউটির নামে।
সাহা পরিবারের পৃষ্ঠপোষকতায় বিউটি বোর্ডিং হয়ে উঠে সাহিত্য, সংস্কৃতি ও রাজনীতির মিলন মোহনা।
বিউটি আড্ডায় যারা নিয়মিত যোগদান করতেন, তারা বিউটিয়ান নামে ভূষিত হতেন।
বিউটিয়ান কবিদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন শহীদ কাদরী, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, বেলাল চৌধুরী, নির্মলেন্দু গুণ, ফজল শাহাবুদ্দীন, আল মুজাহিদী, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, ফায়েজ আহমদ, মহাদেব সাহা, আবু হেনা মোস্তফা কামাল ও সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক। এখানে সৈয়দ শামসুল হকের জন্য নির্দিষ্ট চেয়ারটেবিল ছিল, যেখানে বসে তিনি লেখালেখি করতেন, উনার আসনে অন্য কেউ বসতেন না।
খ্যাতিমান লেখক আহমদ ছফা, ড. মুনতাসির মামুন, আসাদ চৌধুরীর সাহিত্যচর্চার সূতিকাগার বিউটি বোর্ডিং।
“আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি” – গানের গীতিকার কলামিস্ট আব্দুল গাফফার চৌধুরীর নিয়মিত যাতায়াত ছিল এখানে।
আন্তর্জাতিক খ্যাতিমানসম্পন্ন যাদুশিল্পী জুয়েল আইচ, বাঁশীবাদক,চিত্রশিল্পী, দেশের শিশুদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় ইউনিসেফের অ্যাডভোকেট হিসেবেও কাজ করার গৌরব রয়েছে, সুদীর্ঘকাল বিউটি বোর্ডিংয়ে থেকেছেন তিনি।
এই অঙ্গন চিত্রকর কাইয়ুম চৌধুরী, ভাস্কর নিতুন কুণ্ডু, শিল্পী দেবদাস চক্রবর্তী, কৌতুক অভিনেতা ভানু বন্দোপাধ্যায়ের স্মৃতিবিজড়িত।
বিউটি বোর্ডিংয়ে আসতেন ব্রজেন দাস, বিশ্ব বিখ্যাত বাঙালি সাঁতারু। তিনিই প্রথম দক্ষিণ এশীয় ব্যক্তি, যিনি সাঁতার কেটে ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দেন, ১৯৫৮ সালের ১৮ আগস্ট তারিখে।
চলচ্চিত্রকার খান আতাউর রহমান, জহির রায়হান, সুরকার সত্য সাহা, সুবল দাস এখানে বসে সংলাপ তৈরি করতেন, গান রচনা করতেন, সুর সৃষ্টি করতেন। প্রথম বাংলা সিনেমা মুখ ও মুখোশের পান্ডুলিপি রচনা করেন এখানে বসে আব্দুল জব্বার খান।
দর্শকপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘যদি কিছু মনে না করেন’ এর নন্দিত উপস্থাপক ফজলে লোহানী ছিলেন আড্ডার মধ্যমণি। প্রখ্যাত আবৃত্তিকার গোলাম মোস্তফার দরাজ কণ্ঠ শোনা যেত এখানে নিয়মিত। আসতেন এরশাদ সরকার আমলের সবচেয়ে জনপ্রিয় সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন যায়যায়দিনের নির্ভীক সাংবাদিক শফিক রেহমান।
রাজনৈতিক নেতা, ছাত্র জনতারও ভিড় ছিল এখানে। এখানে বসে মিটিং করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। নেতাজি সুভাষ বসুর পদচিহ্নে চিরগৌরবান্বিত বিউটি বোর্ডিং। নির্মল সেন, মহিউদ্দিন আহমেদ রাজনৈতিক দিক নির্দেশনা দিতেন এখান থেকেই।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের শুরুতেই আক্রান্ত হয় বিউটি বোর্ডিং। ২৮ মার্চ, ১৯৭১, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী প্রহ্লাদ চন্দ্র সাহাসহ ১৭ জনকে হত্যা করে ভবনটি দখল করে। ১৯৭২ সালে প্রহ্লাদ চন্দ্র সাহার স্ত্রী প্রতিভা সাহা দুই ছেলে সমর সাহা ও তারক সাহাকে নিয়ে পুনরায় চালু করেন।
পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির রাজধানী শাখার সভাপতি লায়ন মোঃ শামীম মিয়ার বিশেষ আমন্ত্রণে বিউটি বোর্ডিং পরিদর্শন ও আপ্যায়নে যোগদান। অসংখ্য গুণীজনের স্মৃতি বিজড়িত এই স্থানে দাঁড়িয়ে স্মৃতিময় মানুষগুলোকে স্মরণ করছি পরম শ্রদ্ধায়।
ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ভিত্তিভূমি এই কিংবদন্তিতুল্য জমিদার বাড়িতে বিউটি বোর্ডিং। ভবনটি সংস্কারের অভাবে ধ্বসে পড়ার পর্যায়ে অবস্থান করছে। ঐতিহাসিক গুরুত্ব বিবেচনায় ভবনটির প্রতি সরকারি সুদৃষ্টি কামনা করছি।
আনম রফিকুর রশীদ
কবি।
আমরা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।