মো: খোরশেদ আলম এডভোকেট
জেলা জজ আদালত, কক্সবাজার।
দেশে প্রতিনিয়তই জমি ক্রয়-বিক্রয় হয়। জমি ক্রয়-বিক্রয়কালে কোন্ মৌজার জমির দলিলে কত টাকা মূল্য লিখতে হবে তা সরকার কর্তৃক নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। দলিলে সরকার কর্তৃক নির্ধারিত হারে মূল্য লিখে ঐ মুল্যানুসারে রেজিষ্ট্রি খরচ দিয়ে ঐ দলিল রেজিষ্ট্রি করতে হয়। সেখানে ক্রেতা বিক্রেতা বাস্তবে কত টাকা মূল্যে জমি ক্রয়-বিক্রয় করলেন তা মোটেই বিবেচ্য বিষয় নয়। সরকার কর্তৃক নির্ধারিত মূল্য হারকে মৌজা রেইট বা বাজার মূল্য বলা হয়। বাজার মূল্য মৌজাওয়ারী নির্ধারণ করা হয়। অর্থাৎ একটি মৌজার প্রত্যেক শ্রেণীর জমির জন্য একটি রেইট।
মৌজা বলতে একটি বড় এলাকাকে বুঝায়। প্রত্যেক মৌজায় বিভিন্ন দামের জমি থাকে। কোন জমির বাস্তব মূল্য নির্ধারিত রেইটের কয়েকগুণ বেশি। আবার কোন জমির বাস্তব মূল্য নির্ধারিত রেইটের কয়েকগুন কম। কিন্তু একই মৌজার নির্দিষ্ট শ্রেণির সকল জমির জন্য একটি রেইট নির্ধারিত থাকায় উচ্চ মূল্যের কিংবা কম মূল্যের যে রকম জমিই ক্রয়-বিক্রয় করা হউকনা কেন, সকল জমির দলিলে কম পক্ষে সরকার কর্তৃক নির্ধারিত মূল্য লিখতে হয় এবং ঐ মূল্যানুসারে রেজিষ্ট্রি খরচ পরিশোধ করতে হয়। এতে বাস্তব উচ্চ মূল্যের জমি ক্রেতার লাভ হয় এবং কম মূল্যের জমি ক্রেতার ক্ষতি হয়। তাই বাজার মূল্য নির্ধারণ বিধিমালায় বর্ণিত বাজার মূল্য নির্ধারণের গড় মূল্য পদ্ধতিটি ন্যায় ভিত্তিক নয়। বাজার মূল্য নির্ধারণের গড় মূল্যের পদ্ধতিতে কোন কোন মৌজার বাজার মূল্য অস্বাভাবিক উচ্চ হারে নির্ধারিত হওয়ায় বিভিন্ন ব্যক্তি বিশেষ করে নীরস প্রকৃতির কম মূল্যের জমি ক্রেতা-বিক্রেতা ভোগান্তিতে পড়ে যায়।
উপরোক্ত বিষয়ের বিভিন্ন দিক বিস্তারিত আলোচনা করে জমির দলিলের রেজিষ্ট্রি খরচ, সরস নীরস একদর সরকারের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন”শিরোনামে আমি একটি কলাম লিখি। তা কয়েকটি অনলাইন পত্রিকায় এবং কক্সবাজারের কয়েকটি স্থানীয় পত্রিকায় প্রকাশ হয়। বাজার মূল্য নিয়ে উদ্ভূত ভোগান্তি নিরসনের জন্য আমি আমার লেখা কলামে কয়েকটি প্রস্তাবনা পেশ করি যা নিম্নরূপ ছিলঃ- ১) গড় মূল্য সূত্রের মাধ্যমে বর্তমানে যে সকল মৌজার বাজার মূল্য অসহনীয় মাত্রায় পৌঁছেছে সে সকল মৌজার বাজার মূল্য যৌক্তিক পর্যায়ে কমিয়ে আনা: ২) যে সকল মৌজায় সাধারণ মূল্যের জমির পাশাপাশি অতি উচ্চ মূল্যের জমি আছে, মৌজার মধ্যে সে সকল এলাকা পৃথক করা এবং উচ্চ মূল্যের এলাকা ও কম মূল্যের এলাকার জন্য পৃথকভাবে বাজার মূল্য নির্ধারণ করা, ৩) বাজার মূল্য নির্ধারণের জন্য বর্তমানে প্রচলিত গড় মূল্যের ভিত্তিতে বাজার মূল্য নির্ধারণের অলঙ্গনীয় বিধি বাতিল করা, ৪) বাজার মূল্য নির্ধারণ কমিটিতে সরকারী কর্মকর্তাগণের পাশাপাশি তৃণমূল পর্যায়ের জনপ্রতিনিধি যেমন- ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানকে অন্তর্ভূক্ত রেখে মৌজার বা ইউনিয়নের বাস্তব অবস্থার নিরীখে বাজার মূল্য নির্ধারণের ক্ষমতা কমিটিকে প্রদান করা অথবা ৫) বাজার মূল্য নির্ধারণের বিষয়ে বাধ্যবাদকতা অপসারণ করে বিষয়টি বাজারের উপর ছেড়ে দেওয়া।
আমার উক্ত কলাম প্রকাশের পর ঢাকাস্থ নিবন্ধন অধিদপ্তরের মহাপরিদর্শক (আইজিআর) মহোদয় বাজার মূল্য সম্পর্কে ৩০/১২/২০২০ইং তারিখে একখানা পরিপত্র জারী করেন। উক্ত পরিপত্রে প্রতিটি মৌজার অন্তর্ভূক্ত প্রতিটি শ্রেণীর অবস্থান নির্বিশেষে সমস্ত জমির মূল্য একই হারে নির্ধারণ করার বিষয়টি বাস্তব ভিত্তিক না হওয়ার, এবং সমস্যাটি সমাধানের লক্ষ্যে প্রতিটি মৌজার অন্তর্ভূক্ত জমি সমূহের অবস্থানগত প্রকৃতি বিবেচনায় নিয়ে মৌজা সমূহকে গুচ্ছ বা Cluster এ বিভক্ত করে জমির বাস্তব ভিত্তিক মূল্য নির্ধারণ আবশ্যক হওয়ার বিষয় উল্লেখ করেন। একই পরিপত্রে ২০২০ইং সালে প্রচলিত বাজার মূল্য তালিকাকে ২০২১ইং ও ২০২২ইং সালের জন্য বহাল রাখা ও নির্দেশ দেন। উক্ত পরিপত্রের শেষাংশ নিম্নরূপঃ-
“পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট সর্বনিম্ন বাজার মূল্য নির্ধারণ কমিটিকে স্ব স্ব এখতিয়ারাধীন এলাকায় বাস্তবতার নিরিখে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও সেবা গ্রহণকারী নাগরিকদের সাথে যৌথভাবে মতবিনিময় করে আগামী ৬(ছয়) মাসের মধ্যে গুচ্ছ (Cluster ) ভিক্তিক সর্বনিম্ন বাজার মূল্য নির্ধারণপূর্বক অধিদপ্তরে প্রেরণ করার জন্য বলা হল।”
মহাপরিদর্শক মহোদয়ের উক্ত পরিপত্র পাঠে বুঝা যায় যে, তিনি বর্তমানে প্রচলিত বাজার মূল্য নির্ধারণের গড় মূল্য পদ্ধতির ত্রুটি, তদ্বারা সৃষ্ট জনভোগান্তি, অন্তর দিয়ে অনুভব করেছেন এবং তা উত্তরণের উৎকৃষ্ট পদক্ষেপ নির্দেশ করেছেন। একটি মৌজার প্রত্যেক শ্রেণির জমির জন্য একটি রেইট নির্ধারণের পরিবর্তে মৌজাস্থ জমির অবস্থান ও প্রকৃতি বিবেচনায় নিয়ে মৌজাকে গুচ্ছ বা Cluster এ বিভক্ত করে, জনপ্রতিনিধি ও সেবা গ্রহণকারী নাগরিকদের সাথে মতবিনিয় করে, বাস্তবতার নিরিখে বাজার মূল্য নির্ধারণের যে নির্দেশনা, তা অকৃত্রিম আন্তরিকতা ও প্রশংসনীয় দায়িত্বশীলতার পরিচায়ক। তাঁর নির্দেশনা মেনে বাজার মূল্য নির্ধারণ করলে বাস্তব মূল্যের নিম্ন হারে নির্ধারিত বাজার মূল্য যেমন বাড়ানোর সুযোগ আছে,
তেমনি বাস্তব মূল্যের উচ্চহারে নির্ধারিত বাজার মূল্য কমানোর সুযোগও আছে। মহাপরিদর্শক মহোদয়ের এরূপ বাস্তবানুুগ নির্দেশনাকে অনুমোদন দেওয়ায় সদাশয় সরকারকে ধন্যবাদ।
মহাপরিদর্শক মহোদয়ের পরিপত্রে সমগ্র মৌজার জন্য একটি রেইটের পরিবর্তে মৌজাস্থ জমির অবস্থান ও প্রকৃতি বিবেচনায় নিয়ে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও সেবা গ্রহণকারী নাগরিকদের মতামত গ্রহণ করে মৌজার এলাকাকে বিভিন্ন গুচ্ছে বিভক্ত করে প্রতিটি গুচ্ছের জন্য বাস্তব ভিত্তিক পৃথক বাজার মূল্য নির্ধারণের দায়িত্ব বাজার মূল্য নির্ধারণ কমিটিকে অর্পন করা হয়েছে।
বাজার মূল্য নির্ধারণ কমিটির সদস্যগণের মধ্যে সিংহভাগই সরকারী কর্মকর্তা। প্রত্যন্ত গ্রাম এলাকার কোন্ মৌজার কোন্ জমির বাস্তব মূল্য কত? এবং একটি মৌজাকে কয়টি গুচ্ছে বিভক্ত করা সঙ্গত,তা শহুরে সরকারী কর্মকর্তাগণের পক্ষে অবগত হওয়া দূরুহ বিষয়। যদিও সাব- রেজিষ্ট্রার মহোদয় প্রতিনিয়তই জমি হস্তান্তরের দলিল রেজিষ্ট্রি করেন, তবুও তিনি ঐ জমির বাস্তব মূল্য কত তা জানার সুযোগ নাই। কারণ রেজিষ্ট্রির জন্য উপস্থাপিত প্রত্যেকটি দলিলে কমপক্ষে সরকার কর্তৃক নির্ধারিত বাজার মূল্য লিখেই উপস্থাপন করতে হয় যা সিংহভাগ ক্ষেত্রেই বাস্তব মূল্য নয়। দেশের প্রত্যেকটি মৌজাস্থ জমির বাস্তব মূল্য কত? এবং একটি মৌজা কয়টি গুচ্ছে বিভাগযোগ্য, তা সাব- রেজিষ্ট্রার কর্তৃক তদন্তের মাধ্যমে নির্ধারণ করাও বিশাল কর্মযজ্ঞের বিষয়। প্রত্যেকটি মৌজাস্থ কোন্ জমির বাস্তব মূল্য কত এবং একটি মৌজা কয়টি গুচ্ছে বিভাগযোগ্য তা ঐ মৌজার স্থানীয় জনপ্রতিনিধিগণ সহজেই নির্ণয় করতে পারেন। তাই প্রত্যেকটি মৌজার গুচ্ছ ভিত্তিক ও বাস্তব ভিত্তিক মৌজা রেইট নির্ধারণে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিগণের মতামতকে গুরত্ব দেয়ার জন্য মহাপরিদর্শক মহোদয়ের নির্দেশনাটি খুবই বাস্তবানুগ নির্দেশনা। উক্ত পরিপত্রের আলোকে দেশের সকল মৌজাস্থ জমির গুচ্ছ ভিত্তিক ও বাস্তব ভিত্তিক বাজার মূল্য নির্ধারণ কালে বাজার মূল্য নির্ধারণ কমিটি কিভাবে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিগণের ও সেবা গ্রহণকারী নাগরিকদের মতামত গ্রহণ করবেন তা কমিটিই নির্ধারণ করবেন।
উক্ত পরিপত্রের কপি স্থানীয় জনপ্রতিনিধিগণকে দেয়া হয়নি। সাব- রেজিষ্ট্রার অফিস এবং দলিল লিখকগণও সরকারী কোন চিঠিপত্রের ভাষ্য অজানা কারণে জনগণকে জানতে দিতে চান না। এক্ষেত্রে আশংকা থাকছে যে, উক্ত পরিপত্রের নির্দেশনা, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিগণ জানতে পারছেন কিনা? ৩০/১২/২০২০ইং তারিখের পরিপত্রে নির্দেশ
আছে যে, দেশের সকল মৌজাভূক্ত জমির গুচ্ছ ভিত্তিক এবং বাস্তব ভিত্তিক মৌজার রেইট নির্ধারণ করে পরবর্তী ০৬ (ছয়) মাসের মধ্যে তা নিবন্ধন অধিদপ্তরে প্রেরণ করতে হবে। ইতিমধ্যে ২ (দুই) মাস অতিবাহিত হয়ে গেছে। এখানে এ বিষয়ে কোন তৎপরতা লক্ষ্য করা যায়নি। বাজার মূল্য নির্ধারণ কমিটি যে কোন দিন স্থানীয় জনপ্রতিনিধির মতামত চাইলে তাঁরা উপস্থিত ক্ষেত্রে মতামত দিতে পারবেন না। কারণ মতামত দেয়ার জন্য তাদের ও বিভিন্ন মৌজাস্থ জমির অবস্থান, প্রকৃতি ও বাস্তব মূল্য সম্পর্কে খোঁজ খবর নিতে হবে। অর্থাৎ এজন্য তাঁদেরও home Work করতে হবে। এর অন্যথা হলে জনগণ উক্ত পরিপত্রের সুফল পাওয়া থেকে বঞ্চিত হবেন। উক্ত পরিপত্রের নির্দেশনার বিষয় স্থানীয় জনপ্রতিনিধিগণকে জানানোর ব্যবস্থা নিলে ভাল হত।
যেকোন বিষয়ে ভূক্তভোগী জনগণের ভোগান্তি লাঘব করা এবং জনগণের কল্যাণ সাধন করা স্থানীয় জনপ্রতিনিধিগণের আকাংখার মধ্যে পড়ে। তাঁরা উক্ত পরিপত্রের কপি না পেলেও জনস্বার্থে স্বেচ্ছায় খোঁজ খবর নিয়ে নিজ নিজ মৌজাস্থ জমির কয়টি গুচ্ছ হবে এবং কোন্ গুচ্ছের জমির বাস্তব মূল্য কত হবে তা সম্পর্কে ইউনিয়ন পরিষদে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত নিয়ে তা বাজার মূল্য নির্ধারণ কমিটিকে জানিয়ে জনদূর্ভোগ লাঘবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন।
আমরা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।