মোহাম্মদ ইউসুফ নবী

মানু্ষ সৃষ্টির সেরা জীব এ বিষয়টি দিবালোকের মত স্পষ্ট।কঞ্চিনকালেও এতে কারো দ্বিমত ছিল না। মানুষের এ শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি তার উন্নত চিন্তাশক্তি, বিবেক বুদ্ধি সহ বহুবিধ অনন্য গুণাবলী যা অন্য সৃষ্টির মাঝে নেই।মানুষের জীবনে সুখ যেমন রয়েছে তেমনি রয়েছে নানান দুচ্চিন্তা আর চড়াই উতরাই;মানু্ষ নিমজ্জিত হয় হতাশার অতল গহ্বরে;হারিয়ে ফেলে বিবেক বুদ্ধি আর আত্মনিয়ত্রণ;দিশেহারা মানু্ষ চায় স্বেচ্ছায় মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে।
অর্থাৎ মানু্ষ চায় আত্মহত্যার অধিকার!
অথচ চাইলেই কি মানুষের পক্ষে সে অধিকার পাওয়া সম্ভব?
আসলে এ প্রশ্নের উত্তরটা একটু জটিল বটে;উত্তরটা বুঝা একটু ধৈর্য সাপেক্ষ ব্যাপার!
কারণ মানু্ষ যখন সৃষ্টিকুলে শেষ্ঠত্বের দাবিদার তার সবকিছুই বিবেচিত হবে এ শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠিতে।
মানুষ যেকোন পরিস্থতিতে তার সর্বোত্তম বিবেককে আর বুদ্ধিমত্তাকে কাজে লাগাবে আর যদি তাও সম্ভবপর না হয় তবে সর্বাবস্থায় সর্বোচ্চ ধৈর্যের পরিচয় দেবে।অর্থাৎ তার প্রচেষ্টার শেষ মনে করলে সে প্রয়োজনে যা হওয়ার তাতে মৌন থাকবে;প্রয়োজনে সাধ্যের বাইরে কিছুই করবে না ;নীরব থাকবে যদিও নিজের অক্ষমতার কারণে কোন না কোন ভাবে তার মৃত্যুও আসে !তবে সত্যিই দেরিতে হলেও আপনার সফলতা না হোক বহু প্রতিক্ষিত মৃত্যু নামক অনন্ত বিদায়ের
এ হীমশীতল মুহূর্তটি আপনাআপনিই আপনার কাছে ধরা দেবে!
অন্যথায় আমরা যদি এর ব্যতিক্রমপথ বেছে নিই তবে সৃষ্টিকূলে মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব কি আদৌ থাকে?
উত্তর হবে, না!
তবে দুঃখজনক হলেও সত্য যে আমরা আত্মহত্যার অধিকার চাই!

আসুন দেখা যাক আত্মহত্যার অধিকার আদৌ কোন অধিকারের মধ্যে পড়ে কিনা:

মানুষের সৃষ্টির বা জন্মের ক্ষেত্রে কেউ কি
দাবি করতে পারবে তার সৃষ্টি বা জন্ম তার অধিকার?
অবশ্যই না, কারন মানু্ষের সৃষ্টি বা জন্মের ক্ষেত্রে নিজের কোনরূপ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণ নেই অর্থাৎ আমরা চাইলেই বলতে পারিনা আমার জন্ম নেওয়াটা আমার অধিকার ছিল!অর্থাৎ কারো জন্ম নেওয়াটা
তার নিজের ইচ্চাঅনিচ্ছার উপর কোনরূপ নির্ভরশীল নয়।তাহলে বুঝতে হবে আমাদের জীবনের নিয়ন্ত্রক আপাত দৃষ্টিতে অদৃশ্য কোন শক্তি বা সত্তা, নয় কি?
পবিত্র কুরআন কি বলে দেখা যাক:
“তোমারা কি ধারনা কর যে, আমি তোমাদেরকে অনর্থক সৃষ্টি করেছি এবং তোমারা আমার কাছে ফিরে আসবে না?
তিনি সত্যিকার মালিক,তিনি ব্যতীত কোন মাবুদ নেই।তিনি সম্মানিত আরশের মালিক।”[সূরা মুমিনিন-১১৫-১১৬]

“আমি নভোমণ্ডল, ভূমণ্ডল ও এতদুভয়ের মধ্যবর্তী সব কিছু ক্রীড়াচ্ছলে সৃষ্টি করিনি।
আমি এগুলো যথাযথ উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করেছি। কিন্তু তাদের অধিকাংশই তা বোঝে না।”[দুখান-৩৮-৩৯]
“আমি কি তোমাদেরকে জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করিনি?”[সূরা নাবা-৮]

“নিশ্চয় আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি শ্রেষ্ঠতম-সুন্দর আকৃতিতে।”[সূরা তীন : আয়াত-৪]

অন্যদিকে মানু্ষ চায় অনন্তকাল বেঁচে থাকতে;এ ক্ষেত্রেও মানব সৃষ্টিরসূচনা লগ্ন থেকে অধ্যাবধি প্রচেষ্টার কি কমতি আছে?
অবশ্যই না, তবে মানবকূল তথা সৃষ্টিকূলের কোন ভাবেই এ মৃত্যুকে ঠেকানো সম্ভব না!
অস্বীকার করতে পারবেন কি এ বিভীষিকাময় সত্যকে?
দেখি পবিত্র কুরআন কি বলে:
“তোমারা যেখানেই থাক মৃত্যু তোমাদের নাগাল পাবেই,যদি তোমরা শক্তিশালী দূর্গেও থাক।”[সূরা নিসা:৭৮]।
অর্থাৎ মৃত্যুর কাছেও আমাদের ইচ্ছাঅনিচ্ছার কোন মূল্য নেই!বরং
জন্মের চেয়ে মৃত্যুই সুনিচ্চিত।

আবার স্বেচ্ছায় মৃত্যুবরণ মানুষের অধিকারের মধ্যে পড়ে কিনা বুঝতে গেলে আমাদের অধিকারের বিষয়টি আরো গভীরভাবে চিন্তা করে দেখা দরকার!
অধিকারের সংজ্ঞায় আমরা দেখতে পাই
সকল অধিকার কোন না কোন নিয়মের অধীন অর্থাৎ নিয়মসিদ্ধভাবে পারস্পরিক স্বার্থ রক্ষা করে নিজের কল্যাণসাধনের সুযোগের চর্চার নামই অধিকার।এর বিপরীত চর্চার নাম নৈরাজ্য!
সংজ্ঞায়নে আমরা দেখতে পাই যা কিছু সাধারণ নিয়ম বহির্ভূত তা কোনভাবেই অধিকারের মধ্যে পড়ে না!প্রাকৃতিক নিয়ম হচ্ছে সুনির্দিষ্ট কাল পরে “সকল জীবসত্তারই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে।”
সুতরাং সুনির্দিষ্টকাল পর্যন্ত সামর্থ্যানুযায়ী উত্তমভাবে বেঁচে থাকতে চাওয়াটই অধিকারের মধ্যে পড়ে স্বেচ্ছায় মৃত্যুবরণ নয়;যেহেতু আত্মহত্যা একটি প্রকৃতি ও নিয়মনীতিবিরুদ্ধকাজ সেহেতু এটিকে আমরা নৈতিক অধ্ব:পতনজনীত নৈরাজ্য বলতে পারি অধিকার নয়!

দেখি কুরআন কি বলে:
“তোমরা নিজের হাতে নিজেদের জীবনকে ধ্বংসের মধ্যে নিক্ষেপ করো না।”[সূরা বাকারা-১৯৫ ]

“তোমরা নিজেরা নিজেদেরকে হত্যা করোনা।নিশ্চয়ই মহান আল্লাহতাআলা তোমাদের উপর দয়ালু।
আর যে ব্যক্তি বাড়াবাড়ি ও যুলুমের মাধ্যমে এ কাজ করবে, তাকে আমি শীঘ্রই আগুনে পোড়াবো(নিক্ষেপ করব)।এ কাজ মহান আল্লাহতাআলার পক্ষে খুবই সহজ!”[সূরা নিসা-২৯-৩০]

জীবনের সকল দুঃখ কষ্ট হয় আমাদের কর্মফল অথবা এক একটি পরীক্ষা:
“আমি অবশ্যই কিছু না কিছু দিয়ে তোমাদেরকে পরীক্ষায় ফেলবই:মাঝেমধ্যে তোমাদেরকে বিপদের আতংক, ক্ষুধার কষ্ট দিয়ে, সম্পদ,জীবন,পণ্য-ফল-ফসল হারানোর মধ্য দিয়ে।আর যারা কষ্টের মধ্যেও ধৈর্য -নিষ্ঠার সাথে চেষ্টা করে তাদেরকে সু সংবাদ দাও।”[সূরা বাকারা-১৫৫]
“মানুষ কি মনে করে যে ‘আমরা ঈমান এনেছি’-এ কথা বলেই অব্যাহতি পেয়ে যাবে, আর তাদেরকে পরীক্ষা করা হবে না?
আমি অবশ্যই তাদের পূর্বে যারা ছিল তাদরকে পরীক্ষা করেছি।আর আল্লাহ অবশ্যই জেনে নিবেন কারা সত্যবাদী আর কারা মিথ্যাবাদী। “[সূরা আনকাবুত-২-৩]
“আর আমি ভাল-মন্দ দ্বারা তোমাদেরকে পরীক্ষা করে থাকি এবং আমার কাছেই তোমাদেরকে ফিরে আসতে হবে।”[সূরা আম্বিয়া -৩৫]
“যিনি(আল্লাহ)সৃষ্টি করেছেন মরণ ও জীবন, যাতে তোমাদেরকে পরীক্ষা করেন- কে তোমাদের মধ্যে কর্মে শ্রেষ্ঠ?
তিনি পরাক্রমশালী,ক্ষমাময়।”[সূরা মূলক-২]

এবার পর্যালোচনা করা যাক হাদিসের আলোকে:

“এক ব্যক্তি আহত হয়েছিল।
সে আত্মহত্যা করলে মহান আল্লাহতাআলা বলেন,আমার বান্দা বড়ই তাড়াহুড়া করল।
সে নিজেই নিজেকে হত্যা করল।আমি তার জন্যে জান্নাত হারাম করে দিলাম।”[ বুখারী]

আত্মহত্যাকারী নিজেকে যে উপায়ে হত্যা করবে, তাকে সেভাবে জাহান্নামে শাস্তি দেওয়া হবে। হজরত আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত, মহানবী (সা.) ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি পাহাড় থেকে লাফ দিয়ে নিজেকে হত্যা করবে, সে জাহান্নামে লাফ দিতে থাকবে স্থায়ীভাবে। আর যে ব্যক্তি বিষপানে আত্মহত্যা করবে, তার বিষ তার হাতে থাকবে, জাহান্নামে সে স্থায়ীভাবে থাকবে। আর যে ব্যক্তি নিজেকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করবে, জাহান্নামে সেই ছুরি তার হাতে থাকবে। তা দিয়ে সে তার পেটে আঘাত করবে, তাতে সে স্থায়ীভাবে থাকবে।’ [বুখারী : ৫৭৭৮]
হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ)থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন রাসুল (সঃ) বলেছেন, যে ব্যক্তি ফাঁসি লাগিয়ে বা গলা টিপে আত্মহত্যা করে, জাহান্নামে সে নিজেই নিজেকে অনুরুপভাবে
শাস্তি দেবে।আর যে ব্যক্তি বর্শা বিধিঁয়ে আত্মহত্যা করে সে নিজেই নিজেকে বর্শা বিধিঁয়ে শাস্তি দেবে।”[ বুখারী ]

কারো প্ররোচনায় বা চাপে আত্মহত্যা করা যাবে কিনা:
হজরত আলী (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী কারিম (সা.) একটি দল কোনো এক স্থানে পাঠালেন। তাদের আমির বানালেন এক ব্যক্তিকে। সে আগুন জ্বালাল আর বলল, তোমরা তাতে প্রবেশ করো, তখন তারা তাতে প্রবেশ করতে চাইল। আরেক দল বলল, আমরা আগুন থেকেই পালিয়ে এলাম। তখন তারা নবী (সা.)-কে এই সংবাদ দিলেন। তিনি যারা তা ইচ্ছা করেছে, তাদের বললেন, তারা যদি তাতে প্রবেশ করত, তারা তাতে কিয়ামত পর্যন্ত থাকত, আর অন্য দলকে বললেন, পাপকাজে কারো আনুগত্য নেই। নিশ্চয়ই আনুগত্য কল্যাণের কাজে।’ [ বুখারী- ৭২৫৭]

তাহলে আমরা যারা দুর্দশাগ্রস্ত আর হতাশ তাদের করণীয় কি:
“হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা ধৈর্যধারণ কর এবং ধৈর্যধারণে প্রতিযোগিতা কর।”[সূরা আলইমরান-২০০]
হযরত আবুহুরাইরা[ রাঃ] থেকে বর্ণিত ‘আল্লাহর রাসুল [সঃ]বলেছেন, “আল্লাহ যার মঙ্গল চান, তাকে দুঃখকষ্টে ফেলেন।”[ বুখারী -৫৬৪৫]
হযরত আবুহুরাইরা[ রাঃ] থেকে বর্ণিত, “আল্লাহতাআলা বলেন,আমার মুমিন বান্দার জন্য আমার নিকট জান্নাত ব্যতীত অন্যকোন পুস্কার নেই যখন আমি তার দুনিয়ার প্রিয়তম কাউকে কেড়ে নিই এবং সে সওয়াবের নিয়তে সবর(ধৈর্যধারণ করে)করে।”[বুখারী -১২৮৪,১২৫২,মুসলিম-৯২৬]
“নিশ্চয়ই তুমি পাবে যা তোমার থেকে চলে গেছে তার চেয়েও উত্তম।”[সূরা আনফাল-৭০]

 

মোহাম্মদ ইউসুফ নবী ,বিএ সম্মান,এমএ,ইতিহাস,চ.বি.