শিপ্ত বড়ুয়া
বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের পরিপেক্ষিতে ফৌজদারী মামলা হয়রানী করার এক ধরণের হাতিয়ার। বাংলাদেশের আইন ব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রিতার সুযোগ নিচ্ছে অহরহ প্রতারণালোভী মানুষ। একটা ফৌজদারী মামলা বলতেই নির্ঘাত পাঁচ থেকে দশ বছর জীবন নামের অধ্যায় থেকে খোয়া। টাকা, সময়, জীবন তিনটাই মামলার পেঁছনে যাবে। আমাদের দেশে এত বেশি মামলা হয় প্রতিদিন যা বিচার করতে পর্যাপ্ত সংখ্যক বিচারক এবং দক্ষ ও পর্যাপ্ত তদন্তকারী কর্মকর্তা নেই যার কারণে বছরের পর বছর মামলার জট লেগে থাকে। আপনারা অনেকেই জানেন ফৌজদারী মামলা দুইভাবে হয়ে থাকে, থানায় এবং আদালতে। ধরুণ হঠাৎ আপনি জানতে পারলেন আপনার নামে থানায় মামলা হয়েছে এবং পুলিশ আপনাকে গ্রেফতার করতে খুঁজছে, এখন আপনার করণীয় কি?
প্রথমেই বলে রাখি যে, অভিযুক্ত এবং অপরাধী এই দুটো আলাদা শব্দ। আপনার নামে যদি কেউ থানায় কিংবা আদালতে মামলা করে তাহলে মনে রাখবেন আপনি সুনির্দিষ্ট কোন অপরাধে অভিযুক্ত, অপরাধী নয় এবং বিচলিত হওয়ার কোন কারণ নেই। বরং আপনাকে তখনই অপরাধী বলা যাবে যখন আদালত বিচার করার পর রায় ঘোষণা করবেন। সত্য-কিংবা মিথ্যা আপনার নামে থানায় মামলা হওয়ার পর আপনার প্রথম কাজ একজন বিজ্ঞ আইনজীবীর সাথে পরামর্শ করা। এবং আপনার নামে এজাহারে কি কি অভিযোগ আনা হয়েছে তার খোঁজ নেওয়া। থানায় মামলা হলে তার পরের দিনই আদালতের জি.আর.ও অফিসে সকল মামলার নথি পাঠানো হয় এবং আসামীর আইনজীবী চাইলে সে নথির নকল সংগ্রহ করতে পারেন। সুতরাং আপনার আইনজীবী সহকারীর মাধ্যমে সে মামলার নকল এজাহার সংগ্রহ করতে হবে এবং পর্যালোচনা করে দেখতে হবে যে, আপনার নামে ঠিক কি কি অভিযোগ আনা হয়েছে।
এজাহারে বিস্তারিত বর্ণনা দেওয়া থাকে আপনাকে কি কি অপরাধে এবং তা কোন আইনের কোন ধারায় আর কে আপনার নামে অভিযোগ করেছে। সুতরাং এসব বিষয় আপনার বিজ্ঞ আইনজীবীর মাধ্যমে পর্যালোচনার পর পরামর্শ নিন যে আপনার নামে যেসকল অভিযোগ আনা হয়েছে তা কি জামিনযোগ্য নাকি জামিনঅযোগ্য ধারার অভিযোগ। মনে রাখবেন যে মূল ফৌজদারী তত্ত¡গত আইন দন্ডবিধি বা দি পেনাল কোড। বেশিরভাগ মামলা এই আইনের অধীনে করা হয়ে থাকে অথবা বাংলাদেশের বিশেষ অনেক আইন অনুযায়ীও মামলা দায়ের হতে পারে। যে আইনে মামলা হবে সে আইনে বলা থাকে যে কোন কোন ধারা জামিনযোগ্য এবং কোন কোন ধারা জামিনঅযোগ্য। আপনার বিজ্ঞ কৌশুলীর মাধ্যমে তা জানার চেষ্টা করুন।
এজাহার পর্যালোচনা করার পর চাইলে সে দিন সংশ্লিষ্ট আদালতে জামিনের আবেদন করে আইনজীবীর মাধ্যমে আত্মসমর্পন করতে পারেন। যা আদালত ভালো চোখে দেখতে পারে। আত্মসমর্পন করে জামিনের আবেদন করলে আদালত চাইলে আপনাকে জামিনে মুক্তি দিতে পারে কিংবা জেল-হাজতে প্রেরণ করতে পারেন। আপনার বিজ্ঞ কৌশুলীর বাচনিক নিবেদন এবং আবেদনের উপর জামিন অনেকাংশে নির্ভর করে থাকে। তাছাড়া আমলী আদালত যদি জামিন দেওয়ার পর্যাপ্ত কারণ থাকার পরেও আপনাকে জামিন না দেন সেক্ষেত্রেও আইনী করণীয় হলো মিস কেস করা মানে জামিন না-মঞ্জুরকারী আদালতের আদেশের বিরুদ্ধে দায়রা আদালত কিংবা হাইকোর্টে ফৌজদারী কার্যবিধির ৪৯৮ ধারা মোতাবেক জামিনের আবেদন করা। যদি এমন হয় যে থানায় মামলা হওয়ার পর পরেই আপনাকে পুলিশ গ্রেফতার করে নিয়ে গেলো তাহলেও আইনজীবীর মাধ্যমে জামিনের আবেদন করা যায়। থানায় আপনার নামে কোন মামলা হলে পুলিশ বিনা পরোয়ানায় আপনাকে গ্রেফতার করতে পারে। সুতরাং তাৎক্ষণিকভাবে মিথ্যা মামলা কিংবা হয়রানীমূলক মমলা থেকে রক্ষার উপায় হলো আত্মসমর্পন করে জামিনের আবেদন করা আর ইতিমধ্যেই গ্রেফতার হয়ে গেলে আইনজীবীর মাধ্যমে জামিনের আবেদন করা।
এই গেলো থানায় মামলা বিষয়। এবার আসা যাক কোর্টের মামলা। যখন নির্দিষ্ট কোন ব্যক্তি কিংবা প্রতিষ্ঠান সরাসরি আদালতে গিয়ে কিংবা ম্যাজিষ্টেটের কাছে গিয়ে আপনার নামে কোন অপরাধের অভিযোগ করেন তখন ম্যাজিষ্টেট তা আমলে নিয়ে মামলা দায়ের করতে পারেন যাকে আমরা কোর্ট মামলা কিংবা কমপ্লেইন্ট রেজিষ্টার কেস বলে থাকি। অভিযোগের ধরণ এবং তাৎক্ষণিক বিষয় পর্যালোচনা করে ম্যাজিষ্টেট অভিযুক্ত ব্যক্তির প্রতি সমন জারি কিংবা এরেস্ট ওয়ারেন্ট জারী করতে পারেন। অথবা যদি ম্যাজিষ্টেটের সন্দেহ হয় অভিযোগের সত্যতা যাচাই করার জন্য সংশ্লিষ্ট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কিংবা আইনে অনুমোদিত অন্য কাউকে ঘটনার সত্যতা যাচাই করার নির্দেশ দিতে পারেন। কথা হচ্ছে যদি আদালত আপনাকে আদালতে হাজির হওয়ার সমন পাঠান সেক্ষেত্রে আপনার করণীয় বিজ্ঞ আইনজীবীর মাধ্যমে আদালতে হাজির হয়ে আত্মসমর্পনপূর্বক জামিনের আবেদন চাওয়া কিংবা এরেস্ট ওয়ারেন্ট হলেও গ্রেফতার এডিয়ে আত্মসমর্পনপূর্বক জামিনের আবেদন করা।
এতক্ষণ উপরের আলোচনা থেকে নিশ্চয় সঠিকভাবে বুঝতে পেরেছেন যে, আপনার নামে মিথ্যা কিংবা হয়রানীমূলক মামলা হলে আপনার প্রথম করণীয় কি সে বিষয়ে। জামিন আসলে তাৎক্ষণিক মুক্তি কিংবা মামলা চলাকালীন শর্তসাপেক্ষে মুক্ত থাকা। জামিন নির্দিষ্ট তারিখ পর্যন্ত সীমাবদ্ধ হতে পারে অথবা স্থায়ী হতে পারে, মামলার গুণাগুণ বিবেচনা করে আদালত তা নির্ধারণ করবেন। কখনোই মনে করবেন না জামিন মানে মামলার স্থায়ী সমাধান।
জামিনে আপনি মুক্ত হয়ে গেলে এর পরের কাজ মামলার ধার্য্য তারিখে সময়মতো আদালতে হাজিরা দেওয়া। নিয়মিত মামলায় হাজিরা দিলে আদালত জামিন বাতিল করেন না । তাছাড়া বিজ্ঞ আইনজীবীর পরামর্শ আপনাকে সবসময়ই নিতে হবে যাতে মামলা সঠিকভাবে পরিচালনা করা যায়। যে মামলায় হোক না কেন অভিযুক্তরা সচরাচর জামিনে মুক্তি পেলে মামলার আর কোন খোঁজ-খবর রাখেন না যা মারাত্মক একটি ভূল। মনে রাখবেন মামলা শেষ না হওয়া পর্যন্ত আপনার বিপদ রয়েছে। জামিনে মুক্তি লাভের পর বিজ্ঞ আইনজীবী দ্বারা সাক্ষ্য-প্রমাণ দিয়ে মামলার চূড়ান্ত রায় পর্যন্ত সঠিকভাবে মামলা পরিচালনা করতে না পারলে স্থায়ী বিপদ হতে পারে। মামলায় অবেহেলার কারণে অনেক সময় অভিযুক্ত ব্যক্তির সাজাসহ জরিমানা হয়ে যেতে পারে যা ঝামেলার বিষয়।
যদিও নিম্ন আদালত থেকে মামলার সাজা হলে উচ্চ আদালতে আপিল, রিভিশন, রিভিউ করা যায় তা খুবই অনিশ্চিত এবং ঝামেলার ব্যাপার। সুতরাং মিথ্যা মামলায় ফেসে গেলে অবশ্যই জামিন নিয়ে বিজ্ঞ কৌশুলীর মাধ্যমে নিয়মিত মামলা পরিচালনা করুন। নিজে নিজে সিদ্ধান্ত না নিয়ে কিংবা কোন দালাল না ধরে সরাসরি আপনার পরিচিত কোন আইনজীবীর পরামর্শ নিন তাতেই আপনার মঙ্গল। কোনভাবেই একটি মামলাকে হালকাভাবে নিবেন না কারণ একটি মামলা সারাজীবন ধ্বংসের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
লেখক: শিপ্ত বড়ুয়া, শিক্ষানবিশ আইনজীবী, কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালত। E-mail: shipta52@gmail.com
আমরা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।