রুহুল আমিন

 

গল্পে পড়েছি বাদশা তার তিন কন্যার মধ্যে যে কন্যা বাদশাকে লবণের মতো ভালোবাসতো দিনশেষে বাদশাকে ও-ই কন্যাকেই সবথেকে বেশি ভালোবাসতে হয়েছিল,কারণ বাদশা বুঝতে পেরেছিল লবণবিহীন খাবারের স্বাদ জমে না,আর খাবার বিহীন মানুষের জীবন চলে না।

এ-ই লবণকে আমরা কক্সবাজার অঞ্চলের মানুষরা সাদা সোনা হিসেবেই মূল্যায়ন করে থাকি কারণ লবণ চাষের নির্ভর করে কক্সাবাজার প্রায় ৪০% পরিবারের আয় রোজগার।

লবণ উৎপাদনের ইতিহাস বলতে গেলে,লবণ উৎপাদন আদিকাল থেকে সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চলের একটি দেশীয় শিল্পোদ্যোগ ছিল। ‘মুলঙ্গী’ নামে পরিচিত চট্টগ্রামের এক শ্রেণির লোক অতীতকাল থেকে সমুদ্রের পানি সিদ্ধ করে লবণ উৎপাদন করত। তাদের লবণ উৎপাদন ক্ষেত্রকে ‘তোফল’ বলা হতো।

মোঘল আমলে ‘নিমক জায়গীর মহাল ও নিমক এয়জ মহাল’ নামক দুটি সরকারি বিভাগ এই শিল্প নিয়ন্ত্রণ করতো। নিজামপুর, জুলদিয়া ও বাহারছরা এই তিনটি চাকলার অধীনে মোট ৩৯টি লবণ সংগ্রহ ক্ষেত্র ছিল। ষোড়শ শতকে লবণ উৎপাদনকারীদের সরকারি খাতে মাশুল দিতে হতো। মোঘল আমল পর্যন্ত লবণ শিল্পে সরকারের একচেটিয়া আধিপত্য ছিল।

বাংলাদেশের লবণ উৎপাদনের নিয়মটা হচ্ছে,বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চলে উৎপন্ন লবণকে কেন্দ্র করে বৃহৎ লবণশিল্প গড়ে উঠেছে। দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে সমুদ্রের লোনা পানি দ্বারা ডিসেম্বর হতে মধ্য মে পর্যন্ত লবণ উৎপাদিত হয়ে আসছে। পূর্বে মানুষ সমুদ্রের পানি চুলায় জ্বাল দিয়ে বা রোদে শুকিয়ে (সৌর পদ্ধতিতে) লবণ উৎপাদন করতো।মাঝে কিছুকাল কাঁদা মাটিকে সমান করে রোদে শুকিয়ে এ-র ওপর সমুদ্রের পানি দিয়ে লবণ উৎপাদন করতো।কিন্তু ২০০০-২০০১ সাল থেকে পলিথিন পদ্ধতিতে লবণ উৎপাদন শুরু হয়।

সনাতন পদ্ধতিতে একর প্রতি লবণের উৎপাদন ছিল ১৭.২৫ মেট্রিক টন এবং নতুন পদ্ধতিতে প্রতি একরে লবণ উৎপাদিত হয় প্রায় ২১ মেট্রিক টন। এই পদ্ধতিতে সনাতন পদ্ধতির তুলনায় ৩৫% অধিক ও আন্তর্জাতিক মানের লবণ উৎপাদিত হয়, যা দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি করার সম্ভবনা সৃষ্টি করে।

কক্সবাজার জেলার মহেশখালী, টেকনাফ,চকরিয়া, কক্সবাজার সদরে ইসলামপুর, ভারুয়াখালী,চৌফুলন্ডী এবং পেকুয়ায় লবণ উৎপাদন হয়ে থাকে।এ-ই অঞ্চলের বেশির ভাগ মানুষই লবণ শিল্পের সাথে জড়িত।

কক্সবাজার অঞ্চলে উৎপাদিত লবণ দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি হয়ে থাকে কিন্তু দুঃখের বিষয় বর্তমানে লবণ শিল্পের দুরাবস্থা চলছে।একদিকে কক্সবাজার মাতারবাড়ী-ধলঘাটায় কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণের কারণের ১৪শ একর ও বেশি জায়গা চাষীদের কাছ থেকে অধিগ্রহণ করা হয়েছে যার ফলে লবণ চাষীরা আজ দুঃসময় পার করছে।

এরপরেও কক্সবাজার জেলায় যে সব অঞ্চলে এখনও লবণ চাষ হয় তা দেশের চাহিদা মেটাতে সক্ষম।
আজ প্রশ্ন হলো লবণ চাষীরা কি আদতে ভালো দিনযাপন করছে নাকি দুর্বিষহ জীবন পার করছে।আমার স্বচক্ষে দেখা এবং আমি নিজেও একসময় লবণ চাষের সাথে জড়িত ছিলাম,যে পরিমাণ পরিশ্রম দিয়ে লবণ উৎপাদন করা হয় তার নূন্যতম দামও চাষীরা পায় না।কক্সবাজারে লবণ শিল্পে বলতে গেলে এখন দুরাবস্থা চলছে,যে লবণ আজ থেকে বছর চারেক আগে ৫০০/৬০০ টাকা করে দাম ছিল সেই লবণ বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে মাত্র ১৮০/১৯০ টাকা দরে।
এটি চরম হতাশাজনক এবং কষ্টের বিষয়।

লবণ চাষীরা এটি কখনও আশা করে নাই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষে কাছ থেকে।এমন পরিস্থিতি হওয়ার কারণটা হচ্ছে, দেশের উৎপাদিত যে লবণ দেশের চাহিদা মেটাতে সক্ষম সেখানে সিন্ডিকেটের কার্যক্রমের কারণে বাইরের দেশ থেকেও লবণ আমদানি করা হয় যার ফলে মুখথুবড়ে পড়েছে দেশের লবণ শিল্প, ফলে কপালে হাত পড়েছে দেশের গরীব চাষীদের।

এমতাবস্থায় সরকার এবং লবণ শিল্পের সাথে জড়িত সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যদি দেশের লবণ শিল্পের প্রতি সজাগ দৃষ্টিতে না দেখে তাহলে হয়ত বাংলাদেশ থেকে লবণ শিল্প চিরতরে হারিয়ে যাবে।
এ-ই লবণ শিল্প বাচাঁতে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা অনেক বেশি ভূমিকা রাখতে পারে,নির্বাচনের সময় তাদের প্রতিশ্রুতিতে লবণ শিল্পকে বাচাঁতে লবণের দাম বাড়ানোর যে প্রতিশ্রুতি তারা দেয় তা কখনও যথাযথ বাস্তবায়নের জন্য পদক্ষেপ তারা নেয় না এবং কর্তৃপক্ষের নিকট তদবির করে না যার ফলে এমন অবস্থা হয়েছে এ-ই লবণ শিল্পের। যদি তারা নিজ নিজ দায়িত্ববোধ থেকে থেকে উচ্চ মহলে জোর তদবির করে এবং কক্সবাজারে একটি লবণ বোর্ড স্থাপন করা হয়, বিদেশ থেকে লবণ আমদানি করা যদি বন্ধ হয় সর্বোপরি সরকার যদি লবণের সঠিক মূল্য দেওয়ার জন্য যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ তাহলে চাষীরা তাদের কষ্টের ফল পাবে।

তাই কক্সবাজারের একজন তরুণ হিসেবে সকলের নিকট আহবান থাকবে,আমাদের অঞ্চলের সাদা সোনা নামে খ্যাত এ-ই লবণ শিল্পকে বাঁচাতে আমাদের সবার সজাগ হতে হবে এবং চাষীদের পাশে দাঁড়াত হবে।

লেখকঃ
শিক্ষার্থী কক্সবাজার সিটি কলেজ।
সভাপতি, কক্সবাজার বন্ধুসভা।