হাফেজ ক্বারী মাওলানা কেরামত আলী

পবিত্র কোরআনে আল্লাহ পাক ইরশাদ করেছেন, হে মুমিনগণ! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেভাবে ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর। যাতে করে তোমরা মোত্তাকি এবং সংযমী হতে পারো (সুরা বাকারা,আয়াত-১৮৩)।

পবিত্র রমজান মাস সংযমের মাস। রমজান মানুষকে সংযমের শিক্ষা প্রদান করে। পবিত্র রমজান মাসের আগমনে মুমিন বান্দার হৃদয় সংযমী হয়। আত্মসংযমের অনিন্দ্য এক আভায় ছেয়ে যায় মন। পুলকিত হয় হৃদয়-আত্মা। গোটা পরিবার-পরিবেশব্যাপী স্বর্গীয় শান্তি ও সংযমের বার্তা নামে। নিজে থেকেই সরস হয় মন। আমলি হয়ে ওঠে মানবাত্মা।

আল্লাহ মহানের সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে সব ধরনের অন্যায়, খারাপ কাজ, গুনাহ, ঠকবাজিসহ সব ধরনের খারাপ কাজ এবং কাজের চিন্তাভাবনা ও মানসিকতা ত্যাগ করা উচিত এ মাসে। সব ধরনের লোভ-লালসা থেকে সংযমী হওয়া উচিত। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ মহান রোজার হুকুম প্রদানের উদ্দেশ্য বর্ণনা করতে গিয়ে স্পষ্টভাবে বলেছেন, আমি তোমাদের সংযমী হওয়ার জন্য রোজার আহকাম ফরজ করেছি।

সুতরাং এ কথা অকপটে স্বীকার করতে হবে যে সংযম অবলম্বন করা বা সংযমী হওয়া রমজানের মৌলিক শিক্ষার অন্যতম। পবিত্র রমজান মাস উপলক্ষে সংযম অবলম্বন করার মধ্যে প্রত্যেক মুসলমানের পারলৌকিক ও ইহলৌকিক সফলতা নিহিত রয়েছে। রয়েছে সামাজিক বিভিন্ন উপকারিতা। তাই আমাদের উচিত, অন্যান্য মাসে যেসব কাজ খুব সহজে এবং হালকা মনে করে করি অথবা নিজেদের অভ্যাস হিসেবে পালন করি, পবিত্র রমজান মাসে সেসব কাজ থেকেও বিরত থাকা উচিত। আর এই বিরত থাকাই সংযম।

সংযম বলতে কী বোঝায় : সংযম শব্দের ব্যাখ্যা হলো বিরত থাকা বা সংবরণ করা। সব ধরনের অন্যায় ও অনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকার পাশাপাশি সাধারণ সময় অভ্যাস ছিল এমন বিভিন্ন কর্মকাণ্ডকে ত্যাগ করাই সংযমের তাৎপর্য বা ব্যাখ্যা। ইমাম ইবনে হাম্মাম আল-সাউদ সংযমের ব্যাখ্যা প্রদান করতে গিয়ে বলেছেন, সাধারণ সময় যেসব কাজ একজন মানুষ অভ্যাসে, হালকা মনে করে, বিনোদন বা মনোরঞ্জনের জন্য বা আরো বিভিন্ন উদ্দেশ্যে করে থাকে- এমন সব কাজকে ত্যাগ করাকেই মূলত সংযম বলা হয়।

অন্যত্র আল্লামা কাজী সানাউল্লাহ পানিপথি (রহ.) বলেছেন, সব ধরনের খারাপ কাজ বা অভ্যাস ত্যাগ করার নামই কেবল সংযম নয়; সংযমী হওয়ার মূল উদ্দেশ্য হলো- এ মাসে আল্লাহ মহানের সব আদেশ-নিষেধ হুবহু মান্য করা এবং আত্মিক শক্তির উন্নয়ন সাধন করা।

মানুষের জীবনে পানাহার ও স্ত্রী সম্ভোগ- এই তিনটি চাহিদা খুবই গুরুত্বপূর্ণ চাহিদা। মানবজীবনে গতি ও স্থিতিশীলতা নির্ভর করে মানুষের এসব চাহিদার ওপর। আর এই তিনটি চাহিদার প্রতি রয়েছে মানুষের ব্যাপক আকর্ষণ বা আসক্তি। পবিত্র রমজান উপলক্ষে এ তিনটি চাহিদা সুনিয়ন্ত্রিতভাবে ব্যবহার করার নামই সংযম বা সংযমী হওয়া।

রোজার দিনে সংযমের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে কতক আলেম-ওলামা বলেছেন, সুপ্রবৃত্তি এবং কুপ্রবৃত্তি দুটি স্বভাবের সমন্বয়ে গঠিত মানবাত্মা। মানবাত্মার এই দুটি স্বভাবের সুশীল-সঠিক ব্যবহার বা নিয়ন্ত্রণ করাকে সংযম বলা হয়। অর্থাৎ সুপ্রবৃত্তির উন্নয়ন, বিকাশ এবং উৎকর্ষ সাধন করা আর কুপ্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ ও পরিত্যাগকরণ প্রক্রিয়াকে সংযম থাকা বা সংযমী হওয়া বলা হয়।

রমজানে কেন সংযমী হব : পবিত্র রমজানের উদ্দেশ্যের সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয় সংযম অবলম্বন করা বা সংযমী হওয়া। পবিত্র কোরআনে যাকে মোত্তাকি হওয়া বলে প্রকাশ করা হয়েছে, সংযমহীন রোজা পালন একেবারেই অর্থহীন। এককথায় বলতে গেলে, সংযমহীন রোজা পালন পারলৌকিক প্রতিদান প্রদানের প্রতিশ্রুতির আওতাভুক্ত নয়। আল্লাহ মহানের দরবারে এ রকমের রোজার কোনো গ্রহণযোগ্যতা নেই। কারণ রমজানের রোজা ফরজ করার কথা বলতে গিয়েই আল্লাহ মহান স্পষ্টভাবেই বলেছেন, আর এই রোজা এ জন্য যে যাতে করে সংযমী হতে পারো তোমরা। সুতরাং রোজা যে জন্য ফরজ করা হয়েছে তা ঠিক না থাকলে রোজা ফরজ করার মূল উদ্দেশ্যই বিঘ্নিত হবে। আর কোনো আমলে মূল উদ্দেশ্য যখন বিঘ্নিত হয়, তখন সে আমলের প্রতিদান-প্রদান প্রতিশ্রুতি বিঘ্নিত হওয়াই স্বাভাবিক। এ জন্য আমাদের উচিত, পবিত্র রমজান মাসের রোজা পালনের মূল উদ্দেশ্য জেনে সংযমের সঙ্গে রোজা পালন করা।

সংযমের প্রশিক্ষণ : এই মাস সংযমের প্রশিক্ষণের মাস। খাবার চাহিদা, পান করার চাহিদা, যৌন চাহিদাসহ মানুষের নানা চাহিদা বা আবেদনকে সুনিয়ন্ত্রিতভাব
ব্যবহার করার শিক্ষা প্রদান করে পবিত্র এই মাস। পরিমিত খাবার গ্রহণ, নির্দিষ্ট পরিমাণ বিশ্রাম এবং রুটিন মতো জীবন-যাপন করার উত্তম প্রশিক্ষণই এই রমজান। মানুষের যেকোনো প্রকার চাহিদাকেই এই মাসে সংযমের দৃষ্টিতে দেখতে ও পালন করতে আদেশ প্রদান করা হয়েছে এবং এই সংযমের আদেশ কেবল এই একটি মাসের সীমানায় সীমাবদ্ধ নয়; এই এক মাস সংযমের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে বাকি ১১ মাস সে সংযমের প্রয়োগ ঘটাতে হবে।

সহমর্মিতার মাস রমজান : একাধারে সহমর্মিতার অনন্য সময় পবিত্র রমজান। এ সময় কোনো রোজাদারকে ইফতার করানো বা অন্য কোনো উপায়ে সাহায্য-সহযোগিতা করাকে আল্লাহ মহান অন্য সময়ের তুলনায় অধিক সওয়াব প্রদান করার প্রতিশ্রুতি প্রদান করেছেন। রমজান মাস ছাড়া অন্য কোনো সময় একজন অসহায় ব্যক্তিকে সাহায্য করার মাধ্যমে যে সওয়াব অর্জিত হয়, রমজান মাসে সে সওয়াব সত্তর গুণ বেশি হয়। এ জন্যই রমজান মাসকে সহমর্মিতার স্বর্ণপ্রহর বলা হয়ে থাকে।

তাই আমাদের উচিত, এ মাসে অন্যদের সাহায্য-সহযোগিতা বেশি করা। আবার এই ভেবে অন্য সময় সাহায্য বন্ধ না করা যে রমজান এলে সব সাহায্য-সহযোগিতা একসঙ্গে করব। যখন যে পরিমাণ সম্ভব হবে, তখন সে পরিমাণ ভালো কাজ করা উচিত।

আল্লাহ পাক আমাদের সকলের সহায় হোন, আমিন!