মোহাম্মদ আশরাফুল হক

সিনিয়র বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বিএফআরআই ও পিএইচডি ফেলো।

মানুষের মতোই কিছু আবেগ অনুভূতি ভাগ করতে পারে তিমিরা। যদিও তারা মানুষের মতো কথা বলতে পারে না। মানুষরা হল ম্যামাল্স বা স্তন্যপায়ী প্রাণী; যারা বাচ্চাদের বুকের দুধ পান করায়। তিমিরাও তাদের বাচ্চাদের বুকের দুধ পান করায়। স্ত্রী তিমির শরীরের নাভি ও লেজের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত যৌনিপথের দুইপাশে দুটি লোব থাকে, সেই লোবদুটোই বাচ্চা জন্মদানের পর স্তনের মতো কাজ করে। তিমিদের শরীরের এই অংশকে বলে মেমি। বাচ্চারা সেখান থেকে চুষে দুধ পান করে। তবে তিমিরা ম্যামাল্স শ্রেণীভূক্ত হলেও তারা জলজ বা জলে অভিযোজিত হওয়া স্তন্যপায়ী প্রাণী। তাই তাদের আলাদা একটি বর্গ করা হয়েছে যার নাম সিটাসিয়ান। তিমি, ডলফিন ও পরপইস সিটাসিয়ান বর্গভূক্ত। গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটল (খ্রি: পূ: ৩৮৪-৩২২) তিমি জাতীয় প্রাণীর অন্যতম প্রাথিমক সমীক্ষক ছিলেন। সুইডিস জীববিদ লিনিয়াস (Linnaeus) তিমি ও ডলফিনকে প্রথম স্তন্যপায়ী প্রাণী হিসেবে শনাক্ত করেন। তিমি জাতীয় প্রাণি Mammalia শ্রেণির Cetacea বর্গভুক্ত একদল জলচর স্তন্যপায়ী প্রাণি। বর্গটি Odontoceti ও  Mysticeti নামের দুটি উপবর্গে বিভক্ত। প্রথম উপবর্গে ৭২ টি ছোট আকারের তিমি, ডলফিন ও পরপয়েজ এবং দ্বিতীয় উপবর্গে ১০ প্রজাতির ছাঁকাখাদ্যভুক (Filter feeder) বৃহৎ তিমি অর্ন্তভুক্ত। তারা মূলত মুখের মধ্যে চিরুনির মতো বলিন প্লেট দিয়ে পানি থেকে খাবার ছেকে খাদ্য গ্রহণ করে। আর বাকি তিমিগুলোর দাঁত আছে। বাংলাদেশে ১২ প্রজাতির সিটাসিয়ান বা জলজ স্তন্যপায়ী প্রাণী রয়েছে। যার মধ্যে চার প্রজাতির তিমি, ৭ প্রজাতির ডলফিন ও এক প্রজাতির পরপইস দেখা যায়।

বাংলাদেশে থাকা চার প্রজাতির তিমির মধ্যে মাত্র একটি প্রজাতির তিমি হল দাঁতবিহীন বা বলিন তিমি।

তিমিদের মধ্যে আকারে সবচেয়ে বড় হয় নীল তিমি। বঙ্গোপসাগরে নীল তিমি নেই। আছে ব্রাইড’স তিমি, স্পার্ম হুয়েল বা শুক্রাণু তিমি, হাম্পব্যাক তিমি এবং ফল্স কিলার তিমি। কক্সবাজারের হিমছড়ি সৈকতে চলতি মাসে উদ্ধার মৃত তিমি দুটি ব্রাইড’স হুয়েল জাতের বলে ধারণা করা হচ্ছে।

বিজ্ঞানে ধারণা করা হয়, তিমিসহ পৃথিবীর সকল স্তন্যপায়ী প্রাণীর প্রথম উদ্ভব ডাঙায় ঘটেছিল। পরবর্তীতে তাদের পশ্চাৎপদ দুটির বিলুপ্তি ঘটে এবং ডাঙায় চলাচলের ক্ষমতা হারিয়ে সমুদ্রে অভিযোজিত হয়। এরা মানুষের মতোই উষ্ণরক্ত বিশিষ্ট প্রাণী। চর্বিযুক্ত মোটা চামড়ার সাহায্যে তিমিজাতীয় প্রাণীরা শরীরের নির্দিস্ট তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে। তিমিসহ জলজ স্তন্যপায়ী প্রাণীরা মাছের মতো ফুলকার সাহায্যে নয়, ফুসফুসের সাহায্যে শ্বাস-প্রশ্বাস চালায়। যেহেতু ফুসফুসের মাধ্যমে পানির নীচে শ্বাস নেয়া সম্ভব নয়। তাই তারা শ্বাস নেয়ার জন্য কিছুক্ষণ পরপর পানির উপরে উঠে আসে। তারা মাথার উপর একটি বা দুটি ছিদ্র দিয়ে শ্বাস নেয়, যাকে ‘Blow hole, ব্লো-হোল’ বলা হয় ।

তিমিরা মানুষের মতোই কিছু আবেগ অনুভূতি ভাগ করতে পারে। তবে তার ধরন বা মাধ্যম আমাদের মতো নয়। তারা মানুষের মতো কথা বলতে পারে না। তারা একে অপরের সাথে যোগাযোগ করে শব্দ তরঙ্গের মাধ্যমে। এরা মাথার সামনের দিকের মেলন নামের একটি অঙ্গের সাহায্যে প্রতিধ্বনি তৈরী করে বা ইকোলোকেশনের (Echolocation) মাধ্যমে আশেপাশের বস্তুকে নিখুঁতভাবে উপলব্দি করতে পারে এবং অন্যদের সাথে যোগাযোগ করতে পারে। এ পদ্ধতিতে বাচ্চারাও সহজেই মায়ের ‘ডাক’ বুঝতে পারে। তাদের রয়েছে সোশ্যাল কেয়ারিং বা সামাজিক দায়বদ্ধতা আচরণ। অসুস্থ বা বিপদগ্রস্ত সঙ্গীকে রেখে কখনও তারা পালিয়ে যায় না। তারা সঙ্গীর মৃত্যুতে শোকগ্রস্ত হয় এবং দলে দলে সৈকতমুখী হয়ে নিজেদের নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। সিটাসিয়ানদের এই আচরণ ২ হাজারের বেশি সময় ধরে মানুষের কাছে রহস্যজনক।

সমুদ্রে তিমিদের মারা যাওয়ার একটি অন্যতম প্রধান কারণ হল ডিকমপ্রেশন সিকনেস। যেটি মানুষের মধ্যেও দেখা যায়, বিশেষ করে স্কুবা ডাইভার বা ডুবুরীদের ক্ষেত্রে। বাতাসে অক্সিজেনের পাশাপাশি প্রায় ৭৮ ভাগ নাইট্রোজেন থাকে, যা মানুষ ও তিমিসহ সকল স্তন্যপায়ী প্রাণীই গ্রহণ করে থাকে। আমরা জানি যে, সমুদ্রের তলদেশের যত নীচে যাওয়া যায় পানির চাপ ততই বাড়তে থাকে। এই চাপে যে কোন প্রাণীর শরীরের শিরা উপশিরায় নাইট্রোজেন গ্যাস ঢুকে যায়। ঠিক যেভাবে কোমল পানীয় এর সাথে কার্বন ডাই অক্সাইড গ্যাস মিশে থাকে, ঠিক সেভাবে প্রাণীদের রক্তের সাথে মিশে যায় নাইট্রোজেন। পানির নীচে জলজ স্তন্যপায়ী প্রাণী বিশেষ করে তিমিদের ক্ষেত্রে এ পর্যন্ত বিষয়টা খুব স্বাভাবিকভাইে ঘটতে থাকে। কিন্তু বিপদ ঘনিয়ে আসে তখন, যখন তিমিরা দ্রুতবেগে ছুটাছুটি করে। তিমিরা যখন দ্রুতবেগে গভীর পানির নীচ থেকে উপরে উঠে আসে, তখন হঠাৎ নি¤œচাপে নাইট্রোজেন গ্যাস সারা শরীর থেকে ছিটকে বাইরে বেরিয়ে আসতে চায়; হুট করে কোন কোমল পানীয় এর বোতলের ছিপি খুললে যেমনটা আমরা দেখতে পাই। সমুদ্রের গভীর পানি থেকে দ্রুতগতিতে পানির উপর দিকে আসতে থাকলে অনেক সময় এভাবে আচমকা ফুসফুস ও রক্তনালিকা ফেটে তিমিদের মৃত্যু হতে পারে। স্কুবা ডাইভারদের ক্ষেত্রেও সাগরে একই ধরনের ঘটনা ঘটে থাকে। এ ঘটনার নাম ডিকমপ্রেশন সিকনেস (Decompression sickness)।