ছবিঃ করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি অবস্থায় হুইল চেয়ারে বসে বিজয় চিহ্ন দেখান মেহেরুন্নেছা পুতুল।

ওমর ফারুক হিরুর :
বিজয়ের চিহ্ন দেখানো ছবির মানুষটি সম্পর্কে আমার বড় আম্মা (জেঠি)। নাম মেহেরুন্নেছা পুতুল (৫৫)। তাঁর পাশে দাঁড়ানো যুবকটি আমার ছোট ভাই ফরহাদ হোসেন জুয়েল। বড় আম্মা হলেন কক্সবাজার জেলা আওয়ামীলীগের সদস্য, জেলা আওয়ামীলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক এবং দৈনিক আপনকণ্ঠ পত্রিকার সম্পাদক আমার জেঠা মোহাম্মদ হোসাইনে’র স্ত্রী। করোনায় আক্রান্ত হয়ে তিনি গত ২৯ এপ্রিল ভোর সাড়ে ৪ টায় লাইফ সাপোর্টে থাকা অবস্থায় মৃত্যু বরণ করেণ। হাসপাতালে ভর্তির পর পরিবারের লোকজনকে বিজয়ের চিহ্ন দেখিয়ে বুঝাতে চেয়েছিলেন, কোন ব্যাপারনা। সুস্থ হয়ে আবার সবার মাঝে ফিরে আসবেন। হয়ত তিনি নিজেও বুঝতে পারেননি কদিন পর’ই তিনি মারা যাবেন। বিজয়ের চিহ্ন দেখানো মানুষটি মৃত্যুর কাছে পরাজিত হলেও তিনি ছিলেন সত্যিকারের একজন বিজয়ী নারী। ছিলেন সফল রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের যোগ্য স্ত্রী, যোগ্য সন্তান বিনির্মাণের সফল মা, পুরো পরিবারের শৃংখলা বজায় রাখা দায়িত্ববান চমৎকার এক গৃহীনি, পিতাহীন ভাই-বোনের দায়িত্ব নেওয়া বটবৃক্ষ, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এবং গণমাধ্যম কর্মীদের কাছে ছিলেন শ্রদ্বেয় ভাবি অথবা আপা। তিনি ছিলেন মায়ের যতেœ লালন করা বড় আম্মা।
বঙ্গবন্ধুর আর্দশে গড়া স্বামী মোহাম্মদ হোসাইন সফল রাজনীতিবিদ হওয়ার পেছনে ছিল তার সার্বিক সহযোগিতা, ত্যাগ ও পরিশ্রম। শুধু স্বামী’ই নন ততকালিন কক্সবাজার ছাত্রলীগের কান্ডারী খ্যাত প্রয়াত নেতা নুরুল মাসুদ মানিক ছিলেন মেহেরুন্নেছা পুতুলের ছোট ভাই। তিনি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ২০১৪ সালের অক্টোবরের ০৬ তারিখ মারা যান।
রাজনৈতিক পরিবারের এই মহিয়সি নারীর ব্যাপারে কক্সবাজার সদর আওয়ামীলীগের সভাপতি এবং সাবেক ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতি মোহাম্মদ আবু তালেব বলেন, মেহেরুন্নেছা পুতুল ছিলেন এক মহিয়সি নারী। একজন সফল রাজনীতিবিদের স্ত্রী’র যেসব গুন থাকা দরকার তার সবই ছিল তার মাঝে। দলের ছেলেরা কতশত বার তার হাতের রান্না খেয়েছে তার কোন হিসাব নেই। তিনি কখনো বিরক্ত হতেননা। সব মিলিয়ে তিনি ছিলেন এক যোগ্য ভাবি। যোগ্য আপা।
জেলা আওয়ামীলীগের সদস্য রাশেদুল ইসলাম বলেন, ব্যক্তিগতভাবে তিনি আমার ফুফাত বোন হলেও রাজনৈতিক নেতার স্ত্রী হিসেবে তিনি ছিলেন একজন যোগ্য নারী। তিনি খুবই সহজ-সরল একজন হাস্যোজ্জল মানুষ। আপা আমাদেরকে সব সময় স্নেহের চোখে দেখতেন। সহযোগিতা করেছেন আওয়ামীলীগের রাজনীতিতে।
গণমাধ্যম কর্মীদের মাঝে তিনি ছিলেন পছন্দের বড় আপা অথবা ভাবি। তার হাতেই কক্সবাজারের স্থানীয় দুইটি দৈনিক পত্রিকার যাত্রা শুরু হয়। বড় আব্বা ছিলেন দৈনিক আজকের দেশবিদেশ পত্রিকার সাবেক সম্পাদক এবং দৈনিক আপনকণ্ঠ পত্রিকার বর্তমান সম্পাদক। এরই মধ্য দিয়ে বড় আম্মা দুই পত্রিকার’ই ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে ছিলেন। সাংবাদিক মহল ছিলেন তার খুবই ¯েœহের।
বড় আম্মার মৃত্যুর পর বাংলাদেশ টেলিভিশনের কক্সবাজার প্রতিনিধি ও কক্সবাজার সাংবাদিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক সিনিয়র সাংবাদিক জাহেদ সরওয়ার সোহেল ফেসবুকে পোস্ট করেন ‘অনেক ঋণ, অনেক স্মৃতি, অনেক ¯েœহের বৈভব দিয়ে আমাদের আগলে রাখতেন, করোনায় না ফেরার দেশে সেই অভিভাবক দৈনিক আপনকণ্ঠের সম্পাদক শ্রদ্ধেয় মোহাম্মদ হোসাইন মামার সহধর্মিনী।’
দৈনিক কক্সবাজার পত্রিকার স্টাফ রিপোর্টার এম. বেদারুল আলম বলেন, তাঁকে নিয়ে অনেক স্মৃতি, অনেক দায়। মায়ের স্নেহ যার কাছে সব সময় পেয়ে এসেছি। আমি একা নয় সাংবাদিক মানিক ভাই (চ্যানেল আই), মাবুদ ভাই (বর্তমান চেয়ারম্যান), বাংলা ভিশনের খোকন ভাই, উখিয়া প্রেসক্লাবের সভাপতি আনোয়ার ভাই, হাসান ভাই (হিমছড়ি), দীপু দা (ইউএনবি), শফি ভাই (যুগান্তর)আমরা যারা সে সময় দেশবিদেশ পত্রিকায় কাজ করতাম সকলে মাতৃসম ভাবির কাছে ঋণি। দুপুরে কেউ না কেউ ভাবির রান্না খেয়েছি। একটি বিশেষ স্মৃতি আমার আজীবন মনে থাকবে। দেশবিদেশ পত্রিকা ইয়াহিয়া সাহেবকে বিক্রি করার পর সপরিবারে হজ্জ্বে যাওয়ার সময় আমার উপর আস্থা রেখে পুরো আলিফ ম্যানশন (বতর্মানে আপন টাওয়ার) আমাকে দেখভালের দায়িত্ব দেন। হজ্জ্ব শেষে দেশে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে নিজ পুত্রের মত যে আদর। আল্লাহ পরম শ্রদ্ধাষ্পদ ভাবিকে জান্নাতুল ফেরদৌসের বাসিন্দা হিসাবে কবুল করুন।
পরিবারের লোকজনের কাছে ছিলেন তিনি এক অতুনলীয় মানুষ। সবার সাথে হাস্যোজ্জল থাকতেন। পারত পক্ষে কাউকে কষ্ট দিতেননা। মায়ের ¯েœহ দিয়ে শত কষ্টের মাঝেও সবাইকে আগলে রেখে সুখে থাকতে চাইতেন।
বড় আম্মার দেবর মোহাম্মদ ইছমাইলের স্ত্রী ফরিদা ইয়াছমিন অর্থাৎ আমার মা’ বলেন, সর্ম্পকে তিনি আমার ভাবি হলেও তিনি ছিলেন আমার বড় বোনের মত। আমরা দুই জন অনেক সময় বান্ধবীর মতও ছিলাম। সংসারের নানা বিষয় নিয়ে একে অন্যের সাথে শেয়ার করতাম। ভাবির সাথেই আমার বেশি সময় কেটেছে। ভাবির মৃত্যুতে আমাদের পরিবার অনেক বড় কিছু হারিয়েছে। যা কখনো পূর্ণ হবেনা।
আরেক দেবর এডভোকেট মহিউদ্দিন জানান, উনি অমায়িত ও মিষ্টি ভাসীনি ছিলেন। তিনি আমাদের বড় ভাবি হলেও মাতৃসুলভ আচরণের জন্য সবার কাছে প্রিয় ও শ্রদ্ধার ছিলেন। উনার মৃত্যুতে আমরা মর্মাহত। উনাকে আল্লাহ জান্নাতুল ফেসদৌস দান করুক।
বড় আম্মার প্রিয় ননদ জেবুন্নেছা জেবুকে যখন প্রশ্ন করা হয় আপনার ভাবি মেহেরুনেছাকে কিভাবে পেয়েছেন, তিনি কান্না করতে করতে একটাই কথা বলেছেন, সেটি হচ্ছে, তিনি আমার ভাবি হলেও ছিলেন আমার মায়ের মত। মায়ের ¯েœহ দিয়েই আমাদের বড় করেছেন।
বড় আম্মার ছয় ভাই-বোন (মেহেরুন নাসিম (নাছিমা), প্রয়াত নুরুল মাসুদ মানিক, আতিকুল ইসলাম, আফরোজা নাজিম আপপু, এরশাদুল ইসলাম।)। তাদের সবার বড় হচ্ছেন মেহেরুন্নেছা পুতুল। তাদের কাছে তিনি ছিলেন দায়িত্ববান অভিভাবক। বট বৃক্ষের মত।

বড় আম্মার ছোট বোন মেহেরুন নাসিম প্রকাশ নাছিমা বলেন, আমাদের বড় বোন অসাধারণ দায়িত্ববান একজন মানুষ ছিলেন। ভাই-বোনের প্রতি ছিল তাঁর ভীষণ মায়া। অসাধাারণ আন্তরিক ছিলেন। আমাদের কাছে তিনি বট বৃক্ষের ছায়ার মত ছিলেন। বড় বোনের মৃত্যুতে তারা খুবই আহত।
ছোট ভাই আতিকুল ইসলাম বলেন, ওনার মত বড় বোন পাওয়া সৌভাগের ব্যাপার। আমাদের সফলতার পিছনে তার দোয়া, ভালবাসা আর সহযোগিতা ছিল সবসময়। আল্লাহ যেন তাকে বেহেস্ত নসিয়ত করেন।
বড় আম্মার ছোট বোন আফরোজা নাজিম আপপু জানান, আমি যখন ক্লাস টু-তে পড়ি তখন বড় আপার বিয়ে হয়। তিনি আমার কাছে শুধু একজন বড় আপাই ছিলেননা ছিলেন মায়ের মত। মায়ের ¯েœহ-ভালবাসা দিয়ে আমাদের বড় করেছেন। তাকে নিয়ে বলার কিছু নেই। তাকে হারিয়ে যেন আমি আমার মা’কে হারিয়েছি।
মেহেরুনেচ্ছা পুতুলের চার সন্তান আমিনাতুল মুইম্মাহ্ (মাজবিন), মোতাকাব্বির হোছাইন (ইয়াছিন), মারুফ ইবনে হোছাইন ও আমিনাতুল মুরসালিন (মিম)। মাকে হারিয়ে তারা সবাই শোকাহত। ছোট বোন আমিনাতুল মুরসালিন মিম এর ফেস বুকে দেওয়া একটা কথাই যেন সব কষ্ট প্রকাশ পায়। ওখানে লিখা ছিল ‘হারানোর আর কিছুই বাকি নেই’।

বড় আম্মার একমাত্র মেয়ে’র (আমিনাতুল মুইম্মাহ্) জামাই ব্যারিস্টার আবুল আলা ছিদ্দিকী বলেন, ‘একজন মা হিসেবে, শাশুড়ী হিসেবে তিনি ছিলেন অসাধারণ। হাসিমুখে আথিতিয়তা ছিলো তাঁর অসাধারণ চরিত্রের অংশ।
বড় আম্মার ব্যাপারে বড় আব্বা বলেন, আমার অর্ধাঙ্গীনি ছিলেন আমার জীবনের অনুপ্রেরণা, সহযোগিতা আর এগিয়ে চলার সাহস। রাজনৈতিক আর ব্যবসায়ীক জীবনে আসা হতাশা আর চাপে কখনো ভেঙ্গে পড়তে দিতনা। অনেক সময় ব্যস্থতার কারণে সংসারের খবর নিতে না পারলেও সে ঠিকই সব সামলে নিত। নানা কাজে গ্রাম (পেকুয়া) থেকে আসা আত্মীয়-স্বজনদের সেবা থেকে শুরু করে সন্তানদের লেখা-পড়া সহ সংসারের সবকিছু সামলে নিত একাই। সবার মুখে হাসি ফুটাতে অনেক কষ্ট সহ্য করে নিজেকে হাস্যোজ্জল রাখত। তাকে হারিয়ে আমি কি হারিয়েছি তা আমি প্রকাশ করতে পারবনা। শুধু বলব সবাই আমার স্ত্রী’র জন্য দোয়া করবেন। উনাকে যেন আল্লাহ জান্নাতুল ফেসদৌস দান করেন।
বড় আম্মাকে নিয়ে আমি শুধু একটাই বলব, তিনি না হলে হয়ত আমি এই পেশায় আসতে পারতাম না। তিনি শুধু আমাকে এই পেশাই উপহার দেননি। দিয়েছেন মায়ের মত ¯েœহ, ভালবাসা আর মমতা। আমার মায়ের পরে আমার জীবনের বেশি সময় কেটেছে বড় আম্মার সাথে।
বড় আম্মা দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ্য ছিলেন। তিনি গত ১৯ এপ্রিল করোনায় আক্রান্ত হয়ে প্রথমে ফুয়াদ আল খতিব হাসপাতালে ভর্তি হন। শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে ওখান থেকে সদর হাসপাতালে নেওয়া হয়। পরে আইসিইউতে ৪ দিন লাইফ সার্পোটে থেকে ২৯ এপ্রিল ভোর ৪ টা ৩০ মিনিটে মৃত্যু বরণ করেন। বড় আম্মার ইচ্ছা অনুযায়ী তাকে কবর দেওয়া হয় শ^শুর বাড়িতে (পেকুয়ার উপজেলার বারবাকিয়া পূর্ব জালিয়া কাটা আলী’র বাড়ি)। তাকে কবর দেওয়া হয় শ^শুরদের পাশে।
##
ওমর ফারুক হিরু, কক্সবাজার।