১ম কিস্তি)
( হিসেম মিলহেমের লিখা এই আর্টিকেলটিকে পৃথিবীর সেরা প্রবন্ধ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। এই প্রথম এটি ভাষান্তর হয় শুধুমাত্র কক্সবাজারনিউজ সিবিএন এ। করেছেন এম,ডি ম্যাক্স)।
সাল ২০১৬, তারিখ ডিসেম্বরের ১১, গত অর্ধ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ সিরিয়ার পরিচিত পাবলিক ফিগার জালাল আল আজম বারলিনে মারা যান। তার বয়স হয়েছিল ৮২।
তিনি এবং তার মত অনেক নির্বাসিত সিরিয়ান দূর থেকে জীবদ্দশায় দেখে গিয়েছেন কিভাবে ধীরে ধীরে বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত আলেপ্পো শহরটি তাদের চোখের সামনে ধ্বংস হয়ে গিয়েছে।
যে লোকটি গত অর্ধ শতাব্দি আরব অত্যাচারের বিরুদ্ধে , আর্থসামাজিক শোষনের বিরুদ্ধে, বৈষম্যের আর ধর্মান্ধ্যতার বিরুদ্ধে লড়াই করে গিয়েছেন, তার সামনে এই দৃশ্য খুবই নিষ্ঠুর। আলেপ্পো ছিল একসময়ের সিরিয়ার প্রাচীন এবং বিখ্যাত ‘মণি’ শহর । যে বির্তকিত প্রশ্নটি ‘ কি হল আরব বিশ্বে ‘ এবং এর উপর বুদ্ধিজীবিদের বির্তক থেকে শুরু করে তার একাকীত্বের মৃত্যু শয্যার দিনগূলি পর্যন্ত আজম ছিলেন আরবদের অন্ধকারে নিমজ্জিত হওয়ার যে দৃশ্য, তিনি তার অকপট স্বাক্ষ্য।
প্রায় পঞ্চাশ বছর পরে আজম ও আরব বুদ্ধিজীবিরা আপ্রান্ত চেষ্টা করে গেছেন আরবের রাজনীতিক সুশৃঙ্খলা বিনির্মাণ করতে, চেয়েছেন আদিম ধর্মীয় গোড়াপত্তন থেকে বের করে আনতে আর বদ্ধ সামাজিক জীবন থেকে সরে আসতে, কিন্তু আরবরা আরো অন্ধকারের গভীর অতলে হারিয়ে গেল। রাষ্ট্রীয়, রাজনৈতিক এবং জ্ঞানের নির্জনতা ডামাস্ক, আলেপ্পো,বাগদাদ, মসুল,কায়রো,আলেকজান্ডারিয়ার মত অনেক আরব শৈল্পিক নগরীর পতন ঘটেছে, যেখানে বৈরুত কিছুটা টলমলে অবস্থায় টিকে আছে। অথচ এ শহর গুলো একসময় শতাব্দী ধরে শিল্প, সাহিত্যের দিক দিয়ে সমৃদ্ধ ছিল, অপূর্ব যোগাযোগ রক্ষা করে চলত মুসলিম, খ্রিষ্টান, ইহুদী, দ্রুজ,আরব, কুর্দি, আশিরান্স,সিরাকাসিনসদের সাথে।
গ্রীক, আরমানিয়া আর ইতালিয়ান সমাজের সাথে হত জ্ঞান চর্চা। বৈরুত আর আলেকজান্ডারিয়া, বাগদাদ , ডামাস্ক আর আলেপ্পোর মত শহর আর বন্দর নগরীতে গড়ে উঠেছিল স্থিতিশীল অসাম্প্রদায়িক সমাজ ব্যবস্থা।
যখন তরুণ বয়সে বৈরুতের রাস্তায় রাস্তায় হাটতাম তখন আরবি,ফ্রেঞ্চ ইংরেজী, আরমানিয়ান,গ্রীক,কুর্দিস সব ভাষার বৈচিত্র্য স্বাদ নিতাম। কিন্তু স্বীকার করতে হয় যে, এই উদীয়মান সাম্প্রদায়িকতার ও সমস্যা দেখা গিয়েছিল,কারণ , অসাম্য ও অনিশ্চয়তা।গ্রামীন পশ্চাৎভুমিতে তখন অজ্ঞ কৃষকদের বসবাস যারা দূর থেকেই এই শহর গুলোর প্রতি বিতৃষ্ণা পোষ করত। একজন তরুণ হিসেবে আমি দেখেছিলাম আমাদের মাঝে জেগে উঠা আগ্রহের আকষ্মিক পতন,তা হয়েছিল মুলত আরবদের মাঝে অবিশ্বাসের শুরু আর, আরবদের ছয় দিনের মাথায় ইস্রাইলীদের হাতে মিশর,সিরিয়া,জর্ডান এর ত্বরিত গতির পরাজয়।
এই যুদ্ধে মিসরের সিনাই উপদ্বীপ, সিরিয়ার গোলান হেইটস আর ফিলিস্তিনের ওয়েস্ট ব্যাংক চলে আসল ইস্রাইলের দখলে আর সেই সাথে মৃত্যু হল আরব ঐক্যজোটের যেটির স্বপ্ন বুনে ছিলেন তৎকালীন মিসরের প্রেসিডেন্ট গামাল আব্দুল নাসের।
কিন্তু অনেক আরব নিজেদের আড়াল দিলেন এই দোহাই দিয়ে যে পরাজয় নয় কিছটা অবস্থার অবনতি হয়েছে, অস্বীকার করলেন দুর্বল সামাজিক, সাংস্কৃতিক চর্চাকে।
অনেকেই বিশ্বাস করতে চাইলেন যে, ইস্রাইলের জয়ের পেছনে পাশ্চাত্যের সহযোগিতা আর কুমন্ত্রণা ভূমিকা রেখেছে আর ইস্রাইল হচ্ছে ‘কৃত্রিম একটি সত্বা’ যারা আরবের পূর্ব দিকে সাম্রাজ্যবাদ প্রতিস্থা করতে বদ্ধপরিকর।
আরবরা যে ই যুদ্ধে জিতবে এ ব্যাপারে তারা একেবারে নিশ্চিত ছিল। তখন আমার বয়স হয়েছিল ১৭ বছর, আর আমার স্পষ্ট মনে আছে কিভাবে আমার হৃদয় ক্ষতবিক্ষত হয়ে গিয়েছিল আর আমার ক্ষোভ গিয়ে পড়েছিল সেচ্চায় দায়িত্ব নেওয়া আরব বংশধরদের প্রতি।
পরাজয়ের পঞ্চাশ বছর পর যে ভংঘুর পৃথিবী আরবরা গড়েছে তা আজ গৃহযুদ্ধের ডামাডোলে, নেতৃত্বে অত্যাচারী আরব শাসক আর ভয়ংকর বৈদিশিক আর আঞ্চলিক লুটেরারা।
যে পুরাতন শহর গুলো একসময় অনেক আক্রমণ থেকে ঠিকে ছিল তা আজ ধ্বংশের শেষ প্রান্তে। সিরিয়া,ইরাক,লিবিয়া আর ইয়েমেনের বিদ্যালয়, হাসপাতাল,
ব্যাকারী,ফার্মেসী, মসজিদ, গির্জা আজ হোক সরকারী বাহিনী বা বিদ্রোহীদের হাতে নিষ্পেষেত।
লক্ষ লক্ষ অসহায়, নির্যাতিত মানুষ ঘর ছেড়ে আজ দেশান্তরি, হোক সেচ্ছায় বা হোক বাধ্য হয়ে, পাড়ি দিচ্ছে সব সলিল আর ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পরিণত হচ্চেন শরনার্থীতে। যেটির নাম হয়েছে এখন ‘ মধ্যপথ’ যেটির প্রবাহ মেডিটেরিনিয়ানের ভেতর দিয়ে, যার ঢেউ এর করাল গ্রাস আর অর্থলোভী,মানবপাচারকারী নৌকার মাঝির লোভ কেড়ে নিচ্ছে হাজারো শরনার্থীর জীবন।
একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে এসে যারা পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার মাত্র ৫% ছিল তারা আজ ৫০% শরনার্থী।
আজ আরবরা সবচেয়ে শক্তিশালী তিন নন আরবদের মাঝে হিমশিম খাচ্ছে, ইস্রাইল, তুরস্ক আর ইরান। সিরিয়া আর ইরাকে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, জাতিগত বৈষম্য, এক আরব পরিচয়ের ধারনার মৃত্যু ঘটিয়েছে, রাজনৈতিক, সামাজিক আর সাংস্কৃতিক, সেই সাথে কঠিন হয়ে গিয়েছে দুদেশের সমঝোতা।
যে মিশর ছিল একসময়ের পরাশক্তি, গত কয়েক দশক ধরে রাজনৈতিক ভাবে বিকলাঙ্গ হয়ে গিয়েছে, কিছুটা অর্থনৈতিক ভাবে ঠিকে আছে আরব কিছু দেশের সহযোগিতার উপর।
আস্ফালন কারী মিসরীয় সৈন্যরা ত সিনাই উপদ্বীপে কতৃত্য পর্যন্ত বজায় রাখতে পারছেনা। তারা ইস্রাইলের এয়ার ফোর্সের উপর নির্ভর করে যে এয়ার ফোর্স ১৯৬৭ সালের জুনের ৫ তারিখ তাদের সাথে যুদ্ধ করেছিল।
আরবদের সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসেবে ও কায়রো ব্যর্থ, কেননা এর কোন বিশ্ববিদ্যালয়, গবেষণা কেন্দ্র,ল্যাবরেটরি, প্রকাশনা, স্টুডিও, গ্যালারী,জ্ঞান,বিজ্ঞান বা শিল্পের উপর কোন কিছু অর্জন করতে পারেনি। বৈরুত, যেটি ছিল আমার শৈশবের উদার মরুদ্যান তাও নিঃশেষ হয়ে গিয়েছে অসৎ, দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনৈতিক সিস্টেমের কারনে যার নিয়ন্ত্রনে আছে, অসভ্য, বর্বর আর নির্মম আধা সামরিক শক্তি হিজবুল্লাহ।
এই গ্রুপটি পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ংকর যারা ইরানের বৈদিশিক স্বার্থে কাজ করছে, এটি মুলত বিখ্যাত অটোমান জানাসারিজের শিয়ায়ি রুপ।
( চলবে)….
আমরা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।