প্রসঙ্গ: বাংলাদেশের টিপ, সেন্টমার্টিন দ্বীপ!
একবার ভাবুন তো, পৃথিবীর ভয়ঙ্করতম একটি সমুদ্রের মাঝে ছোট্ট একটা দুই কিলো ব্যসার্ধের দ্বীপ, সেই দ্বীপে নেই আধুনিক কোন সুযোগ সুবিধা, নেই ঝড়-প্লাবন থেকে বাঁচার মত যুঁথসই কোন রসদ। এমনকি, পর্যাপ্ত খাদ্য সামগ্রীর মজুদ পর্যন্ত নেই! নেই প্লাবনে ছেয়ে গেলে পানযোগ্য পানির নিশ্চয়তাটুকুও! বাঁচতে হলে উত্তাল সমুদ্র পাড়ি দিয়ে খাবার সংগ্রহ করতে হবে নিয়মিত। ক’দিন পর পর ছোট্ট কাঠের তরীতে নিয়মিত সমুদ্র পাড়ি দিতে হবে বাঁচার রসদ জোগাড় করতে! তেমন একটি দ্বীপে বছর কয়েক পার করে দিতে পারবেন?
অনেকেই হয়তো বলবেন, পারবো। বলা সহজ। পারা সত্যিকার অর্থেই কঠিন। এমনই কঠিন যে, শীতে যখন উত্তাল সেই সমুদ্র মায়াবি নীলদিঘী’র রূপ ধারন করে, যখন দ্বীপ তার সবটুকু রূপ-রঙ মেখে স্বর্গীয় রূপে মুগ্ধতা ছড়ায়, তখনও মানুষ বড় বড় সামুদ্রিক জাহাজে চড়ে ঘুরতে গিয়ে তিন-চার দিন থাকার পর দ্বীপ থেকে বেরুতে হাসফাঁস করে। বছর তো দূরের কথা, মাস তো দূরের কথা, এক সপ্তাহ থাকাটাও বিরল গল্পের মত!
তেমনই এক ভয়ঙ্কর সামুদ্রিক দ্বীপ বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ, শতকের পর শতক ধরে বসবাস করছে সেন্টমার্টিনের মানুষ! ভাবা যায়! ঝড়-প্লাবন, বজ্র-মেঘের বিদ্যুৎ, সমুদ্রের ভয়ঙ্করতম চোখ রাঙানি সবকিছু তুচ্ছ করে অকুতোভয় সামুদ্রিক হৃদয়গুলো বেঁচে আছে মাতৃভূমির আঁচলে। এখন তাদের সেই মাতৃভূমির উপরও পড়েছে শকুনের চোখ!
বর্তমানে কারণে-অকারণে যখন খুশি পরিবেশের দোহায় দিয়ে সেন্টমার্টিনের অগ্রযাত্রা রূখে দিতে মরিয়া একটা শ্রেণী! অপার সম্ভাবনার এই দ্বীপ গিলে খেতে চতুর কৌশলে আগাচ্ছে আমলাও বণিকদের দল!
গত পর্যটন মৌসুম শুরুর আগে পর্যটন সচিব ঘোষণা করলো সেন্টমার্টিনে রাত্রি যাপন নিষিদ্ধ! এমনকি শত শত বছর ধরে বসবাস করা সেন্টমার্টিনের আদিবাসীদের উচ্ছেদ করে অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার প্রস্তাবও করা হয়! যার ভূমি থেকে তাকে উচ্ছেদ করার চেষ্টা! পরিবেশ প্রতিবেশের দোহায় দিয়ে বন্ধ ঘোষণা করলো মানুষের বিচরন, অপার সম্ভাবনার পর্যটন খাঁত। সেন্টমার্টিনে পর্যটন নিষিদ্ধ করা বা সীমিত পর্যটন করার আহবান করার কথা পরিবেশ ও জলবায়ূ মন্ত্রনালয়ের, সেই মন্ত্রনালয়ের পা ধরে হলেও পর্যটক যাওয়ার ব্যবস্থা করার কথা পর্যটন মন্ত্রনালয়ের। অথচ খোদ পর্যটন মন্ত্রনালয়-ই সেন্টমার্টিনের মত পর্যটন সেক্টর বন্ধ করতে পদক্ষেপ গ্রহণ করে! কী অদ্ভুত! কী হাস্যকর! কার কাজ কী, তারা করে কী! পর্যটন সেবীদের তুমুল আন্দোলনের মুখে ঠিকেনি মাথামোটা আহাম্মকদের সেই ভুল সিদ্ধান্ত।
অথচ- পর্যটন মন্ত্রনালয় কখনো পরিবেশ রক্ষার জন্যে দ্বীপে প্লাস্টিক পণ্য সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করলো না। দ্বীপের বর্জ্য সমূহ বাংলাদেশের মূল ভূ-খন্ডে আনার ব্যবস্থা করলোনা! নিষিদ্ধ করলোনা দ্বীপে হারহামেশা গড়ে উঠা ইট-পাথরের ঝঁঞ্জালে ভরা স্থাপনা নির্মাণ! খোঁদ স্থানীয় এমপি এবং নানান বাহিনি দ্বীপে ইট-পাথরের স্থাপনা নির্মানে ব্যস্ত। মূল সমুদ্র পাড়ে পুলিশের সুরম্য অট্টালিকা দেখলে তো মনে হবে গরীবের অটোমান সম্রাজ্য! সেসবে কারো চোখ নেই, শুধু পর্যটন নিষদ্ধ নিষিদ্ধ খেলায় মেতে ওঠে সবাই!
দেড়যুগ আগে নির্মিত সেন্টমার্টিনের একমাত্র জেটিও এখন কঙ্কাল মাত্র! গত মৌসুমেই অসংখ্য মানুষ সহ ধ্বসে পড়ার কথা। জোড়াতালির পল্টন লাগিয়ে কোনরকমে বেঁচে গেছে। অথচ জেলা পরিষদ নমীয় স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্টান দেড়যুগ ধরে কোটি কোটি টাকা টোল আদায় করে মোটাতাজা সেই জেটির কঙ্কাল বের করে পেলছে! কিন্তু তাদের একবারও মনে হয়নি এই জেটি সংস্কার করার কথা! কারোই মনে হয়নি… ফলশ্রুতিতে এবারের প্লাবনে পাকা ফলের মত ঠাস ঠাস ফেটে যাচ্ছে সমুদ্রের চড় খেয়ে! আর ক’টা দিন পর সম্পূর্ণ বিলিন হয়ে যাবে নিশ্চিত!
সেন্টমার্টিন বাসীর পক্ষে কেউ নেই আল্লাহ ছাড়া! এই সহজ সরল মানুষগুলো সমস্ত ঘূর্ণিঝড়, সাইক্লোনেও তাই নিজের মাতৃভূমিতেই আঁকড়ে থাকে। কোথাও যায়না মা’কে ছেড়ে। আল্লাজর উপর ভরসা করা ছাড়া তারা আর কারো সহায়তা কখনোই পাইনি। বরং দ্বীপবাসীর বন্ধু সেজে দ্বীপের মধু-লুটেছে নানান শ্রেণীর মানুষ! অথচ শুধু পর্যটনের জন্যে নয়, ভৌগোলিক কারণেও এই দ্বীপ বাংলাদেশের সামুদ্রিক সার্বভৌমত্বের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অসীম সম্ভাবনার এই দ্বীপের উন্নয়নে ইউনিয়ন পরিষদের সাধারণ বরাদ্ধ ছাড়া অন্য কোন উন্নয়ন বরাদ্ধ আসেনি কখনোই! অথচ হাতির ঝিলের দশভাগের এক ভাগ টাকা খরচ করে সেন্টমার্টিনকে বিশ্বের অন্যতম একটা পর্যটন স্পট হিসেবে গড়ে তুলা যেতো অনায়াসে।
শুধু অবহেলায় আর কত সম্ভাবনা নষ্ট করবেন? দ্বীপটাই যদি সমুদ্রে বিলিন হয়ে যায়, তখন পর্যটন তথা মানুষের বিচরন নিষিদ্ধ করে মিথ্যে বাহাদুরী কী নিয়ে দেখাবেন হে কর্তাবাবুরা?