নতুন করে সংঘাত

শহীদী সপ্তাহ পালনের আহবান

আবদুর রহমান খান

ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে বিমানবাহিনী ঘাঁটিতে সম্প্রতি ড্রোন পাঠিয়ে বিস্ফোরণ ঘটানো এবং সেনা ছাউনিতে ড্রোনের অনুপ্রবেশের রহস্য এক সপ্তাহেও ভেদ করতে পারেনি ভারতের সুদক্ষ নিরাপত্তাবাহিনী। পর পর দু’রাতে চার চারটি ড্রোন কিভাবে কোত্থেকে উড়ে এলো এবং নিরাপদে ফিরে গেল তা সুনির্দিষ্ট করে বলতে পারেনি সামরিক গোয়েন্দাবাহিনী।

বিমান ঘাঁটিতে হামলার ব্যাপারে প্রাথমিকভাবে বলা হয়েছে, সীমানা পেরিয়ে বোমাবাহী আধুনিক ড্রোন দুটি এসেছিল জম্মুর আকাশে। কিন্তু নিরাপত্তা বলয় টপকে কীভাবে ড্রোন দুটি সেখানে ঢুকে পড়ল তার সঠিক উত্তর এখনও মেলেনি। ঘটনা তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা- এনআইএ- কে।

ভারতীয় গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, গত ২৬ জুন মধ্যরাতে জম্মুর বিমানবাহিনীর ঘাঁটিতে দুটি ড্রোন পাঁচ মিনিটের ব্যবধানে পর পর দুটি বিস্ফোরণ ঘটিয়ে নিরাপদে পালিয়ে যায়। এ হামলায় ঘাঁটিতে একটি ভবনের ছাদ ধ্বংস হয় এবং বিমানবাহিনীর দুই সদস্য আহত হন।

ভারতীয় বিমানবাহিনীর ঘাঁটিতে এটিই প্রথম ড্রোন হামলা বলে মনে করা হচ্ছে।

এরপর , জোরদার নিরাপত্তা পরিস্থিতির মধ্যে ২৭ জুন রাতের অন্ধকারে আবারো দুটি ড্রোন হানা দেয় একটি সেনা ছাউনিতে। দ্বিতীয় দিনের ঘটনায় আকাশে ড্রোন এর উপস্থিতি টের পেয়ে নিচ থেকে গুলি ছুঁড়েছিল নিরাপত্তবাহিনী। ফলে কোন ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াই ড্রোন দুটি পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়।

এ ড্রোন হামলা ঘটনার পরপরই স্থানীয় প্রশাসন কাশজমিরের সীমান্ত এলাকায় সব ধরনের খেলনা ড্রোন, আকাশ থেকে ভিডিও বা ফটোগ্রাফির কাজে ব্যবহার উপযোগী ড্রোন উড্ডয়নের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা জারী করেছে। একই সাথে ব্যাক্তিগতভাবে যাদের কাছে এ ধরনের উড়াল যন্ত্র রয়েছে তা থানায় জমা দিতে বলা হয়েছে।

পাকিস্তানকে দুষছে ভারত

তবে এ ড্রোন হামলা ঘটনায় পাকিস্তানকে দুষছেন ভারতীয় কর্তৃপক্ষ ।

কাশ্মীর উপত্যকায় মোতায়েন ভারতীয় সেনাবাহিনীর ১৫ নম্বর কোরের কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল ডি পি পাণ্ডে ঘটনার তিনদিন পর (৩০ জুন) গণমাধ্যমকে বলেন, এমন ড্রোন রাস্তাঘাটে বসে তৈরি করা যায় না। রাষ্ট্রীয় মদদ এবং প্রযুক্তিগত সহায়তা ছাড়া যুদ্ধের উপযোগী ড্রোন বানানো লস্কর-ই-তৈয়বা বা জৈশ-ই-মহম্মদের মতো জঙ্গিগোষ্ঠীর পক্ষে সম্ভব নয়।

লেফটেন্যান্ট জেনারেল পাণ্ডের অভিযোগ, শুধু বোমাবাহী ড্রোন বানানোই নয়, সেগুলো পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল পাকিস্তানের।

জম্মুতে ড্রোন হামলার ঘটনার পর কাশ্মীরের বানিহাল থেকে এক যুকককে ৪ কেজি বিস্ফোরকসহ গ্রেফতার করে পুলিশ। ওই যুবক পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গিগোষ্ঠী লস্কর-ই-তৈয়বার সদস্য বলে জানানো হয়েছে। ।

কোনো গোষ্ঠী এখনো এ হামলার দায় স্বীকার না করলেও দ্য ইউরোপিয়ান ফাউন্ডেশন ফর সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ (ইফসাস) জম্মু ও কাশ্মীরের পুলিশ প্রধান দিলবাগ সিংয়ের বরাত দিয়ে দাবি করেছে, জঙ্গি গোষ্ঠী লস্কর-ই-তৈয়বাই এ হামলা চালিয়েছে।

ভারতীয় বিমান বাহিনীর জম্মু ঘাঁটিতে ড্রোন হামলার পর বায়ু সেনার একজন সাবেক কর্মকর্তা দীপাঞ্জন চক্রবর্তী একটি টিভি চ্যানেলে সাক্ষাৎকারে বলেছেন, এ ড্রোনগুলি যদি সীমান্তের ওপার থেকে এসে থাকে এবং তা যদি দেশের সীমান্তরক্ষীরা টের পেয়ে না থাকে ; অথবা বিমান বাহিনী তাদের কাছে থাকা নাইট ভিশণ যন্ত্রেপাতি দিয়ে উড়ন্ত ড্রোনদুটি আগেই সনাক্ত করতে না পারে; তাহলে দেশের নিরাপত্তা সক্ষমতার দুর্বলতাই প্রকাশ পাবে। আর যদি দেশের অভন্তরে কোন সন্ত্রাসী গোষ্ঠী এটা করে থাকে তাহলে তাদের সন্ত্রাসী সক্ষমতা যে একধাপ উন্নত হয়েছে তা স্বীকার করতে হবে।

ভারতের অভিযোগ প্রত্যাখ্যান পাকিস্তানের

জম্মুতে ড্রোন হামলায় পাকিস্তান জড়িত বলে দিল্লি যে অভিযোগ করেছে, তা সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছে ইসলামাবাদ।

পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বুধবার এক বিবৃতিতে ভারতের এ ধরনের অভিযোগকে ভিত্তিহীন এবং দায়িত্বজ্ঞানহীন কাজ বলে অভিহিত করা হয়।

এ বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, ভারতের আভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সঙ্কট থেকে দৃষ্টি ফেরাতে , নির্বাচনে জয় পেতে বা ক্ষমতা ধরে রাখতে ভারতের ক্ষমতাসীনরা বরাবরই পাকিস্তান কার্ড নিয়ে খেলতে অভ্যস্ত। এত তাদের পুরানো কৌশল।

এ ছাড়া, কাশ্মীরীদের সংগঠন তেহরিক-ই-ওয়াহিদায়-ই-ইসলাম পৃথক এক বিবৃতিতে সুনির্দিষ্ট তথ্যপ্রমাণ ছাড়া ড্রোন হামলার ঘটনায় পাকিস্তানকে অভিযুক্ত করাকে মোদী সরকারের ব্যর্থতা এবং কাশ্মীরের জনকনের ওপর পরিচালিত ফ্যাসিবাদী নির্যাতনকে আড়াল করার একটা অপচেষ্টা বলে উল্লেখ করেছে।

সংগঠনটি দাবি করেছে, পাকিস্তানের সাথে আলোচনার মাধ্যমে এবং জাতিসংঘের সিদ্ধান্ত মোতাবেক কাশ্মীর সংকটের সমাধান করতে হবে।

নতুন করে সহিংসতা

কাশ্মীরে বিমান ঘাঁটিতে ড্রোন হামলার পর বর্ধিত নিরাপত্তা পরিস্থিতির মধ্যে গত শুক্রবার ( ২ জুলাই) নিরাপত্তাবাহিনী এবং সশস্ত্র জঙ্গি গোষ্ঠীর মধ্যে সংঘর্ষে নিরাপত্তা বাহিনীর একজন সদস্য সহ ছ’জন নিহত হয়েছে।

কাশ্মীরের পুলিশ দাবী করেছে নিহতদের মধ্যে পাঁচজন লস্কর-ই-তৈয়বার সদস্য। এদের একজন সংগঠনের পুলওয়ামা জেলা কমান্ডার নিশাদ হুসেন লোন।

কাশ্মিরের পুলিশ প্রধান বিজয় কুমার এ ঘটনাটিকে পুলিশের পক্ষ থেকে পরিচালিত একটি সফল অভিযান হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।

সংঘাতের প্রেক্ষাপট।

২০১৯ সালের আগস্ট মাসে সংবিধানের ৩৭০ ধারা সংশোধন করে জম্মু ও কাশ্মীর এবং লাদাখকে পৃথক কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার।

গতমাসেই কাশ্মীরের নেতাদের সঙ্গে নতুন করে আলোচনা শুরু করেছে দিল্লী । এ নিয়ে আয়োজিত ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে প্রথম বৈঠকে যোগ দেন কাশ্মীরের আটটি দলের ১৪ জন নেতা।

আলোচনায় কাশ্মীরকে পৃথক রাজ্যের মার্যাদা ফিরিয়ে দেওয়ার বিষয়টি নিয়েও আলোচনা হয়েছে। তারই মধ্যে এই ড্রোন হামলা এবং সশস্ত্র সংঘাত নতুন করে পরিস্থিতি জটিল করছে বলে মনে করছে রাজনৈতিক মহল।

এদিকে, আজাদ জম্মু-কাশ্মীরের প্রেসিডেন্ট সরদার মাসুদ খান বলেছেন, ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ ধারা পুনর্বহাল নয় পুরোপুরি স্বাধীনতার মধ্যেই দিয়ে কাশ্মীরীদের সমস্য সমাধান করতে হবে।

বাহওয়ালপুর বিশ্ববিদ্যালয় আয়োজিত এক অনলাইন আলোচনায় যোগ দিয়ে প্রেসিডেন্ট মাসুদ খান আজ ( জুলাই 0৪) দৃঢ় আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলেছেন, স্বায়ত্ব শাসনের অধিকার আদায়ের জন্য কাশ্মীরীদের দীর্ঘ কয়েক দশকের সংগ্রাম অবশ্যই সফল হবে।

এর আগে পৃথক এক বিবৃতিতে প্রেসিডেন্ট মাসুদ খান বলেছেন, কাশ্মীরে ভারতীয় বাহিনী পরিচালিত নির্মমতার সর্বশেষ উদাহরণ হচ্ছে শুক্রবার পাঁচজন কাশ্মীরী যুবকে হত্যা করা।

তিনি বলেন, কাশ্মীরের প্রতিরোধ আন্দোলনকে স্তিমিত করে দেবার জন্যই মোদী সরকার কাশ্মীরী যুবকদের টার্গেট করে হত্যা হরছে।

শহীদী সপ্তাহ পালনের আহবান

জম্মু কাশ্মীরের সর্বদলীয় হুররিয়াত কনফারেন্স কাশ্মীরের প্রতিরোধ যোদ্ধা বুরহকানুদ্দিন ওয়ানীর শহীদ হবার পঞ্চম বার্ষিকী উপলক্ষে আগামী ৬ থেকে ১৩ জুলাই পর্যন্ত শহীদী সপ্তাহ পালনের ডাক দিয়েছে। গতকাল এক বিবৃতিতে সর্বদলীয় হুররিয়াত কনফারেন্স জম্মু-কাশ্মির, আজাদ কাশ্মীর, পাকিস্তান এবং বিশ্বের অন্যান্য দেশে বসবাসকারী মুক্তিকামী কাশ্মীরিদের প্রতি শহীদী সপ্তাহ পালনের আহবান জানিয়েছে।

সপ্তাহব্যাপী কর্মসুচীর মধ্যে রয়েছে দোয়া মাহফিল, র‍্যালী, সমাবেশ, এবং সপ্তম দিবসে দোকানপাট -বাজার বন্ধ রাখা এবং ঘরে আটক থেকে স্বেচ্ছায় “সিভিল কারফিউ” পালন করা ।

কাশ্মীরে পরিচালিত নির্মমতার প্রতিবাদ, শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানায় এবং চলমান মুক্তির আন্দোলনে সমর্থন ঘোষণা ছাড়া কাশ্মীর সন্মকট সমাধানে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষনের উদ্দেশ্যে সপ্তাহব্যাপী এ কর্মসূচীর ডাক দেওয়া হয়েছে।