আলী প্রয়াস

 

গত কয়েকদিন আগে ফেসবুক ও সংবাদসূত্রে জানলাম লম্বরী মলকাবানু উচ্চ বিদ্যালয়ের সম্মানিত প্রধান শিক্ষক জনাব মোহাম্মদ ইসমাঈল তাঁর স্কুল সম্মুখস্থ রাস্তার উন্নয়ন সংস্কার কাজের অনিয়মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে কতিপয় স্থানীয় সন্ত্রাসী কর্তৃক হামলার শিকার হয়েছেন। বিষয়টি আমাকে রীতিমতো বিস্মিত ও উদ্বেগাকুল করেছে। এরকম বর্বর নেক্কারজনক হামলা অত্যন্ত নিন্দনীয়, চরম ঘৃণিত। এটা কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। বেশি খারাপ লেগেছে এইজন্যই যে, বিষয়টি প্রথমত আমার গ্রামের স্কুলে দ্বিতীয়ত একদা আমিও এই স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলাম এবং আমার পিতা এই স্কুল প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনায় নিরলস পরিশ্রম করেছিলেন।

১৯৯৪ সালের দিকে এতদ্বঞ্চলের একমাত্র উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার ইতিহাস অত সহজ ছিল না। এলাকার কিছু বিদ্যুৎসাহী মানুষের উদ্যোগ, চিন্তা-শ্রম-পরিকল্পনার মাধ্যমে অসম্ভবকে সম্ভব করার সেই কষ্টসাধ্য ইতিহাসগুলো আমরা প্রত্যক্ষ করেছি এবং নিজেও যুক্ত ছিলাম। এই স্কুল প্রতিষ্ঠায় এমনিতেই কত বাধা-বিপত্তি পার করতে হয়েছে, সেই পর্যায়গুলো আরও করুণ, আরও নির্মম। এতসব উপেক্ষা করে যখন একটি প্রতিষ্ঠান সাফল্যের মুখ দেখছে, সমাজকে আলোকিত করছে , তখন সেই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকের উপর এধরণের অমানবিক হামলা কোনোভাবেই প্রত্যাশিত নয়।

শিক্ষকদের অমর্যাদা করে কোনো সমাজ উন্নতি লাভ করতে পারেনি। শিক্ষাগুরুকে অসম্মান করা ধৃষ্টতার সামিল।

চাণক্য শ্লোকে আছে, এক অক্ষরদাতা গুরুকেও গুরু বলিয়া মান্য করিবে ।’শিক্ষককে যে গুরু বলে মান্য করে না, সে মানুষের মধ্যে সবচেয়ে নিম্ম মানসিকতারই পরিচয় দিয়ে থাকে। শিক্ষকগণ সবসময়ই সম্মানের আসনে আসীন। জগতে পিতা-মাতার পরই শিক্ষকের স্থান। মহামতি আলেকজান্ডার বলেছেন, ‘I am indebted to my father for living but to my teacher for living well’. আলোকিত মানুষ, মনুষত্বের বিকাশ ঘটানো তথা একজন মানুষ হিসেবে জীবন যাপনের জন্য দরকার প্রকৃত শিক্ষার আর সে শিক্ষা অর্জন করতে অবশ্যই শিক্ষকের দরকার হয় । একজন মানুষ শিক্ষকের চোখেই জগৎ দেখেন । মানব সভ্যতার উন্নয়ন একমাত্র শিক্ষকের মাধ্যমেই সম্ভব এবং এটা তাঁদেরই অবদান । এজন্যই বলা হয় শিক্ষকগণ মানুষ গড়ার কারিগর।

এক মহান পেশা হলো শিক্ষকতা, আর এই মহান পেশায় নিয়োজিত থেকে মহান সেবা দিয়ে যাচ্ছেন মর্যাদাবান শিক্ষকরা । যুগ যুগ ধরে শিক্ষকরা মর্যাদা পেয়ে আসছেন। মহামানব, মহাপুরুষ, ধর্মপ্রচারক, রাজা-বাদশা সবাই শিক্ষকের মর্যাদা দিয়েছেন, এখনো দিচ্ছেন। মহানবী নিজেই বলেছেন, ‘আমাকে শিক্ষক হিসেবে প্রেরণ করা হয়েছে বা আমি শিক্ষকরূপে প্রেরিত হয়েছি। তিনি আরও বলেছেন, ‘তোমরা জ্ঞান অর্জন কর এবং জ্ঞান অর্জনে আদব, শিষ্ঠাচার শিখো তাঁকে সম্মান কর যার থেকে তোমরা জ্ঞান অর্জন কর।’

বলা হয়ে থাকে, শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। আর সে মেরুদণ্ড দণ্ডায়মান রাখার দায়িত্বটুকু পালন করেন শিক্ষক । পিতা-মাতা জন্মদাতা হলেও প্রকৃত মানুষ গড়ার দায়িত্ব অর্পিত হয় একজন শিক্ষকের উপর। সমাজে আমরা কোন না কোনভাবে শিক্ষকের শিক্ষার্থী । যিনি একটি মাত্র অক্ষর শিক্ষা দিয়েছেন তিনিও একজন শিক্ষক । শিক্ষকের সম্মান রক্ষার নজির ইতিহাসের পাতায় দেখা যায় । জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু বিশ্বাস করতেন, শিক্ষিত জাতি ছাড়া বাংলার মুক্তি সম্ভব নয় এবং তাঁর জীবন ও কর্মে তিনি শিক্ষার গুরুত্ব ও শিক্ষকের মর্যাদা, সুযোগ-সুবিধা নিয়ে অত্যন্ত আন্তরিক, শ্রদ্ধাশীল ও আবেগপ্রবণ ছিলেন। শিক্ষকদের প্রতি তাঁর গভীর শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার অনেক নিদর্শন পাওয়া যায় ‘অসামপ্ত আত্মজীবনী’তে। তাঁর সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শিক্ষককে সম্মান প্রদর্শন যেন সমস্ত শিক্ষকগণের মর্যাদা পাওয়ার একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ।

সংস্কৃতে একটি কথা আছে, ‘গুরু শিষ্যকে যদি একটি অক্ষরও শিক্ষা দেন, তবে পৃথিবীতে এমন কোনও জিনিস নেই, যা দিয়ে সেই শিষ্য গুরুর ঋণ শোধ করতে পারে। বাদশাহ আলমগীর অমর হয়ে আছেন আজও সেই কাজী কাদের নেওয়াজের বিখ্যাত কবিতার উচ্চারণে, ‘আজ হতে চির উন্নত হলো শিক্ষাগুরুর শির। প্রতিটি ধর্মগ্রন্থে শিক্ষকের মর্যাদা ও সম্মানের গুরুত্ব দওয়া হয়েছে। সক্রেটিস, অ্যারিস্টোটল, প্লেটোর মতো শিক্ষকরা জীবদ্দশায় সম্মান না পেলেও, আজও তাঁরা মানুষের হৃদয়ে গেঁথে আছেন। জাতিসংঘে শিক্ষকদের অবস্থা, সমাজে তাঁদের অপরিহার্যতা, মর্যাদা এবং শিক্ষক ও শিক্ষাসংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ের ওপর আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি প্রতিষ্ঠিত হয়।

টেকনাফ সদর ইউনিয়নের একমাত্র মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান লম্বরী মলকাবানু উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর একটি আলোকিত সমাজ প্রত্যাশা ছিল । তার কিছুটা অগ্রগতি হলেও শিক্ষকের প্রতি বর্বরোচিত হামলার ঘটনায় মনে হচ্ছে এখনও চেরাগের নিচে অন্ধকার রয়ে গেছে। এখনও সমাজের দুষ্ঠুচক্রের মুলোৎপাঠন সম্ভব হয়নি। এখনও দুঃখজনকভাবে স্থানীয় সন্ত্রাসী রাজনীতি ও প্রশাসনের প্রশ্রয় পেয়ে যাচ্ছে। টেকনাফে অবৈধ উপায়ে উপার্জিত টাকার জোরে কিছু মানুষ ধরাকে সরা জ্ঞান করছে। শিক্ষকদের আঘাত করার মতো ধৃষ্টতা দেখাচ্ছে। শুধু টেকনাফে নয়, বর্তমান সমাজে শিক্ষক লাঞ্চিত হওয়ার ঘটনা অহরহ ঘটছে এবং জাতির বিবেক সে শিক্ষকগণের নির্যাতনের খবর, লাঞ্চিত করার বর্ণনা পত্রিকায় প্রতিনিয়ত প্রকাশিত হচ্ছে। এর চেয়ে লজ্জা আর কি হতে পারে! নিজ এলাকায় শিক্ষককে অসম্মান, অবমাননা ও লাঞ্চিত হওয়ার প্রকাশিত সংবাদ দেখে এ সমাজের সচেতন মহলসহ প্রত্যেকেই বিস্মিত হয়েছে।

শিক্ষকরা সমাজ পরিবর্তনে এবং শিক্ষার্থীদের সামাজিকীকরণে ও তাঁদের মধ্যে নৈতিক ও সামাজিক মূল্যবোধের ভিত তৈরিতে অনুঘটকের ভূমিকা পালন করে থাকেন। আমি দৃঢ় কণ্ঠে বলতে পারি অন্য সকল পেশার মানুষের চেয়ে শিক্ষকরা নীতি-নৈতিকতার দিক দিয়ে শ্রেষ্ঠ অবস্থানে আছেন। আর তাদেরই কারণে-অকারণে নির্যাতন করেন সমাজের কিছু দুষ্ঠুচক্র। শিক্ষকরা যদি সমাজে এভাবে অপমানিত হয়, এ লজ্জা গোটা এলাকার। শিক্ষকদের প্রতি ক্রমাগত অশ্রদ্ধা এ সমাজের অধপতন ডেকে আনবে।

শিক্ষা যদি হয় জাতির মেরুদণ্ড, শিক্ষক হবেন শিক্ষার মেরুদণ্ড। কিন্তু শিক্ষককে জাতি গড়ার কারিগর বলা হলেও, তাদের প্রতি নিষ্পেষণ, নির্যাতন করা হয়। এর কারণ, শিক্ষকরা পেশার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে পেশাগত, প্রকৃতিগত, ও সামাজিকভাবে অনেকটা সহনশীল, শালীন, মার্জিত হয়ে থাকেন। এটাকে দুর্বলতা ভেবে পেশীশক্তি শুরু করে তাদের তাণ্ডবলীলা চালাতে। যে-কোনো সরকারের সময় দুর্বৃত্তরা-সন্ত্রাসীরা শিক্ষকদের ওপর নানাভাবে অত্যাচার চালিয়েছে এবং চালাচ্ছে। তাদের শিকারে পরিণত হয় শিক্ষক সমাজ।

আমরা জানি যে, শিক্ষকতা একটি মহান পেশা আর এই পেশায় নিয়োজিত শিক্ষকরাও মহান। শিক্ষকদের থাকার কথা সমাজের সর্বোচ্চ মর্যাদার আসনে। মুখে মুখে আমরা যতই শিক্ষকদের মর্যাদার কথা বলি না কেন, বাস্তবে কিন্তু উল্টো। আসলে শিক্ষকরা কেমন মর্যাদা পাবেন তা নির্ধারণ করবে রাষ্ট্র তথা সরকার। ইউনেস্কো-আইএলও-এর ঘোষণা অনুযায়ী শিক্ষকরা হবেন রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ মর্যাদার অধিকারী নাগরিক। কিন্তু এর লেশ মাত্রও বাস্তবায়ন হয়নি এদেশে। শিক্ষকের মর্যাদা শুধু মুখে নয় বাস্তবে সকল ক্ষেত্রে উচ্চ মর্যাদায় আসীন করে নিজদের উন্নত জাতি হিসেবে অধিষ্ঠিত করেছে জাপান, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া ও চীনের মতো দেশগুলো। একজন শিক্ষক কতটুকু মর্যাদা পাবেন তা রাষ্ট্রীয়ভাবে কোথাও উল্লেখ নেই। অথচ শ্রীলঙ্কায় শিক্ষকদের মন্ত্রীর মর্যাদা দেয়া হয়। বাংলাদেশে শিক্ষকের মর্যাদার কোনো মানদণ্ড নেই। মানব উন্নয়নের সূচকে এ দেশের শিক্ষা ও শিক্ষকের অবস্থান ও অবদান সবচেয়ে বেশি। ষাটের দশকেও শিক্ষকরা সমাজের সবেচেয়ে সম্মানী ব্যক্তি ছিলেন। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সেই সম্মান ফিরিয়ে আনতে হবে। সমাজ ও সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি পালটাতে হবে। আমরা শুধু সমাজের উপরি কাঠামো দিয়ে শিক্ষকদের বিচার করলে হবে না; মূল কাঠামোতে শিক্ষকদের অবস্থান সুদৃঢ় করতে হবে।

শিক্ষকতা পেশার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা এবং শিক্ষকদের সামাজিকভাবে মর্যাদার আসনে বসানো প্রত্যেক নাগরিকের কর্তব্য। যে সমাজ শিক্ষককে সম্মান দেয় না, সে সমাজে মানুষ তৈরি হয় না। শিক্ষকের অমর্যাদা, অপমান এর প্রকাশিত খবর পরবর্তী প্রজন্মের শিক্ষার্থীর ওপর প্রভাব ফেলতে পারে, যা সংশ্লিষ্ট সকলকে এখন থেকে ভাবতে হবে। আগামীতে এর পরিণাম কি হবে, তা এখন ভাববার বিষয় । ভবিষ্যতে শিক্ষকদের উপর এ ধরনের মানহানিকর ঘটনা আর যাতে কেউ ঘটাতে না পারে সে ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে কর্তৃপক্ষকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। এ ধরনের যেকোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার সুষ্টু তদন্ত সাপেক্ষে যাচাই এর ব্যবস্থা নিয়ে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে । এ ব্যাপারে শিক্ষকদেরও আরও বেশি ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। পাশাপাশি জনগণের মধ্যে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও নৈতিক মূল্যবোধগুলো জাগ্রত করতে হবে।

অন্যায়ের প্রতিবাদ করা শিক্ষকের কাজ। এটা তার আদর্শের এখতিয়ারভুক্ত। শিক্ষকমাত্রই দুর্নীতি ও অনিয়মনের বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকবেন এটাই স্বাভাবিক। ইসমাঈল সাহেব তার নৈতিক দৃঢ়তায় অন্যায়ের প্রতিবাদ করে সঠিক কাজটিই করেছেন। আমি তার ওপর অন্যায় হামলার তীব্র নিন্দা জানাই। একই সাথে বলে রাখি, একটি শিক্ষিত, উচ্চ নৈতিকতাসম্পন্ন প্রজন্ম ও সমাজ গড়ে তুলতেই শিক্ষকের মর্যাদা প্রতিষ্ঠার কোনো বিকল্প নেই। শিক্ষকদের অপমান করে সমাজের এমন অপরাধীচক্রকে কঠোর হাতে দমন করতে হবে। অল্প কিছু দুরাচারের কাছে শিক্ষক সমাজ জিম্মি হতে পারে না। আসুন, শিক্ষককে সাথে নিয়ে ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় এই অশুভ শক্তিকে প্রতিহত করে শিক্ষকের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করি। জাতির সত্যিকারের অগ্রগতি নির্ভর করে শিক্ষার ওপর। সেটা আমরা যত তাড়াতাড়ি বুঝবো, ততই মঙ্গল।

আলী প্রয়াস : কবি, প্রাবন্ধিক ও গবেষক।