সুলতান আহমদ:
পুরো বিশ্বে করোনা ভাইরাসের ভয়াল ছোবল গত বৎসর থেকে শুরু হয়ে এখনও চলছে। যদিও ২০১৯ থেকে করোনার উৎপত্তি, কিন্তু ভয়াল হয়ে উঠেছে ২০২০ থেকেই। ২০-০২-২০২০ তারিখে আমার এক বন্ধু একটি মেসেঞ্জার গ্রুপে লিখেছিল কী সুন্দর তারিখ! আমি উত্তরে লিখেছিলাম আগেও বিষ! শেষেও বিষ! বছরটাই হতে পারে বিষাক্ত! ঠিক তাই হয়ে গেল মহান বিধাতার অলৌকিক ইশারায়। বিশ্বের বাঘা-বাঘা শক্তিশালী রাষ্ট্রসমূহকে কাবু ও পর্যুদস্তু করে প্রায় সব রাষ্ট্রে ছড়িয়ে পড়ল এই করোনা ভাইরাসের ভয়ানক থাবা। মৃত্যুর মিছিল শুরু হয়ে গেল। যে মৃত্যুর মিছিল এখনও থামছে না। বরং ক্ষণে ক্ষণে বেড়েই যাচ্ছে। এখন পর্যন্ত হিসাবের খাতায় উঠেছে পৃথিবী ব্যাপী ৪২ লক্ষের অধিক। হিসাবের বাইরে আরও কত না জানি আছে! আর অসুস্থ হয়ে পৃথিবী ব্যাপী কোটি কোটি মানুষ রোগে-ভোগে শারীরিক-মানসিক-আর্থিকভাবে সর্বশান্ত হয়ে পড়ছে।
বাংলাদেশেও ২০২০ সালের ০৮মার্চ থেকে করোনা ভাইরাসের উপস্থিতি শুরুর প্রমাণ পাওয়া গেল। এবং গত বছর কম সংক্রমণ হলেও এ বছর মার্চের শেষ সপ্তাহ থেকেই সংক্রমণের আগের রেকর্ডগুলো ভেঙে দিতে লাগলো। পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি জনঘনবসতির দেশ হচ্ছে বাংলাদেশ। করোনা ভাইরাস ছড়ায় জনসমাগম বিস্তারের ওপর নির্ভর করে। তাই সরকার করোনার বিস্তার ঠেকাতে ও প্রতিরোধ করতে শুরু থেকেই নানাভাবে নিজেদের সক্ষমতা অনুযায়ী বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে লাগলো। সফলতা-ব্যর্থতা থাকবেই। সফলতা অর্জন করতে গেলে ব্যর্থতাকে মেনে নিয়েই কাজ করতে হয়। শুরুর দিকে সফল হলেও বর্তমান পর্যায়ে এসে সরকার অনেকটা জনজীবনের জীবন-জীবীকার প্রশ্নে পরাজয়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। কিন্তু কেন ব্যর্থতা?
মহামারী ঠেকাতে সরকার ফ্রন্ট লাইনের যোদ্ধাদের জন্য প্রণোদনার ঘোষণা দিল, যাদের নিজেদের জীবনকে তুচ্ছ করে সামনে এগিয়ে থাকতে হবে। ডাক্তার, প্রশাসন, পুলিশ ও অন্যান্য যাদের এ মহামারী মোকাবেলায় ফ্রন্ট লাইনের যোদ্ধা হতে হবে। ব্যাংকে যারা চাকরি করে তাদেরও এই ফ্রন্ট লাইনের যোদ্ধা হিসেবে গণ্য করে তাদের বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনায় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য প্রণোদনার ঘোষণা আসলো।
এ মহামারী মোকাবেলায় প্রথম পদক্ষেপ যেহেতু মানুষজনকে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত নিজ ঘরে ঘরে আটকে রাখা, তাই সরকারকে মৌলিক চাহিদা মেটাতে গিয়ে প্রথমে জনগণের অন্ন সংস্থানের ব্যবস্থা করতে হলো। কলকারখানা সাময়িকভাবে বন্ধ রাখতে হলো। শ্রমিকরা কাজে যেতে না পারায় তাদের পরিবার-পরিজনের অন্ন সংস্থানের জন্য নানাভাবে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হলো তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল বাংলাদেশ সরকারকে।
দেশের অর্থনীতি টিকিয়ে রাখতে বিভিন্ন পর্যায়ে কোটি কোটি টাকার প্রণোদনার ঘোষণা দিয়ে বিতরণ করা হলো। যারা ব্যাংক থেকে কোটি কোটি টাকা ঋণ নিয়েই শিল্প-কলকারখানার মালিক, তারাও পেয়েও গেল প্রণোদনার সুবিধা। তাদের তো কোনো অভাব নেই! কেন তারাও প্রণোদনা-সুবিধার ভোগীদার? তাদের কারো কারো এত সম্পদ জমা আছে যা দিয়ে পরবর্তী সাত-প্রজন্ম নিশ্চিত থাকতে পারবে, তাদের কেন এ প্রণোদনা সুবিধা? যারা চার হাজার কোটি টাকা মূল্যের শিল্প-কারখানা মর্টগেজ দিয়ে ব্যাংক থেকে চল্লিশ হাজার কোটি বা তারও বেশি টাকা ঋণ নিয়ে ব্যবসা করার নাম দিয়ে বিদেশে টাকা পাচার করে ব্যাংককে-দেশকে দেউলিয়া বানানোর চক্রান্তে থাকে, তাদের কেন এ প্রণোদনা সুবিধা? তাদের প্রদত্ত এ প্রণোদনা সুবিধা যদি শ্রমিকদের হাতে সরাসরি ভাগ করে দেওয়া হতো তাহলে তো বাংলাদেশের প্রত্যেকটি গৃহ ছোট ছোট শিল্প-কারখানায় পরিণত হতে পারতো। দেশের সম্পদ তো অন্ততপক্ষে বিদেশে পাচার না হয়ে দেশেই থাকতো। অন্ততপক্ষে তেলা মাথায় তেল দেওয়া হতো না। আজকের এ লেখায় বিষেদাগারের কারণ, শিল্প-কারখানার মালিকরা সরকারকে দেওয়া কথা রাখেনি তাই।
শ্রমিকদের জীবন শিল্প-কারখানার মালিকদের কাছে সভ্যতার শুরু থেকেই মশা-মাছি-পিঁপড়া তুল্য। কয়লা শ্রমিক, চুনা-পাথর কারখানার শ্রমিক, স্বর্ণ খনির শ্রমিক, তৈরি পোশাক-খাতের শ্রমিক থেকে শুরু করে সব ধরনের শ্রমিকের জীবন মালিকদের মুনাফার কাছে তুচ্ছ বিষয়! বিখ্যাত নাট্যকার উৎপল দত্তের ‘অঙ্গার’ উপন্যাসে চিত্রিত হয়েছে এ রকম বাস্তব ঘটনারই কাল্পনিক বিবরণ, যেখানে শ্রমিকদের কয়লাখনিতে আটকে থাকার পরও মালিকরা ধোঁকা দিয়ে শ্রমিকদেরকে কয়লায় পরিণত করেছে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য। আমাদের দেশেও মাত্র কয়েক বছর আগে সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখেছি। রানা প্লাজায় শ্রমিকদের জীবনকে কত তুচ্ছ করেছিল কারখানার মালিক! শত শত শ্র্রমিককে মৃত্যু বরণ করতে হলো কারখানার মালিকের মুনাফা টিকিয়ে রাখার জন্য। আগেরদিনই জানতে পেরেছিল শ্রমিকরা এ কারখানায় দুর্ঘটনা ঘটবে, তাই তারা কাজে যোগদানে অনীহা প্রকাশ করেছিল, কিন্তু মালিক তার মুনাফাকে অটুট রাখার জন্য শ্র্রমিকদের জীবনকে তুচ্ছ করে হুমকি দিয়ে কাজে যোগদানে বাধ্য করেছিল সেই সময়। সেই কারখানার অনেক শ্রমিক যারা বেঁচে আছে কিন্তু পঙ্গুত্ব বরণ করে পরিবার ও নিজের জীবনের বোঝা হয়ে।
মালিকদের কাছে জিম্মি হয়ে সরকার অনেকটা বাধ্য হয়েই ০১ আগস্ট থেকে রপ্তানীমুখী শিল্প-কারখানা খোলে দেওয়ার অনুমতি দিলো। কিন্তু কোনো শ্রমিককে ‘০৫ আগস্টের আগে কাজে যোগদানে বাধ্য করা যাবে না’ এই শর্তে। কারখানার মালিকরা কথা রাখেনি। তারা যা করেছে তা যেমন মুনাফেকী, তেমনি দেশের জন্য মহাবিপদের অশনি-সঙ্কেত! সংক্রমণ ও মৃত্যুর মিছিল যেখানে ভয়ানক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে, সেখানে কারখানার মালিকরা শ্রমিকদের চাকরি খোয়ানের হুমকি দিয়ে ০১ আগস্টে যোগদানে বাধ্য করায় সারাদেশের জনজীবনে মহাবিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে। রাস্তা-ঘাটে, বাসে, ট্রাকে, লরিতে, লঞ্চে শ্রমিকরা কাজে যোগদানের জন্য যে হুড়োহুড়ি-ঠেলাঠেলি, তা মহা ভয়ানক ও বিপর্যয়কর। করোনা ভাইরাস ট্রান্সমিটে ট্রান্সমিটে আলফা থেকে ডেলটা, ডেলটা থেকে ডেলটা প্লাস ভেরিয়েন্টে পরিণত হয়ে যায় বলে বিজ্ঞানীরা প্রমাণ দিচ্ছে, যা দ্রুত চরম সংক্রমণ ও মৃত্যুকে ত্বরান্বিত করে। তাহলে সামনে যে মৃত্যুর মিছিল শুরু হতে পারে তার দায়ভার কার? কে নেবে এ হত্যাকাণ্ডের দায়ভার? সরকার এবার কারখানার মালিকদের বাধ্য করুক, কোনো শ্রমিক যদি আক্রান্ত হয়, তার দায়ভার যেন কারখানার মালিকদের ওপর বর্তায়। আর যদি একজন শ্রমিকও মৃত্যুর শিকার হয় এ করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে, তাহলে তা হত্যাকান্ড হিসেবে মালিকদেরকে জবাবদিহিতার আওতায় আনা হোক। শ্রমিকের জীবন আর কত মশা-মাছি-পিঁপড়া তুল্য থাকবে মুনাফা লোভী শিল্প-কলকারখানার মালিকদের কাছে?
সুলতান আহমদ
গবেষক ও প্রাবন্ধিক
কক্সবাজার।
E-mail: mdsultancox@gmail.com
আমরা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।