পাভেল রহমান:
আম্মা ফজরের নামাজ পড়েই আব্বার নাস্তা তৈরিতে ব্যস্ত হলেন। আব্বা আজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে ডিউটিতে থাকবেন। আব্বা তখন স্পেশাল ব্রাঞ্চের ডিপুটি পুলিশ সুপারেন্টেন্ড।
বিশ্ববিদ্যালয় সমূহের চ্যান্সেলর রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান আজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আসছেন বিশেষ সমাবর্তন অনুষ্ঠানে যোগ দিতে। ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চের ‘ কাল রাতে ‘ পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর গণহত্যায় নিহত জগন্নাথ হলের ছাত্র শিক্ষক কর্মচারীদের শ্রদ্ধা জানাতে বঙ্গবন্ধু আসবেন হল চত্বরে।
আব্বার ডিউটি আজ সেখানেই।
সাড়ে ৬টা নাগাদ বাসা থেকে ডিউটিতে বেড়িয়ে যেতেই
সকাল ৭টায় বাংলাদেশ বেতারের খবর শুনতে মা রেডিও অন করলেন। ৭টার খবর তখনো ঢের বাকি। ছোটবেলা থেকেই আব্বার ঐ ‘ মারফি ’ রেডিও তে খবর শুনে বড় হয়েছি। আজ আব্বা বাসায় না থাকলেও অভ্যাস মতে খবর শুনতে মা ‘ মারফি ‘ অন করতেই চমকে উঠলাম আমরা। চড়া আর বেসুরা গলায় এক মেজরের কণ্ঠ শুনতে পেলাম, ‘ আমি মেজর ডালিম বলছি ‘ ! ‘ জালিম শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে ’। আম্মা চিৎকার করে উঠলেন। আমি বিছানা থেকে লাফিয়ে রেডিওর সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছি। ততক্ষণে বড় বোন পারভিন বুবু আর ছোটো বোন নিনা তাদের ঘর থেকে ছুটে এসেছে। আমরা তিন ভাই বোন আর আম্মা হতবিহ্বল তাকিয়ে থাকি রেডিও সেটের দিকে। আমার মাথায় ঢোকে না কোন কিছু। আমি চিৎকার করে উঠি, আম্মা বঙ্গবন্ধুকে মেরে ফেলেছে। ডুকরে কেঁদে উঠি আমি। কাঁপা হাতে ফোনের রিসিভারটা তুলে আমি শেখ কামাল ভাইয়ের নাম্বারে ডায়াল করতে গিয়ে ফোন নাম্বারটা মনে করতে পারিনা। এতো দিনের চেনা নাম্বারটা মনেই আসেনা। আমি কাঁপা হাতে নোট বই থেকে নাম্বারটা দেখে দেখে ডায়াল ঘুরাতেই রিং বেজে উটলো, ধানমণ্ডি ৩২ নাম্বারে তিনতালায় কামাল ভাইয়ের রুমে রিং হচ্ছে, রিং হচ্ছে, রিং হচ্ছে। এক টানা বেজে চলেছে ফোন। কিন্তু কেউ ধরছে না। আমি লাইন কেটে আবার ঘুরাতে থাকি। নাহ, এবারো কেউ ফোন ধরলো না। আমি নিচতালায় রিসিপ্শনে ডায়াল করি, এবারো তাই। রিং বেজেই চলেছে কেউ রিসিভার তুলছে না।
তাহলে কি ঘটনা সত্যি ?
আমি ভীত হয়ে পড়ি। কান্না করতে থাকি। ঘটনাটা সত্যি কিনা জানার জন্য কাকে ফোন করবো, কোথায় ফোন করি। আমার বাচ্চু ভাইয়ের কথা মনে পড়ে যায়। বাচ্চু ভাই বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তা টিমের একজন সদস্য। আমি তাঁর শঙ্করের বাসায় ফোন করতে থাকি। ফোনে রিং বাজতে থাকে, বেশ কিছুক্ষণ রিং এরপর কেউ একজন ফোনটা কানে ধরে চুপ করে থাকে কোন কথা বলে না। আমি অস্থির হয়ে হ্যালো হ্যালো বলতে থাকি। কোন সারা না পেয়ে আমি আমার নাম বলতে থাকি, পরিচয় দিতেই বাচ্চু ভাইয়ের কণ্ঠ ভেসে এলো। ‘ হা পাভেল বলো ‘ ? স্বাভাবিক কণ্ঠ ভেসে আসে বাচ্চুভাইয়ের প্রান্ত থেকে। আমি উত্তেজিত কণ্ঠে বলে উঠি , রেডিতে কিসব শুনছি বাচ্চু ভাই ? বাচ্চু ভাই তেমনই শান্ত কণ্ঠে বলে উঠেন , ‘ হা তুমি যা শুনেছো সবই সত্যি শুনছো ! আমি তাঁর কণ্ঠে ‘ সত্যি ’ কথাটা শুনে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারিনা। ছোট্ট রাসেলের মায়া ভরা মুখটা ভেসে উঠে , আমি কাঁদতে কাঁদতে রাসেলের কথা জানতে চাইলাম বাচ্চু ভাই , রাসেল কোথায় বাচ্চু ভাই ? বাচ্চু ভাই বললেন ‘ ওরা সবাইকে মেরে ফেলেছে, রাসেলও বেঁচে নেই , শোন পাভেল , আমরা বাসা থেকে সরে যাচ্ছি , তুমিও বাসায় থেকো না, বেড়িয়ে যাও ‘।
কথা শেষ না হতেই আকস্মিক ফোন ছেড়ে দিলেন বাচ্চু ভাই। বাচ্চু ভাইয়ের কাছে ‘ সত্যি ‘ কথাটা শুনে আমি দিশেহারা হয়ে পড়ি। কি করবো বুঝতে পারিনা। আম্মা , বঙ্গবন্ধুকে মেরে ফেলেছে, ওরা সবাইকে মেরে ফেলেছে আম্মা , বলে আমি কান্না করতে থাকি। আম্মা আর্তনাত করে উঠলেন, ‘ আহ , রাসেল , এতোটুকু বাচ্চা মানুষ, আহা ওকেও মেরে ফেলেছে ।’
আমি বেড়িয়ে পড়ি বাসা থেকে। উদ্দেশ্য বিহীন হাঁটতে হাঁটতে আজিমপুর বেবি আইসক্রীম মোড়ে এসে দাঁড়ালাম। বেশ কিছু মানুষের জটলা। বাম দিকে নিউ মার্কেটের রাস্তা, ডানে লালবাগের রাস্তা পুরোটাই ফাঁকা। একটা রিক্সা পযন্ত নেই। জটলার লোকগুলি সোজা পলাশীর দিকে তাকিয়ে…। আমি বললাম কি দেখছেন আপনারা। একটা লোক বললেন, ‘ শুনলাম ঢাকা মেডিকেলে অনেক লাশ এসেছে ‘ ! আমি হকচকিয়ে যাই , কাদের লাশ ? লোকটা নির্বিকার পলাশীর পথে তাকিয়ে ভাবলেশ হীন বলে উঠে, ‘ শুনতাসি শেখ মণির পরিবার আর মন্ত্রী সারনিয়াবাতের পরিবারের মেলা লাশ আনছে মর্গে।’
আমি তাঁর কথা শেষ হবার আগেই হাঁটতে থাকি পলাশীর দিকে। আজিমপুর মোড় ক্রস করতে গিয়েই থমকে দাঁড়াই ! মাত্র কিছু দিন আগে শেখ কামাল ভাইয়ের স্মৃতি ভেসে উঠে মনে , ‘ পুলিশ সার্জেন্ট ‘ কামাল ভাইয়ের গাড়ি আটকিয়ে সার্চ করলো। আমাকে কামাল ভাই বাসায় নামাতে আসছিলেন। সার্জেন্টের গাড়ি চেকিং এর সামনে টু শব্দটি না করে নেমে এলেন তিনি আর আমাদের নামতে বললেন গাড়ী থেকে।
পলাশীর দিকে উদ্দেশ্যহীন হাঁটতে থাকি আমি। বঙ্গবন্ধু আমার মনের ভিতর তোলপাড় করতে থাকে। রাস্তায় কোন লোক নেই প্রতিবাদের। জগন্নাথ হল পেরুতেই এগিয়ে আসে শহীদ মিনার। আমাদের সেই প্রতিবাদী হতে শেখালো যে শহীদ মিনার। নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আছে একাকী ! শহীদ মিনার লাগোয়া ঢাকা মেডিকেলের emergency গেট। গেঁটে জনা বিশেক উৎসুক লোক ভিড় করে আছে। আর ৫ / ৬ জন রাইফেলধারী পুলিশ ভিড় করতে মানা করছেন গেটের সামনে।
উল্টো দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন সদ্য চুন করা এনেক্স বিল্ডিং একাকী দাঁড়িয়ে। একটা কাক পক্ষী নেই কোথাও। আমি বেশিক্ষণ দাঁড়াতে পারিনা। হেঁটে চলে আসি টিএসসি-টে। এদিক ওদিক বিছিন্ন কজনা ছাত্র জটলা করে। আমি শাহাবাগ হয়ে এলিফেন্ট রোড ধরি। নির্জন রোডে কাউকে তেমন ভিড় জটলা করতেও দেখি না। মাঝে মাঝে হুট হাট শুনশান ছুটে চলে পুলিশের গাড়ি।
সায়েন্স ল্যাবের কোনে দেখি কিছু উৎসুক মানুষ তাকিয়ে থাকে ধানমণ্ডির দিকে। ধানমণ্ডি ৩ নাম্বার রোড আর গ্রীন রোডের মুখে পেট্রোল পাম্পের কোনে কিছু সেনা সদস্য তাকিয়ে থাকে আমাদের দিকে। দূর থেকে আমাদের দিকে মেগা মাইকে সতর্ক করে সরে যেতে নির্দেশ করে।
আমি আবার হেঁটে হেঁটে নিউ মার্কেট ক্রস করে আজিমপুর কলোনির বাসায় ফিরে আসি।
পুরো এলাকা যেন থমকে গেছে !
মনে হয় পুরো দেশটাই বুঝি থমকে গেছে …।
পাভেল রহমান
একুশে পদক প্রাপ্ত
ফটোসাংবাদিক ।
আমরা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।