তাওহীদুল ইসলাম নূরী

হিজরি সনের প্রথম মাস মহররম মুসলমানদের নিকট অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ এবং গুরুত্ববহ। আল্লাহর কাছে যে চারটি মাস প্রিয় তারমধ্যে মহররম একটি। এই দিনটিতে পৃথিবী সৃষ্টি হয়েছে এবং এই দিনেই পৃথিবী ধ্বংস হবে অর্থাৎ কেয়ামত সংগঠিত হবে বলে হাদিস থেকে জানা যায়। মাসটির মূলত দশ তারিখ তথা আশুরার দিনটির রয়েছে অনেক সমৃদ্ধ ইতিহাস। তাইতো, এই একটা দিন ধর্মপ্রাণ মুসলমানেরা অত্যন্ত ভাবগাম্ভীর্যের সাথে পালন করে থাকে। দুঃখের বিষয় এটাই যে, অধিকাংশ মুসলমানই আশুরা তথা মহররমের ১০ তারিখের এই দিনটিকে শুধুমাত্র শোকের দিন এবং মহররম মাসকে বেদনার মাসই বিবেচনা করে থাকে। কিন্তু, আশুরার এই দিনটির যত ইতিহাস জানা যায় সবটার মাধ্যমেই ইসলামের বিজয়, গৌরবই রচিত হতে দেখা যায়।

পৃথিবীর প্রথম মানুষ এবং নবী হযরত আদম (আ.) কে সৃষ্টির দিন হিসেবে আশুরাকে ধরা হয়। জান্নাতে নিষিদ্ধ ফল খাওয়ার পর তিনি দীর্ঘ প্রায় চল্লিশ বছর আল্লাহর দরবারে তওবা করে তার গোনাহের ক্ষমা চান। যে দিনটিতে আল্লাহ তার তওবা কবুল করেন সেটি আশুরার দিনেই। তাঁর দুই ছেলে হাবিল ও কাবিলের মাঝে আল্লাহ এই মহররমের দশ তারিখই হাবিলের কোরবানি কবুল করেন। আমরা কমবেশি আল্লাহর নবী হযরত নুহ (আ.) এর জীবনী জানি। ৯৫০ বছর তিনি মানুষকে আল্লাহর পথে আহবান করার পর মাত্র ৪০ জন পুরুষ ও ৪০ জন নারী তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে ঈমান আনে। বাকীরা একদিকে যেমন ঈমান আনে নি, অন্যদিকে দিন থেকে দিন ক্রমান্বয়ে তার উপর জুলুম নির্যাতন বাড়িয়ে দেন। তখন তিনি আল্লাহর কাছে জমিনকে কাফেরমুক্ত করার আবেদন জানালে আল্লাহ ৪০ দিন, ৪০ রাত ব্যাপী এক মহাপ্লাবন নুহ (আ.) এর সময়কার কাফেরদের জন্য গজব হিসেবে নাযিল করেন। যে প্লাবনে স্বয়ং নুহ (আ.) এর স্ত্রী ও পুত্র ডুবে মরেছিল। সেই মহাপ্লাবন শেষে আল্লাহ জমিনকে মহররমের দশ তারিখ কাফেরমুক্ত করেন। হযরত মুসা (আ.) এর হাতে আল্লাহ এই ঐতিহাসিক দিনটিতেই ফেরাউন ও তার বাহিনীকে ডুবিয়ে মেরেছিলেন।

নবীদের মধ্যে আল্লাহ হযরত আইয়ুব (আ.) কে বিভিন্ন রোগ দিয়ে পরীক্ষা করেছিলেন। এত বেশি পরীক্ষা করেছিলেন যে, তার সমস্ত শরীরে পোকা ধরেছিল। কিন্তু, তিনি আল্লাহর দরবারে কোন ধরনের অভিযোগ করেন নি। শুধুমাত্র যখন তার জিহ্বাতে পোকা ধরেছিল তখন তিনি আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করেছিলেন “আল্লাহ আমাকে তো কিছু অসুস্থতা ধরেছে। একমাত্র আপনি ছাড়া আমার উপর রহম করার কেহই নাই”। মুফাসসিরে কেরামগণ বলেন, এত অসুস্থতার পরেও আল্লাহর কাছে কিছু না বলে জিহ্বায় পোকা আসলে বলার কারণ তিনি জিহ্বায় পোকা ধরলে আল্লাহকে আর ডাকতে পারবেন কিনা শঙ্কা করেছিলেন। আল্লাহ হযরত আইয়ুব (আ.) কে সেই কঠিন অবস্থার মধ্য থেকে মহররমের দশ তারিখই আরোগ্য দান করেছিলেন। হযরত ইব্রাহিম (আ.) কে এই দিনেই নমরুদের দেয়া অগ্নিকুন্ড থেকে আল্লাহ রক্ষা করেছিলেন। আমরা জানি আল্লাহর নবী হযরত ইউনুস (আ.) একসময় মাছের পেটে ঢুকে পড়ছিলেন। তিনি দীর্ঘকাল তার জাতিকে আল্লাহর দিকে ডাকছিলেন। যখন দেখলেন খুবই অল্প সংখ্যক মানুষ ছাড়া কেউ তার আহবানে সাড়া দিচ্ছে না তখন তিনি তার জাতির সাথে একটু রাগ করে আল্লাহর হুকুম আসার আগেই নিজের একক সিদ্ধান্তে নৌকাযোগে সেই জনপদ ছেড়ে চলে যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে আল্লাহ নৌকাটিকে পানিতে ডুবিয়ে দেন এবং হযরত ইউনুস (আ.) কে একটি মাছের পেটে দেন। তখন আল্লাহর নবী সেখান থেকে আল্লাহর দরবারে গোনাহ ক্ষমা প্রার্থনা করলে মহররমের দশ তারিখ তাঁর তওবা কবুল করে মাছের পেট থেকে আল্লাহ তাঁকে বের করে দেন। হযরত দাঊদ (আ.) এর তওবাও এই দিনেই কবুল হয়েছিল। হযরত ঈসা (আ.) এর জন্মের দিন হিসেবেও এই আশুরাকে ধরা হয় এবং তাঁকে আল্লাহ এই দিনেই নিরাপদে উঠিয়ে নিয়েছেন বলা হয়ে থাকে। এভাবে কোরআনে উল্লেখিত ২৫ জন নবীর প্রায় সকলেরই জীবনে আশুরা গৌরবের ইতিহাস বহন করে।

যে ইতিহাসকে কেন্দ্র করে দশ মহররম তথা আশুরার দিনটিকে বেদনা এবং শোকের হিসেবে ধরা হয় সেটি হচ্ছে ৬১ হিজরি সনের এই দিনে কারবালার প্রান্তরে আদর্শের বিশ্বমানব বিশ্বনবী হযরত মোহাম্মদ (স.) এর নাতি হযরত ইমাম হোসাইন (র.) এর শাহাদাতের হৃদয়বিদারক ঘটনাকে ঘিরে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সূরা মায়িদায় পর পর তিনটি আয়াতের মাধ্যমে বলেছেন মানুষ যদি কাফের, ফাসেক এবং জালিমমুক্ত রাষ্ট্র ও সমাজ চায় তাহলে আল্লাহ বিশ্বনবীর মাধ্যমে যে রাষ্ট্র ব্যবস্থা দিয়েছেন সেটার অনুসরণ করতে হবে। আর, ইমাম হোসাইন (র.) কারবালার প্রান্তরে নিজের প্রাণকে বিলিয়ে দিয়ে ইয়াজিদের সেই কাফের, ফাসেক ও জালেমি খেলাফত ব্যবস্থার প্রতিবাদ জানিয়ে বিশ্বনবী প্রদর্শিত খেলাফত ব্যবস্থা কায়েমের পথকেই সুগম করে গেছেন। আপাত দৃষ্টিতে এখানে ইমাম হোসাইনের পরাজয় দেখা গেলেও গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে মুসলমানদের বিজয়ই লক্ষ্যণীয়। বলা হয়ে থাকে যে “ইসলাম জিন্দাগে বাদ হে কারবালা”। অর্থাৎ কারবালার পরেই ইসলামের জাগরণ হয়। যেমনটা জাগরণ হয়েছিল বদর,উহুদ,খন্দক,মুতারসহ মুসলমানদের সাথে কাফেরদের প্রতিটি যুদ্ধের পরে। সমগ্র বিশ্বজুড়ে মুসলমানরা বর্তমানে কঠিন সময় অতিক্রম করে চলছে। কাফের, ফাসেক এবং জালিমরা মিলে আল্লাহর জমিনে রাসুল (স.) প্রদর্শিত রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থা কিছুতেই প্রতিষ্ঠিত হতে দিতে চায় না। তাই, শোক মিছিল, একে-অপরের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে আঘাতসহ অহেতুক বিভিন্ন বেদাতের মাধ্যমে আশুরার দিনটি পালন না করে আমাদের সকলের উচিত ইমাম হোসাইন (র.) এর শিক্ষা বক্ষে ধারণ করে আল্লাহর বিধান অনুযায়ী এই কাফের, ফাসেক এবং জালেমের বিরুদ্ধে খড়গহস্ত হয়ে রাসুল (স.) প্রদর্শিত রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে যাওয়া। আর, তখনই পরিপূর্ণ হবে আশুরার শিক্ষা।

 

লেখকঃ শিক্ষার্থী,  আইন বিভাগ ,আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম।